কিউবা ক্ষেপণাস্ত্র সংকট
আমেরিকার ফ্লোরিডা উপকূল থেকে মাত্র 160 কিলোমিটার দূরত্বে ক্যারিবিয়ান উপসাগরের অন্যতম দ্বীপরাষ্ট্র হল কিউবা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে যে মার্কিন-সোভিয়েত স্নায়ু সংঘর্ষের ধারা চলে আসছিল 1962 সালে তা পারমাণবিক যুদ্ধ পরিণত হওয়ার উপক্রম হয়েছিল মার্কিন মুলুকের একেবারে উঠানে কিউবাতে। কিউবা সোভিয়েত ইউনিয়নের সহযোগিতায় মার্কিন মুলুকের দিকে তাক করে ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। যদিও আন্তর্জাতিক আলাপ-আলোচনার পর মার্কিন সোভিয়েত সমঝোতা হয়ে যায় এবং ক্ষেপণাস্ত্র সংকটের অবসান ঘটে। তবে ঠান্ডা যুদ্ধের ইতিহাস কিউবা ক্ষেপণাস্ত্র সংকট এক উল্লেখযোগ্য তাৎপর্যবাহী ঘটনা।
পটভূমি
কিউবা ক্ষেপণাস্ত্র সংকটের প্রেক্ষাপট বুঝতে হলে ল্যাটিন আমেরিকায় মার্কিন নীতি, মার্কিন সোভিয়েত সম্পর্কের গতিবিধি এবং কিউবার অভ্যন্তরীণ রাজনীতি বুঝতে হবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বহু আগে থেকেই ল্যাটিন আমেরিকা এবং মধ্য আমেরিকায় নিরবচ্ছিন্নভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কায়েম ছিল পানামা খাল ক্যারিবিয়ান উপসাগর কার্যত আমেরিকার নিজস্ব হ্রদে পরিণত হয়েছিল। 1918 খ্রিস্টাব্দে স্পেনকে যুদ্ধে পরাজিত করার পর থেকেই এই একাধিপত্যের সূচনা। 1933 সালে তদানীন্তন মার্কিন রাষ্ট্রপতি রুজভেল্ট ল্যাটিন আমেরিকায় Good Neighbour Policy ঘোষণা দ্বারা জানিয়েছিলেন যে পশ্চিম গোলার্ধে কোনরূপ অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ বরদাশ্ত করা হবে না। বিশ্বযুদ্ধের পর মারকিনের সাম্যবাদ বিরোধিতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। 1947 সালের 2 ডিসেম্বর রিও চুক্তি স্বাক্ষর করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ল্যাটিন আমেরিকাতে একটি যৌথ সামরিক মোর্চা গঠন করল। চুক্তিবদ্ধ 21 টি রাষ্ট্র 1948 সালে কলম্বিয়ায় মিলিত হয়ে Organization of American States (OAS) গঠন করল। পক্ষে OAS ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ল্যাটিন আমেরিকা সম্পর্কিত রক্ষাকবচ, যাকে সামনে রেখে CIA দ্বারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ল্যাটিন আমেরিকায় গণআন্দোলনের মাধ্যমে গড়ে ওঠা প্রগতিশীল সরকার গুলিকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল ।
1959 খ্রিস্টাব্দে সেপ্টেম্বর মাসে নিকিতা ক্রুশ্চেভ এর মার্কিন সফর থেকে মার্কিন সোভিয়েত সম্পর্ক ক্রমশ উন্নত হচ্ছিল। কিন্তু ইউ-2 বিমান ঘটনাকে (1960,মে) কেন্দ্র করে সম্পর্ক আবার খারাপ হতে শুরু করে। সোভিয়েত ইউনিয়ন হঠাৎ তার আপসমুখী মনোভাব ত্যাগ করে, এমনকি মার্কিন রাষ্ট্রপতি আইজেনহাওয়ারের সোভিয়েত সফরের আমন্ত্রণ পর্যন্ত প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তুরস্কে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিষ্ঠা প্রকল্প সম্পূর্ণ করেছিল, যেগুলি সোভিয়েত রাশিয়ার নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে একটা বড় প্রশ্ন চিহ্ন ছিল।
1952 সালে ফলজেনসিও বাতিস্তা কিউবার রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছিল এবং কার্যত একনায়কতন্ত্রের মত শাসন চালাচ্ছিল। বাতিস্তার অপদার্থতা, সংস্কারহীনতা এবং জনবিরোধী দমনমূলক নীতির বিরুদ্ধে কিউবার জনগণের মধ্যে অসন্তোষ ঘনীভূত হচ্ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছিল বাতিস্তা সরকারের পক্ষে। এই সময় ফিদেল কাস্ত্রো নামক এক তরুণ আইনজীবীর নেতৃত্বে কিউবাতে বিপ্লবী আন্দোলন শুরু হয়েছিল। 1953 সালে বাতিস্তা সরকারকে উচ্ছেদের এক ব্যর্থ চেষ্টার পর ফিদেলকে বন্দী করা হয়েছিল। ফিদেল 18 মাস পর জেল থেকে ছাড়া পায়। দ্বিতীয় প্রচেষ্টায় 1959 সালের প্রথম দিকেই ফিদেল তার আর্জেন্টিনীয় মিত্র ও সমর্থক বামপন্থী চে গুয়েভারার বিপ্লবী গেরিলা বাহিনীর সহযোগিতায় কিউবাতে ক্ষমতা দখল করতে সক্ষম হন। ফিদেল কাস্ত্রো ক্রমশ বামপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়তে থাকেন এবং মার্কিন ভূসম্পত্তি ও চিনি কল সমেত সমস্ত অন্যান্য শিল্প গুলির জাতীয়করণ ঘটিয়ে আমেরিকাকে মারাত্মকভাবে চটিয়ে দেন। এর প্রতিক্রিয়ায় আমেরিকার রাষ্ট্রপতি আইজেনহাওয়ার ফিদেলের সোভিয়েত মৈত্রীর বিরোধিতা করেন এবং কিউবা থেকে চিনি আমদানি বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দেন। এই পরিস্থিতিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন কিউবার উৎপাদিত চিনি কিনে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। ফিদেল তখন উৎসাহিত হয়ে কিউবায় বাকি মার্কিন সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে নিলেন। এইভাবে কিউবার সঙ্গে আমেরিকার কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন হল এবং আমেরিকা যেকোনো উপায়ে কি উপায়ে কাস্ত্রো সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার রণকৌশল গ্রহণ করতে মনস্থির করলো। মার্কিন গোয়েন্দা বিভাগের তৎপরতায় কিউবা থেকে পলাতক একদল প্রবাসী সেনাকে ট্রেনিং দেওয়া শুরু হলো এবং গুয়েতামালা থেকে সশস্ত্র অভিযানের পরিকল্পনা গৃহীত হল। আমেরিকার নতুন রাষ্ট্রপতি ডেমোক্রেটিক দলের কেনেডি 1961 সালের 17 ই এপ্রিল প্রায় দেড় হাজার ভাড়াটে সৈন্য মার্কিন জাহাজে করে অতর্কিতে কিউবা অভিযান শুরু করে এবং পিগ উপসাগরে উপস্থিত হয়। কিন্তু দুদিনের অবিরাম যুদ্ধে কিউবা প্রশাসন আক্রমণকারীদের চূড়ান্তভাবে পরাজিত করে।
ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপন
উপরিউক্ত পরিস্থিতিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন কিউবায় ক্ষেপণাস্ত্র মজুদ করার জন্য ঘাঁটি গড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। 1962 খ্রিস্টাব্দের বসন্তকালে এক চুক্তি অনুসারে সোভিয়েত ইউনিয়ন কিউবায় 48 টি মাঝারি ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র, মিগ 21, 28 টি জেট আণবিক বোমারুবিমান সরবরাহ করে। অক্টোবর মাসের মধ্যে প্রস্তাবিত মোট 64 টি ক্ষেপনাস্ত্রের মধ্যে 42 টি ক্ষেপণাস্ত্র পাঠায়। ফলে নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন, চিকাগো ও বস্টনের মত আমেরিকার গুরুত্বপূর্ণ নগরগুলি সোভিয়েত আক্রমণের আওতায় চলে এসেছিল।
সংকট নিরসন
মার্কিন কংগ্রেস সোভিয়েত ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি স্থাপনের সংবাদে বিচলিত হয়ে ওঠে এবং এর জন্য প্রেসিডেন্ট কেনেডি কে তার আপস মুখি মনোভাবের জন্য দায়ী করে। কেনেডি তখন তার টেলিভিশন ভাষণে আকাশ ও নৌপথে কিউবা অবরোধ করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। আরও বলা হয় পশ্চিম গোলার্ধে কোন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সোভিয়েত ক্ষেপণাস্ত্র প্রয়োগ করা হলে আমেরিকা তা সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিরোধ করবে। এদিকে পূর্বপ্রতিশ্রুতি অনুসারে অস্ত্র সরবরাহের জন্য সোভিয়েত জাহাজ কিউবার পথেই অগ্রসর হলে ন্যাটো বাহিনী অবরোধ করে। সোভিয়েত ইউনিয়ন তখন তার অস্ত্র বোঝাই জাহাজ ফিরিয়ে নেয় এবং প্রস্তাব দেন যে ভবিষ্যতে যদি আমেরিকা কিউবা আক্রমণ না করার প্রতিশ্রুতি দেয় এবং নৌ অবরোধ প্রত্যাহার করে নেয় তাহলে সোভিয়েত ইউনিয়ন ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি অপসারণের সিদ্ধান্ত নেবে। শেষ পর্যন্ত দুপক্ষই সংযমী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। 27 অক্টোবর সোভিয়েত ইউনিয়ন কিউবাতে ক্ষেপণাস্ত্র সরিয়ে নেবে বলে । আমেরিকা কিউবা আক্রমণ না করার প্রতিশ্রুতি দেয় এবং তুরস্ক থেকেও ক্ষেপণাস্ত্র গুলিকে সরিয়ে নেওয়ার অপ্রকাশ্য প্রতিশ্রুতি দেয়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন