সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ওয়াহাবি বিদ্রোহ ও তার চরিত্র | Wahabi Movement and it's Charecter

ওয়াহাবি বিদ্রোহ ও তার চরিত্র

ওয়াহাবি আদর্শের প্রকৃত নাম 'তরিকা ই মহম্মদিয়া' অর্থাৎ মহম্মদের আদর্শিত পথ। আরব দেশে আব্দুল ওয়াহাবের নেতৃত্বে ইসলাম ধর্মাবলম্বী দের মধ্যে যে অ- ইসলামিক রীতিনীতি প্রচলিত ছিল অর্থাৎ 'বিদ-আত' তা দূরীকরণের জন্য যে শুদ্ধিকরণ আন্দোলন শুরু হয়েছিল তাই তরিকা ই মুহাম্মদিয়া নামে পরিচিত। যেহেতু আব্দুল ওয়াহাবের নেতৃত্বে শুরু হয়েছিল তাই এই আন্দোলন ওয়াহাবি আন্দোলন নামেও পরিচিত। ওয়াহাবি আন্দোলনের সূচনা ভারতবর্ষে হয় শাহ ওয়ালীউল্লাহ এর হাত ধরে। কিন্তু বিস্তার লাভ করে সৈয়দ আহমেদ বারেলির নেতৃত্বে। বঙ্গদেশে তিতুমীরের নেতৃত্বে ওয়াহাবি আন্দোলন একটি ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামের রূপ নিয়েছিল।

সৈয়দ আহমেদ বারেলির নেতৃত্বে সিন্ধু এলাকায় যে ধর্মীয় আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল তাতে একটি স্পষ্ট রাজনৈতিক চিন্তার ছাপ ছিল। একদিকে তারা শির্ক ও বিদআতের বিরুদ্ধে জনগণকে সচেতন করত এবং মোহাম্মদের নির্দেশিত পথে চলার পরামর্শ দিত। অন্যদিকে তিনি ইংরেজ শাসিত ভারতকে দার উল হারব শত্রু দেশ হিসাবে অভিহিত করেন এবং মোহাম্মদের অনুগামীদের ভারতকে দারুল ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য আহবান করেন। তাই কালক্রমে বারেলির আন্দোলন একটি শিখ বিরোধী আন্দোলনে পরিণত হয় এবং রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এর সমাপ্তি ঘটে।

তিতুমীরের ঘাঁটি ছিল বর্তমান উত্তর 24 পরগনার নারকেলবেড়ে, গোবরডাঙ্গা, লাউঘাটি প্রভৃতি এলাকায়। তিতুমীর ও তার অনুগামীরা বহু সংখ্যক মুসলমান চাষী ও জোলাকে ওয়াহাবি আদর্শে দীক্ষিত করেছিল এবং তাঁর জনপ্রিয়তা এত বৃদ্ধি পেয়েছিল যে ওয়াহাবিরা কার্যত একটি দলে পরিণত হয়েছিল। ওয়াহাবীদের এই সংঘবদ্ধতা জমিদার'দের শঙ্কিত করেছিল। তাই পুড়ার জমিদার কৃষ্ণদেব রায় ওয়াহাবীদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য তাদের দাড়ির উপর আড়াই টাকা করে কর ধার্য করেন অনুরূপ উদ্যোগ কুবগাছি ও নগরপুরের জমিদাররা গ্রহণ করে। ওয়াহাবীদের উদ্দেশ্যে কটু শব্দ হিসেবে 'দেড়ে' এবং 'নেড়ে' প্রয়োগ করতো। এছাড়া জোর করে জরিমানা আদায় এবং নানান দুর্ব্যবহার চলতে থাকে। ওয়াহাবি চাষীরা এই ব্যাপারে প্রতিবাদ জানায়। প্রতিক্রিয়ায় কৃষ্ণদেব রায় ওয়াহাবীদের মসজিদে আগুন লাগিয়ে দেয়। প্রতিকারের জন্য ওয়াহাবিরা স্থানীয় প্রশাসনের কাছে নালিশ জানায়। কিন্তু এর ফলে অত্যাচার আরো বেড়ে যায়, সপ্তম আইনের অপপ্রয়োগ বৃদ্ধি পায়।

এবার তিতুমীররা পুড়া ও তার সংলগ্ন গ্রাম আক্রমণ করে দোকানগুলিতে লুটপাট করে। সরকার বিদ্রোহ দমনের জন্য সৈন্য পাঠায়। বিদ্রোহীরা প্রচুর সিপাহী বরকন্দাজ কে হত্যা করে, থানার দারোগাকে হত্যা করে, নীলকুঠি গুলি ধ্বংস করে। তিতুমীর বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করে স্বাধীন সরকার ঘোষণা করে। নিজেকে 'বাদশা' ঘোষণা করে। চাষীদেরকে জমিদার কে করতে নিষেধ করেন এবং নিজে খাজনা আদায় শুরু করে। ব্রিটিশ সরকার এক বিশাল বাহিনী পাঠিয়ে কামানের গোলায় বাঁশেরকেল্লা ধ্বংস করে ওয়াহাবি বিদ্রোহ দমন করে। ঘটনাস্থলেই তিতুমীর এর মৃত্যু হয় এবং অন্যান্য নেতাদের ফাঁসি অথবা দ্বীপান্তর হয়।

তিতুমীরের ওয়াহাবি আন্দোলনের সঠিক চরিত্র নির্ধারনে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ সৃষ্টি হয়েছে। উইলিয়াম হান্টার বারাসাত বিদ্রোহ কে জমিদার বিরোধী কৃষক বিদ্রোহ হিসাবে অভিহিত করেছেন। কিন্তু বিদ্রোহের রাষ্ট্রবিরোধী তার দৃষ্টি এড়িয়ে গেছেন রনজিত গুহ দেখিয়েছেন বিদ্রোহীরা সরকারি রাজস্ব দপ্তর, নীলকুঠি এবং জমিদারের কাছারিবাড়ির নথিপত্র ধ্বংস করার চেষ্টা করেছিল। উদ্দেশ্য ছিল যাবতীয় প্রমাণপত্র লোপাট করে দেওয়া। কেবলমাত্র যুগ্ম ম্যাজিস্ট্রেট বাহিনী প্রতিরোধ বা দারোগা হত্যার মধ্য দিয়ে এই বিদ্রোহের রাষ্ট্রবিরোধী তার দিকটি ফুটে উঠেছিল তা নয়, নিজেদের একটা শাসন কাঠামো তারা গড়ে তুলেছিল। তিতুমীর ঘোষণা করেছিল,  কোম্পানির সরকারের অবসান আসন্ন প্রায়। বিদ্রোহী দরিদ্র জনতার সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি বারাসত অঞ্চলে একটি বাঁশের কেল্লা স্থাপন করে নিজেকে বাদশা বলে ঘোষণা করেন এবং তার স্বাধীন বাদশাহীর প্রতীক স্বরূপ পতাকা উত্তোলন করা হয়। একটি সেনাবাহিনী গড়ে তোলা হয় এবং জনগণের কাছ থেকে খাজনা আদায় করা শুরু হয়।

সমসাময়িক পত্রিকা সমাচারচন্দ্রিকা তিতুমীরের বিদ্রোহ কে একটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হিসাবে দেখেছিল। এমনকি আধুনিক ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার একই কথা বলেছেন। একদল পাকিস্তানি ঐতিহাসিকও এর মধ্যে ইসলামিক জাতীয়তাবাদ খুঁজে পেয়েছেন। এই বিদ্রোহের সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক যে ছিল তা অস্বীকার করার নয় বরং একটি ধর্মীয় শুদ্ধিকরণ আন্দোলন হিসেবে এর সূচনা হয়েছিল এবং কালক্রমে তা বিদ্রোহের রূপ নিয়েছিল। কিন্তু 'তরিকা-ই-মুহাম্মদিয়া' যখন বারাসত বিদ্রোহে পরিণত হল তখন তা ধর্মীয় গণ্ডি পেরিয়ে কৃষক বিদ্রোহে পরিণত হল। নিম্নবর্গীয় হিন্দুরা কোথাও নিম্নবর্গের মুসলমানদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় নি। বিদ্রোহীরা কোথাও শ্রেণীকে উপেক্ষা করে সাম্প্রদায়িক হয়ে ওঠেনি। তিতুমীরের জীবনীকার বিহারীলাল সরকার উল্লেখ করেছেন, বহু হিন্দু দরিদ্র তিতুমীরের কর্তৃত্ব মেনে নিয়েছিল এবং বহু মুসলিম জমিদার বিদ্রোহীদের আক্রমণের শিকার হয়েছিল। অর্থাৎ বিদ্রোহ সাম্প্রদায়িক গণ্ডি অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে, বিনয় ভূষণ চৌধুরীর ভাষায়, ওয়াহাবি বিদ্রোহ ছিল ধর্মীয় আদর্শে অনুপ্রাণিত এক কৃষক বিদ্রোহ।


Thanks for reading.

মন্তব্যসমূহ

  1. স্যার কোন কথাটা ঠিক তারিখ- ই -মহম্মদিয়া নাকি তরিকার -ই -মহম্মদিয়া ??

    উত্তরমুছুন
  2. উত্তর চব্বিশ পরগনার নারকেলবেড়িয়া না নালকেলবেড়া জায়গাটার কোন নাম সঠিক?

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য Please visit our Homepage and subscribe us. Suggested Topics || Ghajnavid Invasion || গজনী আক্রমণ || || মামুদের সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন || Somnath Temple Plunder || || তরাইনের যুদ্ধ ও তার গুরুত্ত্ব || মহম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমন ও তার চরিত্র || সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আ

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল তা জনজীবনে তীব্রভ

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগার:-   কোনো ব্যাক্তিগত বা অলাভজনক