মে ফোর্থ আন্দোলন | May 4th Movement
প্রেক্ষাপট
1911 সালে চীনে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেলেও শান্তি-শৃঙ্খলা অগ্রগতির কোন চিহ্ন ছিল না। উপরন্তু জঙ্গী শাসনে দেশে এক অদ্ভুত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, যাকে চীনের ইতিহাসে অন্ধকারতম যুগ বলা যেতে পারে। কিন্তু এই অরাজকতার সুযোগে চীনে এক নতুন শক্তি গড়ে উঠেছিল, যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ৪ঠা মে আন্দোলন রূপে প্রকাশিত হয়েছিল। এই আন্দোলনের প্রধান চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত যুব সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ এবং চিরাচরিত কনফুসীয় ঐতিহ্যের উপর আক্রমণ।
বিদেশী শক্তির হাতে দীর্ঘদিন ধরে চীনের লাঞ্ছনার প্রতিক্রিয়ায় যে জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ঘটেছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানের নগ্ন সাম্রাজ্যবাদী ব্যবহার আগুনে ঘৃতাহুতি দিয়েছিল। জাপান শানটুং প্রদেশ দখল করে চীনের কাছে ২১ দফা দাবি পেশ করেছিল, যা ইউয়ান শি কাই সরকার অধিকাংশই স্বীকার করে নিয়েছিল। জাতির এই অপমানের প্রতিবাদে বহু চিনা ছাত্র যারা জাপানে পাঠরত ছিলেন দেশে ফেরত আসে এবং বহু চীনা ব্যবসায়ী জাপানি পণ্য বয়কটের আন্দোলন গড়ে তোলেন। জাপানি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সমগ্র চীনে যখন প্রবল জাতীয়তাবাদী তরঙ্গ বয়ে যাচ্ছে সেই সময় ভার্সাই সম্মেলনে (১৯১৯) পাশ্চাত্যের মিত্রশক্তিবর্গ শানটুং এ জাপানের অধিকার মেনে নিয়েছিল, যা কার্যত এক বিস্ফোরণের কাজ করেছিল।
মে ফোর্থ আন্দোলন এর পশ্চাতে বণিক-শিল্পপতি এবং শ্রমিক শ্রেণীর উত্থান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। মাঞ্চু রাজতন্ত্রের যুগে ব্যবসা বণিজ্য যেহেতু অবহেলিত ছিল তাই শিল্পপতি শ্রেণি সেভাবে গড়ে ওঠেনি। কিন্তু নতুন সরকারের সময় এই শ্রেনীর আত্মপ্রকাশ হয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় নিজেদের কর্মক্ষেত্র প্রসারিত করার একটা সুবর্ণ সুযোগ এসে উপস্থিত হয় এদের কাছে। জন্মলগ্ন থেকে চিনা পুঁজিপতি শ্রেণীকে বিদেশি অসম প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। কিন্তু প্রথম মহাযুদ্ধের সময় ইউরোপীয় জাতিগুলি নিজেডর ঘর সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, যার ফলে তাদের ঔপনিবেশিক বাণিজ্য ঘাটতি দেখা দেয়। এর থেকে চিনা বাজারে যে শূন্যতা সৃষ্টি হল তা চিনা পুঁজিপতিদের কাছে একটা নতুন সুযোগ এনে দিল। এই সুযোগের সদ্ব্যবহার তখনই সম্ভব যখন শ্রমিক শ্রেণীর সক্রিয় সহযোগিতা পাওয়া যাবে। আলোচ্য পর্বে চীনে বিভিন্ন কারণে শ্রমিকশ্রেণীর আবির্ভাব ঘটেছিল। শ্রমিক ও পুঁজিপতি শ্রেণীর মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে দ্বন্দ্ব থাকলেও একটা ক্ষেত্রে তারা ঐক্যবদ্ধ ছিল যে, সাম্রাজ্যবাদী শোষণ এবং অভ্যন্তরীণ নৈরাজ্য থেকে মুক্তি লাভের চেষ্টা। কারণ দেশীয় শিল্পোদ্যোগের অগ্রগতির উপর শ্রমিকদের জীবিকা অনেকটাই নির্ভর করত। তাই এই দুই শিল্পনির্ভর শ্রেণীর মধ্যে বিদেশি বিরোধী জাতীয়তাবাদ প্রবল আকার ধারণ করেছিল।
চীনের অচলায়তন ভেঙে ফেলে এবং সাম্রাজ্যবাদী শোষণের অবসান ঘটিয়ে একটি মৌলিক পরিবর্তন আনার প্রচেষ্টা সবচেয়ে বেশি প্রতিফলিত হয়েছিল পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের মধ্যে। এদের অধিকাংশই ছিল বিলাত ফেরত ছাত্র, যারা আমেরিকা, ফ্রান্স, জাপান ও অন্যান্য দেশ থেকে প্রগতিশীল রাজনৈতিক ও সামাজিক চিন্তাধারা সঙ্গে নিয়ে এসেছিল। নতুন বুদ্ধিজীবীরা দৃঢ়তার সঙ্গে প্রচার করতে লাগলেন যে, দেশকে বাঁচাতে হলে চীনের পুরনো ধ্যান-ধারণা ত্যাগ করে পাশ্চাত্যের নতুন চিন্তাধারা গ্রহণ করতে হবে। কারণ পুরানো দৃষ্টিভঙ্গি ছিল দেশের দুর্বলতা ও দুর্দশার মূল কারণ। অনিবার্যভাবে এই আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু ছিল চীনের কনফুসীয় ঐতিহ্য; কারণ ওই ঐতিহ্য ছিল চীনের প্রাচীন দার্শনিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক চিন্তাধারার উৎস। এই সমস্ত ছাত্রদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল চেন তু শিউ, ৎসাই ইউয়ান পাই প্রমুখ। ফ্রান্স থেকে শিক্ষালাভ করা চেন তু শিউ'র নিউ ইউথ পত্রিকা সমাজে প্রবল আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল। ৎসাই ইউয়ান পাই পিকিং ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির চান্সলর রূপে যোগদান করার ফলে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের খোল নালচে পাল্টে যায়। শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ গড়ে তোলার জন্য যুক্তিনির্ভর স্বাধীন মতামতের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। ফলে এই বিশ্ববিদ্যালয় সাম্যবাদ, নৈরাজ্যবাদ, উদারনীতিবাদ এবং গণতন্ত্রের প্রবক্তাদের লীলাভূমি হয়ে ওঠে।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল চিনা সাধারণ মানুষের কথ্য ভাষাকে লিখিত ভাষা হিসেবে ব্যবহার করার দাবি।
কনফুসীয় চিন্তাধারার তীব্র সমালোচক হু শি এই কথ্যভাষার প্র অন্যতম ছিলেন। তার সঙ্গী ছিলেন চেন তু শিউ। অলংকার বহুল জটিল ধ্রুপদী ভাষা সাধারণ মানুষের বোধগম্য ছিল না তাই জনসাধারণের বোধগম্য কথ্য ভাষার মাধ্যমে একদিকে যেমন আধুনিক চিন্তাধারার প্রসার সম্ভব বলে তারা মনে করেছিল তেমনি এর মাধ্যমে অতীতের জরাজীর্ণ ঐতিহ্য শৃংখল থেকে মানুষ মুক্তি পেতে পারত। যদিও প্রাচীনপন্থীরা এই প্রচেষ্টার তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কথ্য ভাষারই জয় হয়েছিল। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় কথ্য ভাষায় লেখা হতো এমনকি ১৯২০ সালে স্কুলে কথ্য ভাষা ব্যবহার সরকারি অনুমোদনও পেয়েছিল।
৪ঠা মে'র রাজনৈতিক লড়াই
উপরিউক্ত প্রেক্ষাপটে ১৯১৯ সালে ৪ঠা মে সীমিত আকারে হলেও চীনাদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে। আন্দোলনের সূচনা হয় পিকিং এর ছাত্রদের হাত ধরে। তারা রাজনৈতিক বিক্ষোভ ও প্রতিরোধের এক ধারাবাহিক পরিকল্পনা নেয়। উত্তরে পিকিং সরকার দমন নীতি গ্রহণ করে। পিকিং বিশ্ববিদ্যালয় কয়েদখানায় পরিণত হয়। ফলে আন্দোলন দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকে। পিকিং এর ছাত্রদের সমর্থনে দেশজুড়ে ছাত্ররা বিক্ষোভ দেখাতে থাকে। ছাত্রদের পাশে এসে দাঁড়ায়। বিভিন্ন স্তরের মানুষ বুদ্ধিজীবী, বণিক ও শ্রমিকরা, সান ইয়াৎ সেনের ক্যান্টন সরকার এমনকি পিকিং সরকারের প্রতিদ্বন্দ্বী জঙ্গী নায়করাও ছাত্রদের পাশে দাঁড়ায়। শ্রমিকরা হরতাল করে, ব্যবসায়ীরা দোকানপাট বন্ধ রাখে সারাদেশে জাপানি পণ্য বয়কট আন্দোলন শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত সরকার দমন নীতি পরিহার করে ছাত্রদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
ভাব জগতে বৈপরীত্য
মে ফোর্থ আন্দোলনের দীর্ঘস্থায়ী ফসল ছিল চীনের ভাব জগতে। সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে এতদিন যে ঐক্যবদ্ধ রূপটি বজায় ছিল ৪ঠা মে'র পর তা আর থাকে না। বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে মতানৈক্য ও দলীয় বিভেদ দেখা দেয়। একদল বুদ্ধিজীবী প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতাতে পাশ্চাত্যের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে প্রাচীন চীনের ঐতিহ্যবাহী নৈতিক ও আধ্যাত্মিক দর্শনের দিকে ঝুঁকে পড়েন। পাশ্চাত্য সভ্যতার তুলনায় চীনা সভ্যতার উৎকর্ষ অনুসন্ধানে তারা রত হন। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন লিয়াং সৌ মিং এবং লিয়াং লি চাও। এ প্রসঙ্গে লিয়াং লি চাওয়ের চিং যুগের চিন্তাধারা গ্রন্থটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
আরেকদল বুদ্ধিজীবী যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন হু শি, বলেন যে, কেবল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিদ্যায় নয় উপরন্তু রাজনীতি, সাহিত্য, সঙ্গীত চারুকলা এবং দর্শনেও চীন পাশ্চাত্যের তুলনায় পশ্চাৎপদ। কিন্তু তারা পশ্চিমা সভ্যতার অন্ধ সমর্থক ছিলেন না বরং প্রাচীন চীনা ঐতিহ্যকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা পুনর্মূল্যায়নের চেষ্টা করেছিলেন। রাজনৈতিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে তাঁর অভিমত ছিল এই যে চীনের বহুমুখী সমস্যা মেটাতে ধৈর্য ও সময়ের প্রয়োজন। এক্ষেত্রে ও বিলম্বিত পথ অপরিহার্য। রাতারাতি বৈপ্লবিক পরিবর্তন সম্ভব নয়। তাই সাম্যবাদ বা ওই ধরনের বৈপ্লবিক মতবাদের থেকে তিনি দেশবাসীকে সাবধান করে দেন। এই মতের আংশিক সমর্থক ছিল কুয়োমিনটাং দল।
আরেকটি দল রাজনৈতিক ও সামাজিক সক্রিয়তার মাধ্যমে দেশে দ্রুত পরিবর্তন আনতে চাইলেন। তারা রাশিয়ার বলশেভিক বিপ্লবের সাফল্যের ফলে মার্কসীয় চিন্তাধারার প্রতি আকৃষ্ট হলেন। চিনা বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে যারা সর্বপ্রথম মার্কসীয় দর্শন কে গ্রহণ করেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন লি তা চাও। হু শি কে খন্ডন করে তিনি অভিমত দিলেন যে দেশের সমস্যা সমাধানে পথনির্দেশের জন্য একটি বিশেষ মতবাদ এর প্রয়োজন আছে। এই প্রেক্ষাপটেই চিনে কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৯২১ সালের জুলাই মাসে সাংহাইয়ে তার প্রথম দলীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়।
সাংস্কৃতিক আন্দোলনের নেতাদের মধ্যে সক্রিয় রাজনীতির প্রতি সমর্থন বেড়ে যাওয়ার ফলে এই আন্দোলনের মূল চরিত্র সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। ভাব জগতে পরস্পরবরোধী যে চিন্তার আবির্ভাব ঘটল তা পরবর্তীকালে দুটি রাজনৈতিক দল কুওমিন্টাং এবং কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিদ্বন্দিতা ও সংঘর্ষের আদর্শগত পাথেয় হয়ে উঠল।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন