সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

কলিঙ্গরাজ খারবেল | Kharavela of Kalinga

 কলিঙ্গরাজ খারবেল

মৌর্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার আগে কলিঙ্গ রাজ্য ছিল অশোকের নজরে একটি অবিজিত এলাকা। মৌর্যদের পতনের পর কাল ক্রমে কলিঙ্গে ক্ষমতাশালী রাজবংশের প্রতিষ্ঠিত হয়। এই রাজবংশ ছিল মহামেঘবান তথা চেদি বংশ। চেদি ছিল খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের অন্যতম মহাজনপদ। বর্তমান বুন্দেলখন্ড এলাকায় চেদি মহাজনপদের অস্তিত্ব ছিল। পরে কোন এক সময় এরা উড়িষ্যার কলিঙ্গে চলে আসে। কলিঙ্গে চেদি রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা মহামেঘবান এবং এই বংশের শ্রেষ্ঠ শাসক হলেন খারবেল। খারবেল সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য আমরা পেয়ে থাকি প্রাকৃত ভাষায় রচিত ভুবনেশ্বরের নিকটস্থ হাতিগুম্ফা প্রশস্তি থেকে।

খারবেল এর পিতা ছিলেন মহারাজবক্রদেব। খারবেল ছিলেন এই বংশের তৃতীয় শাসক। তবে মহামেঘবানের সাথে তার সম্পর্ক কি ছিল তা সঠিক জানা যায় না। খারবেলের রাজত্বকাল নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। খারবেল তার পঞ্চম রাজ্যবর্ষে তি বস শত পূর্বে নন্দ রাজা কর্তৃক নির্মিত একটি সেচ খাল সংস্কার করেছিলেন। এই তি বস শত কথাটিকে কাশি প্রসাদ জাসওয়াল 103 বছর অর্থে গ্রহণ করে খারবেল এর শাসনকাল চিহ্নিত করেছেন 223 খ্রীষ্টপূর্বাব্দে। কিন্তু অধিকাংশ ঐতিহাসিক তি বস শত কথাটিকে 300 বৎসর হিসেবে গ্রহণ করে খারবেলের রাজত্বকাল নির্ধারণ করেছেন 24 খ্রীষ্টপূর্বাব্দ নাগাদ। দ্বিতীয় মতটিই ঐতিহাসিক মহলে অধিক গ্রহণযোগ্য।

খারবেল 15 বছর বয়স অতিক্রান্ত হলে যুবরাজ হিসেবে নিযুক্ত হন এবং 9 বছর যুবরাজ থাকার পর 24 বছর বয়সে কলিঙ্গের শাসনভার গ্রহণ করেন। তার উপাধি ছিল কলিঙ্গাধিপতি ও কলিঙ্গ-চক্রবর্তীন। দ্বিতীয় রাজ্যবর্ষে খারবেল সাতকর্ণী দের তোয়াক্কা না করে পশ্চিম দিকে অবস্থিত ঋষিক নগরে তার অভিযান পাঠিয়েছিলেন। এই নগরের অবস্থান সম্ভবত কৃষ্ণা ও গোদাবরী নদীর মধ্যবর্তী কোন এলাকায়। অনেকেই মনে করেন সাতবাহন দের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক বজায় ছিল বলেই এমন অভিযান তিনি করতে পেরেছিলেন। যাই হোক এই অভিযানের ফলাফল কলিঙ্গের পক্ষে দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। রাজত্বকাল এর চতুর্থ বছরে খারবেল বিদ্যাধর নামে একজন রাজকুমারের রাজধানী দখল করেছিলেন। এই রাজ্যের অবস্থান নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। ওই বছরই তিনি ভোজক ও রথিকদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে তাদের বশ্যতা আদায় করেছিলেন। এদের অবস্থান ছিল সম্ভবত নাগপুর সন্নিহিত এলাকায়। অষ্টমবর্ষে খারবেল গোরধগিরি বা গোয়া জেলার বরাবর পার্বত্য এলাকায় আক্রমণ হানেন এবং রাজগৃহ অবরোধ করেন। এর ফলে ডিমিত নামক এক যবন রাজা মথুরায় পলায়ন করেন। এই ইন্দো-গ্রিক শাসক এর যথার্থ সনাক্তকরণ সম্ভব হয়নি। রাজত্বকাল এর দশম বছরে তিনি ভরধবস বা ভারতবর্ষে অভিযান পাঠালেন। 'ভারতবর্ষ' শব্দটি দ্বারা খুব সম্ভবত মগধ ও মথুরার অন্তর্বর্তী গাঙ্গে উপত্যাকার কোন এক অংশের কথা বলা হয়েছে। রাজত্বকাল এর একাদশ বর্ষে খারবেল তামিলনাড়ুর উপকূলবর্তী এলাকার একজন রাজার রাজধানী পৃথুঢ় নগরী ধ্বংস করেন। পরের বছর তাকে দেখা যায় উত্তর ভারত অভিযান করতে, যখন মগধ শাসক বৃহৎস্বতীমিত্র তার পাদবন্দনা করলেন। তিনি মগধ থেকে কলিঙ্গের জৈন মূর্তিগুলি পুনরুদ্ধার করলেন এবং বহু ধনসম্পত্তি লুন্ঠন করলেন। ওই একই বছরে দেখা যায় তাকে দ্বিতীয় বার দক্ষিণ ভারতে অভিযান করতে। সুদূর দক্ষিণে পান্ডু রাজাকে পরাজিত করে তাকে কর প্রদানে তিনি বাধ্য করলেন।

ধর্মীয় ক্ষেত্রেও খারবেল এর অবদান উল্লেখযোগ্য। ব্যক্তিগতভাবে তিনি জৈন ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন। তার অগ্রমহিষীও যে জৈন ধর্মের অনুরক্ত ছিলেন তার প্রমাণ রয়েছে উদয়গিরি পর্বতগাত্র খোদিত একটি শিলালেখতে। রাজত্বকালের ত্রয়োদশ বৎসরে খারবেল এবং তার অগ্রমহিষী সিঁধল জৈনদের একটি সম্মেলন আহ্বান করেন এবং জৈন সাধুদের উন্নত মানের উপহার প্রদান করেন। হাতিগুম্ফা লেখ তে তাকে একজন জনহিতকর শাসক হিসাবেই দেখানো হয়েছে।

হাতিগুম্ফা লিপির প্রশস্তি সুলভ অতিরঞ্জন এবং বাগবিস্তার সত্বেও এটা স্পষ্ট যে খারবেল এর নেতৃত্বে কলিঙ্গ একটি আগ্রাসী আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং এতদিন ধরে অশোকের কলিঙ্গ জয়ের যে প্রতিশোধ স্পৃহা পোষিত হচ্ছিল তার বহিঃপ্রকাশ খারবেল এর রাজত্বকালে প্রকট হয়েছিল। যদিও খারবেলের পরবর্তীকালে কলিঙ্গের মহামেঘবান বংশ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং খ্রিস্টীয় প্রথম শতকের প্রথমার্ধের মধ্যেই তাদের পতন ঘটে।

Kharavela of Kalinga

Before becoming part of the Maurya Empire, Kalinga was an unconquered region as mentioned in the Ashokan edicts. After the Mauryan decline, powerful dynasties gradually emerged in Kalinga. Among them was the Mahameghavahana or Chedi dynasty, originally one of the major Mahajanapadas in the sixth century BCE, located in present-day Bundelkhand. At some point, they migrated to Kalinga in Odisha. The founder of the Chedi dynasty in Kalinga was Mahameghavahana, and its most renowned ruler was Kharavela. Our knowledge about Kharavela primarily comes from the Hathigumpha inscription near Bhubaneswar, written in Prakrit.

Kharavela’s father was Maharaja Vakradeva, and Kharavela was the third ruler of this dynasty. However, his exact relationship to Mahameghavahana remains unclear. Historians debate Kharavela’s reign period. In his fifth regnal year, he repaired an irrigation canal originally built by a Nanda king 300 years earlier, leading some historians like Kashi Prasad Jaiswal to place his reign around 223 BCE, interpreting the term as 103 years. However, most historians interpret it as 300 years, dating his reign to around 24 BCE, a view more widely accepted.

At the age of 15, Kharavela was appointed as the crown prince and, after serving in this role for nine years, ascended the throne of Kalinga at 24. He held the titles of *Kalingadhipati* and 'Kalinga-Chakravartin.' In his second year, disregarding the Satakarnis, he launched a campaign towards the city of Rishika, possibly located between the Krishna and Godavari rivers, suggesting a friendly relationship with the Satavahanas that allowed such a campaign. However, the campaign did not yield long-lasting benefits for Kalinga. In his fourth regnal year, Kharavela captured the capital of a prince named Vidyadhara, whose territory is unknown, and subsequently subdued the Bhojakas and Rathikas, likely located near present-day Nagpur.

In his eighth year, Kharavela attacked the mountainous region near Goradhagiri (or modern Goa) and besieged Rajagriha, causing a Greek ruler named Demetrius to flee to Mathura. This Indo-Greek ruler’s identity remains uncertain. In his tenth year, Kharavela launched a campaign towards 'Bharatavarsha', which likely refers to an area in the Gangetic valley between Magadha and Mathura. In his eleventh year, he destroyed the capital Pithuda of a ruler on the Tamil Nadu coast. The following year, he ventured into northern India, where the Magadhan ruler Brihasvatimitra submitted to him. Kharavela reclaimed Jain statues that had been taken to Magadha and plundered substantial wealth. That same year, he launched a second campaign in southern India, subjugating the Pandya ruler and compelling him to pay tribute.

Kharavela made significant contributions to religion. He was a devout follower of Jainism, and an inscription carved into the Udayagiri hills suggests that his chief queen also embraced Jainism. In the thirteenth year of his reign, Kharavela and his queen Sindhula hosted a Jain assembly and provided lavish gifts to Jain monks. The Hathigumpha inscription portrays him as a benevolent ruler who worked for public welfare.

Despite the Hathigumpha inscription's tendency for exaggeration, it is evident that under Kharavela's leadership, Kalinga emerged as an aggressive regional power, expressing the longstanding desire for vengeance against Ashoka's conquest of Kalinga. However, following Kharavela’s reign, the Mahameghavahana dynasty in Kalinga weakened and fell in the early first century CE.

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য Please visit our Homepage and subscribe us. Suggested Topics || Ghajnavid Invasion || গজনী আক্রমণ || || মামুদের সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন || Somnath Temple Plunder || || তরাইনের যুদ্ধ ও তার গুরুত্ত্ব || মহম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমন ও তার চরিত্র || সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আ...

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগ...

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হ...