সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

মৌর্যত্তর ভারতের কৃষি অর্থনীতি | Agriculture in Post Mauryan Period

মৌর্যত্তর ভারতের কৃষি অর্থনীতি

মৌর্য পরবর্তী ভারতবর্ষের ইতিহাস অর্থনৈতিক দিক থেকে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। মৌর্যদের পতনের পর উপমহাদেশে রাজনৈতিক টানাপোড়েনের সূচনা হয়। মৌর্যদের মত অত বড় সাম্রাজ্য আর কেউ স্থাপন করতে পারল না। উত্তর ভারতে শুঙ্গ, কান্ব, শক, পহ্লব, কুষান এবং দক্ষিণ ভারতে সাতবাহন, ইক্ষাকু প্রভৃতি রাজবংশ বিভিন্ন সময় ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করেছিল। এদের মধ্যে কুষান এবং সাতবাহনদের শাসন ছিল অন্যদের তুলনায় আকারে এবং প্রকারে বৃহত্তর। তবে রাজনৈতিক টানাপোড়েন অর্থনৈতিক জীবনে বিপর্যয় ডেকে আনে নি। বরং রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব হ্রাস পাওয়ার ফলে অর্থনৈতিক জীবনে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ক্রমশ শিথিল হতে থাকে, যা অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করে।

উত্তর ভারতে কৃষিই ছিল অর্থনীতির প্রধান ভিত্তি। আলোচ্য পর্বে কৃষি অর্থনীতির সুদৃঢ় ভিত্তি দক্ষিণ ভারতেও প্রসারিত হল। খাদ্যশস্যের মধ্যে অন্যতম ছিল ধান, গম ও যব। শালিধান রাজকীয় আহারের জন্য উপযুক্ত ছিল। অন্যদিকে অপরান্ত ও কুমুদভন্ডিকা ছিল দাস ও ভৃত্যদের জন্য। প্লিনির রচনা থেকে জানা যায় সে যুগে আখ ও তুলোর চাষ হত। দাক্ষিণাত্যের কালো মাটি তুলা চাষের জন্য উপযুক্ত ছিল। সঙ্গম সাহিত্য এবং গ্রিক বিবরণীতে কেরলে গোলমরিচ চাষের কথা বলা হয়েছে। ডি ডি কোসাম্বি নহপানের নাসিক লেখ থেকে মহারাষ্ট্রে নারকেল চাষের প্রমাণ পেয়েছেন।

কৃষি কাজের যন্ত্রপাতি হিসাবে লাঙ্গল, কোদাল, কুঠার, দা প্রভৃতির ব্যবহারের প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ তক্ষশীলায় পাওয়া গেছে। এইগুলি বেশিরভাগই ছিল লৌহ নির্মিত। মধ্যপ্রদেশ সাঁচীতে লাঙ্গলের ফলার সন্ধান পাওয়া গেছে। কৃষকরা হাল চালনা করতেন বলে তাদেরকে হালিক বলা হত। হালভিত্তিক কৃষিব্যবস্থা আলোচ্য পর্বে দক্ষিণ ভারতেও প্রসার লাভ করেছিল। ফলে দক্ষিণ ভারতেও কৃষির উদ্বৃত্ত উৎপাদন সম্ভব হয়েছিল।

কৃষি প্রযুক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো সেচব্যবস্থা। সেচ ব্যবস্থার অগ্রগতির জন্যই আলোচ্য পর্বে কৃষি সর্বভারতীয় চরিত্র লাভ করল। শাস্ত্রকারগণ সেচ ব্যবস্থার গুরুত্ব সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিলেন। সেচ প্রকল্প কেউ ধ্বংস বা ক্ষতি করলে শাস্ত্রকারগণ শাস্তির নির্দেশও দিয়েছেন। কূপ এবং জলাশয় নির্মাণকে তারা পুণ্যকর্ম হিসাবে বিবেচনা করেছেন। শক শাসক নহপান ও তার জামাতা রিষভদত্ত জলাশয় নির্মাণকর্মে উৎসাহ দিতেন এমন প্রমাণও পাওয়া গেছে। কূপ এবং জলাশয় নির্মাণের মত ছোট প্রকল্পগুলি ছিল ব্যক্তিগত উদ্যোগ কিন্তু বৃহদায়তন প্রকল্পগুলির ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের উদ্যোগ অত্যন্ত জরুরি ছিল। সেচ প্রকল্পে রাজকীয় উদ্যোগের শ্রেষ্ঠ নজির ছিল কাথিয়াবাড়ের সুদর্শন হ্রদ, যার বিশদ বিবরণ পাওয়া যাবে জুনাগড় প্রশস্তিতে। মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত এটি নির্মাণ করে দেন। রুদ্রদামনের শাসনকালে এই হ্রদের বাঁধে বিশাল ফাটল দেখা দিলে তিনি তা সংস্করণের ব্যবস্থা করেন। এরকমই একটি বৃহৎ জল সেচ প্রকল্পের অবশেষ পাওয়া গেছে এলাহাবাদের কাছে। গঙ্গার জল একটি প্রণালী দিয়ে একটি পরিশ্রবণ কক্ষ হয়ে দুটি জলাশয়ে আসত, যা পরস্পর একটি নল দ্বারা যুক্ত ছিল। এটি সরাসরি সেচের কাজে লাগত কিনা বলা যায়না। তবে এরকম জটিল প্রযুক্তির উল্লেখ না করে পারা যায় না। সঙ্গম সাহিত্যে চোল গোষ্ঠীর প্রধান কারিকল সেচ প্রকল্পের জন্য ভূয়শী প্রশংসা পেয়েছেন। তিনি কাবেরী নদীর জল সেচের কাজে ব্যবহারের উপযোগী করার ব্যবস্থা করেছিলেন। নদীর পলি পরিষ্কার করে নদীগর্ভকে গভীরতর করে বারংবার প্লাবনের হাত থেকে কৃষিকর্মকে রক্ষা করা হয়েছিল। আলোচ্য পর্বে কৃষকরা জলসেচের কাজে অরঘট্ট নামে এক যন্ত্র ব্যবহার করত। বৃহৎ কূপ বা জলাশয়ে স্থাপিত চক্রাকার এই যন্ত্রটির গায়ে ঘটি বাধা থাকতো। চক্রটি ঘুরলে ঘটি জল পূর্ণ হত এবং একটি প্রণালীর মাধ্যমে সেচের জল জমিতে চলে যেত। নাসিক লেখতে এই যন্ত্র নির্মাণের কুশলী কারিগরদের উল্লেখ আছে।

কৃষি বিজ্ঞান সংক্রান্ত চেতনা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছিল। বৌদ্ধ গ্রন্থ মিলিন্দপঞহ-তে ফসল ফলানোর বিভিন্ন পর্ব অনুপুঙ্খসহ বর্ণিত হয়েছে।

কৃষি ব্যবস্থা আলোচনা প্রসঙ্গে জমির মালিকানার ব্যাপারটি এসে যায়। অর্থশাস্ত্রে যে বিশাল আয়তন রাজকীয় মালিকানাধীন 'সীতা' জমির উল্লেখ আছে আলোচ্য পর্বে তা বিরল। গৌতমীপুত্র সাতকর্ণীর নাসিকে এরকম একটি জমি ছিল বলে জানা যায়। কিন্তু সামগ্রিক বিচারে কৃষিজমির উপরে রাজার সার্বিক অধিকার ছিল না বলেই মনে হয়। শাসকগোষ্ঠীকে যখন দান করার জন্য জমি কিনতে হয় তখন ব্যক্তিমালিকানার অস্তিত্বই প্রমাণিত হয়। একটি জমি দুবার দুটি পৃথক পদ্ধতিতে প্রদান করা সমাজে জমির উপর ব্যক্তি মালিকানা ছাড়া সম্ভব নয়। যে সমাজে জমির ব্যক্তি মালিকানা প্রতিষ্ঠা পায় সেই সমাজে জমির উপরে সমানাধিকার থাকা সম্ভব নয়। তাই কৃষি অর্থনীতিতে অসাম্য ও জটিলতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছিল একথা অনুমান করাই যায়। লেখমালা ও সাহিত্যগত সূত্র থেকে কৃষকদের বোঝাতে যে বিভিন্ন শব্দ যেমন কর্ষক, কুটুম্বিক এবং হালিক ব্যবহৃত হয়েছে এগুলি সম্ভবত কৃষকদের পৃথক আর্থিক সঙ্গতির পরিচায়ক।

Thanks for reading.

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য Please visit our Homepage and subscribe us. Suggested Topics || Ghajnavid Invasion || গজনী আক্রমণ || || মামুদের সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন || Somnath Temple Plunder || || তরাইনের যুদ্ধ ও তার গুরুত্ত্ব || মহম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমন ও তার চরিত্র || সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আ...

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগ...

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হ...