সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ডি কলনাইজেশন

অব-উপনিবেশিকরণ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীর অন্যতম উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো ডি কলোনাইজেশন বা অব উপনিবেশীকরন। উপনিবেশবাদের আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল পঞ্চদশ শতাব্দীতে, যখন ব্রিটেন ফ্রান্স হল্যান্ড পর্তুগাল এবং স্পেনের মত ইউরোপীয় শক্তি গুলি বিশ্ববণিজ্যকে হাতিয়ার করে বিশ্বশক্তি হয়ে ওঠার প্রবল আকাঙ্ক্ষায় এশিয়া আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার পিছিয়ে পড়া দুর্বল দেশগুলিকে করায়ত্ত করতে শুরু করেছিল। উপনিবেশীকরনের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত রূপ পেয়েছিল 19 শতকের সমাপ্তি এবং 20 শতকের সূচনালগ্নে। বিশ্বের মোট ভূখণ্ডের প্রায় 99.2 শতাংশ বৃহৎ শক্তির উপনিবেশে পরিণত হয়েছিল। উপনিবেশবাদের প্রসারের সাথে সাথে সেই সমস্ত দেশে উপনিবেশবাদবিরোধী প্রবল গণ-আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর চরম আকার ধারণ করেছিল। একইসাথে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতিজনিত কারণে ঔপনিবেশিক শক্তিগুলি দুর্বল হয়ে পড়েছিল এবং বিশ্বে সুপার পাওয়ার' হিসেবে আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। এই প্রেক্ষিতেই বিশ্বে অব উপনিবেশীকরন প্রক্রিয়ার সূচনা হয়েছিল।

অব উপনিবেশীকরন প্রক্রিয়ার পিছনে একাধিক কারণে সমন্বয় লক্ষ্য করা যায়। প্রথমত, উপনিবেশিক শক্তি গুলির মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব। গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স, পর্তুগাল, স্পেন, বেলজিয়াম, হল্যান্ড, ইতালি প্রভৃতি তৎকালীন সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হয়েছিল। প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকে অনেকেই উপনিবেশিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরিণতি হিসেবেই দেখে থাকেন। ঔপনিবেশিক শক্তিগুলির পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বীতা উপনিবেশবাদবিরোধী আন্দোলন গুলিকে উৎসাহিত করেছিল।

দ্বিতীয়তঃ পাশ্চাত্য শিক্ষা সংস্কৃতির প্রভাব। উপনিবেশ গুলিতে পশ্চিমী শিক্ষা বিস্তার এবং ইউরোপের সঙ্গে যোগাযোগের ফলে উপনিবেশগুলির কিছুসংখ্যক মানুষের মধ্যে স্বাধীনতা, সাম্য, উদারনীতির ধারণা সঞ্চারিত হয়েছিল। এরাই পরবর্তীকালে উপনিবেশবাদবিরোধী মুক্তি সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিল।

তৃতীয়তঃ ঔপনিবেশিক শক্তিগুলির নিজেদের দেশেই উপনিবেশবাদবিরোধী আওয়াজ উঠছিল। বিভিন্ন বুদ্ধিজীবী স্বদেশের ঔপনিবেশিকতা কে সমালোচনা করেছিল এবং জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

চতুর্থত: দীর্ঘদিন ধরেই উপনিবেশগুলোতে আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবি সোচ্চার হয়ে উঠেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং তার পরবর্তী সময়ে সেই স্বাধীনতা সংগ্রাম ক্রমশ তীব্রতর হয়ে উঠেছিল যা ঔপনিবেশিক শক্তিগুলির কে উপনিবেশ ত্যাগে বাধ্য করেছিলো।

পঞ্চমত: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে, বিশেষ করে হিটলারের আক্রমনে মিত্রপক্ষীয় শক্তিগুলি কার্যত অর্থনৈতিক ও সামরিক ভাবে ধরাশায়ী হয়ে গেছিল (যদিও তারা অক্ষশক্তিকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছিল)। তাছাড়া অক্ষ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সহযোগিতা পাওয়ার আশায় উপনিবেশ গুলি কে তারা স্বায়ত্তশাসন প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই তাদের যুদ্ধ জয়ের পর আপসে উপনিবেশ ত্যাগ করতে হয়েছিল।

ষষ্ঠতঃ বিশ্বযুদ্ধের পর তথাকথিত মহাশক্তি গুলি তাদের অবস্থান ধরে রাখতে পারেনি তাদের জায়গা দখল করে নব উদ্ভূত দুই সুপার পাওয়ার আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন। উভয় শক্তিই অবউপনিবেশীকরনের পক্ষে জোর সওয়াল করেছিল। আমেরিকা চেয়েছিল উপনিবেশ গুলি স্বাধীন হলে সেখানে মুক্ত বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ঘটিয়ে তার ডলার সাম্রাজ্যবাদের প্রসার ঘটাতে পারবে। অন্যদিকে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়ন বরাবরই উপনিবেশবাদবিরোধী অবস্থান বজায় রেখেছিল। সে চাইছিল নব্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশগুলিতে যাতে কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিস্তার ঘটে।

সপ্তমতঃ স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু প্রবর্তিত নির্জোট আন্দোলনের অন্যতম কর্মসূচি ছিল উপনিবেশবাদের বিরোধিতা করা এবং উপনিবেশবাদবিরোধী আন্দোলন গুলির পক্ষে দাড়ানো।

সর্বোপরি, বিশ্ব শান্তি রক্ষার জন্য গড়ে ওঠা সম্মিলিত জাতিপুঞ্জও উপনিবেশ গুলির স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসন এর পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেছিল।

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগ...

আরবদের সিন্ধু অভিযানঃ প্রত্যক্ষ কারণ ও তাৎপর্য | Arab Conquest of Sindh: Immediate Causes and Significance

আরবদের সিন্ধু অভিযানঃ প্রত্যক্ষ কারণ ও তাৎপর্য সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আগেও বহুবার ভারতের বিভিন্ন জায়গায় অভিযান পাঠানো হয়েছিল। তবে এই(712 খৃ:) অভিযানের একটি প্রত্যক্ষ কারণ ছিল। জানা যায় যে সিংহলের রাজা ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ কে কয়েকটি জাহাজে করে উপঢৌকন পাঠাচ্ছিলেন কিন্তু পথে সিন্ধু দেশের জলদস্যুরা দেবল বন্দরে এ...

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হ...