শের শাহের শাসন সংস্কার
সাম্রাজ্য স্থাপনের পাশাপাশি শের শাহ তার পাঁচ বছরের রাজত্বকালে দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা স্থাপন এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছেন। ভারতবর্ষে তিনি শাসনব্যবস্থার ক্ষেত্রে যে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনগুলি এনেছিলেন সেগুলি দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল এবং মোঘলরাও তাকে অনুসরণ করেছিল।
কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থায় শের শাহ নিজে হাতে গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরগুলোর ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতেন। তাঁর অধীনে চারজন মন্ত্রী কাজ করতেন – দেওয়ান-ই-উজিরৎ (রাজস্ব ও অর্থ মন্ত্রী), দেওয়ান-ই-আরজ (সামরিক বিষয়ক মন্ত্রী), দেওয়ান-ই-রিয়াসৎ (পররাষ্ট্রমন্ত্রী) এবং দেওয়ান-ই-ইনসা (রাজকীয় ইশতেহার তৈরি ও প্রেরণ বিষয়ক মন্ত্রী)। মন্ত্রীরা ছিলেন কেবল সচিব মাত্র, নীতি নির্ধারণ বা মৌলিক পরিবর্তনের কোনো ক্ষমতা তাদের দেওয়া হয়নি।
শেরশাহের শাসন ব্যবস্থার সর্বনিম্ন একক ছিল পরগনা। কতগুলি গ্রাম নিয়ে পরগনা গড়ে উঠত। গ্রামের শাসন ছিল মুকুদ্দম বা গ্রামপ্রধান এবং পাটোয়ারী হাতে। মুকুদ্দম আইন ও শাসন বিভাগ দেখাশোনা করতেন, পাটোয়ারী ছিল হিসাব রক্ষক। এরা সরকারী কর্মচারী ছিলেন না। এরা রাজস্বের একাংশ ভোগের শর্তে নিযুক্ত হতেন। পরগনার প্রধান ছিলেন সিকদার (শাসনতান্ত্রিক) এবং মুন্সিফ বা আমিন (জমি জরিপ ও ভূমি রাজস্ব)। এদেরকে সহযোগিতা করতেন পোদ্দার বা খাজনাদার এবং আমিন। শেরশাহ আমিনদের দু’বছর অন্তর বদলি করতেন কারণ এই পদটি খুব লাভজনক ছিল। পরগনার ওপরে ছিল সিক বা সরকার। সরকারের প্রধান ছিলেন মুক্তা বা ফৌজদার এবং তাকে সাহায্য করতেন প্রধান মুন্সিফ যিনি পরগনার মুন্সিফদের তদারকি করতেন এবং ভূমি রাজস্ব বিষয়ে সম্রাটের কাছে দায়বদ্ধ থাকতেন।
শের শাহের সবচেয়ে বড় অবদান ছিল ভূমিরাজস্ব সংস্কার। জমি জরিপ করে তার উৎপাদিকা শক্তি অনুযায়ী জমিগুলিকে ভালো, মাঝারি ও খারাপ এই তিন ভাগে ভাগ করা হত। গড় উৎপাদন নির্ণয় করে তার এক-তৃতীয়াংশ রাজস্ব হিসেবে ধার্য করা হত। নগদে অথবা শস্যে রাজস্ব জমা করা যেত। তবে শেরশাহ নগদে নিতেই পছন্দ করতেন। ভবিষ্যতে দুর্ভিক্ষের রক্ষাকবচ গড়ে তোলার জন্য বিঘাপ্রতি ২.৫ শীর অতিরিক্ত আদায় করতেন।
রাষ্ট্র এবং কৃষকদের মধ্যে সুনির্দিষ্ট সম্পর্ক গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে শেরশাহ পাট্টা ও কুবুলিয়ৎ চালু করেন। পাট্টা হল একটি দলিল যেখানে জমির উপর চাষির অধিকার এবং চাষির কাছে সরকারের প্রাপ্য লিপিবদ্ধ থাকত। চাষী উক্ত শর্ত স্বীকার করে লিখিতভাবে সম্রাটকে যা দিত তা কবুলিয়ৎ। পাট্টা ও কবুলিয়ৎ কিন্তু মধ্যস্বত্বভোগীদের ক্ষমতাকে পুরোপুরি খর্ব করতে পারেনি।
সামরিক ব্যবস্থায় তিনি আলাউদ্দিনকে অনুসরণ করেছিলেন। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী থেকে যোগ্যতার ভিত্তিতে তিনি সৈন্য নিয়োগের ব্যবস্থা করেন। সামরিক ব্যবস্থায় দুর্নীতি রোধ করার জন্য তিনি ‘দাগ ও হুলিয়া’ ব্যবস্থা চালু করেন। সৈনিকদের দ্বারা কৃষির যাতে কোনো ক্ষতি না হয় সেজন্য তিনি সৈনিকদের কড়া নির্দেশ দেন। এমনকি অভিযুক্ত সৈনিকদের শাস্তি ও ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।
রাস্তাঘাট ও পথিকের নিরাপত্তার ব্যাপারে তিনি উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যেত পথে-ঘাটে ডাকাতির সঙ্গে স্থানীয় জমিদাররাই যুক্ত থাকত। এরকম কয়েকজন জমিদারকে দমন করা হয়েছিল, যেমন ফতে খান জাঠ। তিনি জমিদারদের হুকুম দিয়েছিলেন রাস্তাঘাটে চুরি-ডাকাতি হলে তার দায় কেবল জমিদারদেরই নিতে হবে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির জন্য তিনি চারটি বৃহৎ রাস্তা তৈরি করেন। (I) সোনারগাঁ থেকে সিন্ধু পর্যন্ত সড়ক-ই-আজম (বর্তমানে G.T. রোড), (II) আগ্রা থেকে যোধপুর ও চিতোর, (III) লাহোর থেকে মুলতান এবং (IV) আগ্রা থেকে বুরহানপুর। পথিকদের সুবিধার জন্য রাস্তার ২ ক্রোশ অন্তর সরাইখানা স্থাপন করেন। সরাইখানা গুলিতে বিভিন্ন ধর্ম ও বর্ণের মানুষদের পৃথক খাওয়া-দাওয়া, বিশ্রাম ও উপাসনার ব্যবস্থা করে দেন। এই সরাইখানা গুলি অনেক ক্ষেত্রে ডাক চৌকি হিসেবেও ব্যবহৃত হত। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য এই সরাইখানা গুলিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠত ছোট শহর (কসবা)।
ব্যবসা-বাণিজ্যের সুবিধার জন্য তিনি পথঘাট উন্নয়নের পাশাপাশি মুদ্রা ব্যবস্থার সংস্কার করেন। তামা, রূপ ও সোনার মুদ্রার মাপ, ওজন এবং বিশুদ্ধতা স্থির করে দেওয়া হয়। বণিকদের কেবল পণ্য নিয়ে প্রবেশ এবং বিক্রির সময় ছাড়া আর অন্য কোন শুল্ক দিতে হত না।
ঐতিহাসিকদের একাংশ মনে করেন শেরশাহের সংস্কার গুলির দ্বারা আকবর প্রভাবিত হয়েছিলেন। আকবর জমি জরিপ, মুদ্রা ব্যবস্থা, সেনাবাহিনীতে দাগ ও হুলিয়া প্রথা এবং পরগনা ও সরকারের ধারণা শেরশাহের থেকেই নিয়েছিলেন। কিন্তু আকবরের বহু ক্ষেত্রেই নিজস্ব উদ্ভাবন ছিল। যেমন জাবতি ব্যবস্থা, মনসবদারি প্রথা, সুল-ই-কুল প্রভৃতি ছিল তার নিজস্ব উদ্ভাবন। আবার শেরশাহ আলাউদ্দিন খলজি, মহম্মদ বিন তুঘলক ও ফিরোজ শাহ তুঘলকের বহু নীতি অনুসরণ করেছিলেন। সুতরাং বলা যায় প্রজাকল্যাণকামী স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যে প্রক্রিয়া আলাউদ্দিন খলজী থেকে শুরু হয়েছিল এবং আকবরে গিয়ে তা পরিণতি পেয়েছিল শেরশাহ ছিলেন সেই পথেরই বলিষ্ঠ প্রতীক।
Thank you sir.
উত্তরমুছুনThanks sir.
উত্তরমুছুন