স্পেনীয় সামুদ্রিক অভিযান | Spanish Voyages
ইউরোপের ইতিহাসে একটি আশ্চর্যজনক ঘটনা হল এই যে, একটি আপাত অনুন্নত দরিদ্র এবং প্রায় বিচ্ছিন্ন একটি দেশ স্পেন ভৌগোলিক আবিষ্কারে এক দুর্দান্ত সাফল্য লাভ করেছিল। 1500 খ্রিস্টাব্দ থেকে 1550 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে স্থল এবং জলে স্পেনের সাফল্য ছিল চোখ ধাঁধানো। উদাহরণস্বরূপ ইতালি ও নেদারল্যান্ডের ওপর স্পেনের আধিপত্য; তুর্কি, ওলন্দাজ ও ইংরেজদের বিরুদ্ধে স্পেনের লড়াই প্রভৃতি। কিন্তু এই সব কিছুকে অতিক্রম করেছিল ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য বিস্তারের স্পেনের দক্ষতা। আমেরিকার ওপর স্পেনের দখলদারি একইসঙ্গে স্মরণীয় এবং নিষ্ঠুর এক অধ্যায় রূপে পরিচিত।
পর্তুগিজরা যখন আফ্রিকা ঘুরে পূর্বদিকে অভিযানে রত ছিল তখন পশ্চিম দিকে অভিযান শুরু হলো স্পেনের পৃষ্ঠপোষকতায় ক্রিস্টোফার কলম্বাস এর নেতৃত্বে। তিনি জন্মসূত্রে জেনোয়ার মানুষ ছিলেন। পর্তুগিজ সরকার এই সময়ে আফ্রিকা ঘুরে দক্ষিনে অভিযান চালাতে বিশেষ আগ্রহী ছিল বলে তিনি পর্তুগালে বিশেষ জায়গা করতে পারেন নি। তিনি স্পেনের রাজা ও রানীর অধীনে চাকরি গ্রহণ করেন। কাস্তিলের রানী ইসাবেলা ও আরাগণের রাজা ফার্ডিন্যান্ড বিবাহ বন্ধনে যুক্ত হয়েছিলেন। তাঁরা গ্রানাডা জয় করে সংযুক্ত স্পেন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সংযুক্ত স্পেনের রাজা এবং রাণী কলম্বাসকে পৃষ্ঠপোষকতা করতে রাজি হয়েছিল। কলম্বাসের বিশ্বাস ছিল তিনি পশ্চিম দিক থেকে আটলান্টিক পেরিয়ে এশিয়া পৌঁছে যেতে পারবেন। 1492 এর আগস্ট মাসে কলম্বাস স্পেনের পালোস বন্দর থেকে 87 জন নাবিক নিয়ে তিনটি জাহাজে করে অভিযান শুরু করেন এবং দীর্ঘ যাত্রা করে শেষে ভূমি স্পর্শ করেন। সেখানে তিনি স্পেনের অধিকার ঘোষণা করেন। কিন্তু তিনি এশিয়ার বদলে নতুন দেশে পৌঁছেছিলেন। তিনি কিউবার যে দ্বীপটিতে অবতরণ করেছিলেন তার নাম সানসালভাদর। কলম্বাস নিশ্চিত ছিলেন যে তিনি ইন্ডিজে এসেছেন। 1493 খ্রিস্টাব্দে তিনি স্পেনে ফিরে যান এবং ঘোষণা করেন যে তিনি ইন্ডিজ যাওয়ার নতুন পথ আবিষ্কার করেছেন।
এর পরে আরও তিনবার কলম্বাস ওই একই জায়গায় গিয়েছিলেন কিন্তু মশলা সোনা ও সিল্কের ভান্ডার খুঁজে পাননি। তবুও তার বিশ্বাস ছিল যে তিনি ভারতে এসেছিলেন। তিনি যে নতুন মহাদেশে পোঁছে ছিলেন তা জানা গেল আমেরিগো ভেসপুচির অভিযানের মধ্য দিয়ে।1503 খ্রিস্টাব্দে আমেরিগো ভেসপুচি নামে এক ইতালীয় নাবিক নতুন বিশ্ব আবিষ্কারের কথা বলেন এবং একজন জার্মান অধ্যাপকের প্রস্তাবে নতুন ভূখন্ডের নামকরণ হয় আমেরিকা।
1513 খ্রিস্টাব্দে বালবোয়া দক্ষিণ দিক দিয়ে পানামার পশ্চিমে একটা নতুন সাগর খুঁজে পান এর নাম দেন প্রশান্ত মহাসাগর। 1519 খ্রিস্টাব্দে ফার্দিনান্দ ম্যাগেলান স্পেনের রাজার অধীনে চাকরি নিয়ে সেভিল থেকে পশ্চিম দিকে আমেরিকা হয়ে এশিয়ার পথ খুঁজতে অভিযান শুরু করেন। আটলান্টিক পেরিয়ে দক্ষিণ আমেরিকার দক্ষিণ দিকে ঘুরে তিনি প্রশান্ত মহাসাগর পেরিয়ে ফিলিপাইন পৌঁছে যান। তিনি প্রথম জলপথে ভূ-প্রদক্ষিণ করেন। এইভাবে ষোড়শ শতকে আটলান্টিক ধরে স্পেন নতুন বিশ্বে নিজের আধিপত্য তৈরি করতে সক্ষম হয়। ক্রমে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ, ফ্লোরিডা ও মধ্য আমেরিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে স্পেনের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
দক্ষিণ আমেরিকার সোনা ও রুপোর বিশাল ভান্ডার স্পেনের নজরে আসে এবং আমেরিকায় উপনিবেশ স্থাপনের মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় এই সোনা এবং রুপা কে হস্তগত করা। হিসপানিওলা ও পুয়োর্টোরিক থেকে প্রচুর সোনা পাওয়া যেত। পাহাড়ে আকরিকের মধ্যে যে সোনা পাওয়া যেত তা নিষ্কাশন করার জন্য প্রচুর শ্রমিকের প্রয়োজন হতো। এই শ্রমিকের যোগান আসতো আমেরিকা থেকেই। স্পেনীয়রা আমেরিকানদের দাসে পরিণত করেছিল এবং তাদেরকে কাজে লাগিয়ে এই শ্রমের যোগান হত। কখনো কখনো আফ্রিকা থেকেও দাস শ্রমিক এনে কাজে লাগানো হতো। এরপর ওরা আমেরিকায় আখের চাষ শুরু করে এবং সেই আখের চাষেও শ্রমের যোগান এদের মাধ্যমে মেটানো হত। সোনার সন্ধানে মেক্সিকো ও পেরুতে স্পেনীয়রা অগ্রসর হয় এবং সেখানে উপনিবেশ স্থাপন করে। এভাবে প্রাচীন সভ্যতাগুলি যেমন ইনকা ও আজটেক ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।
সোনা ও রুপোর খনি অঞ্চলকে ভিত্তি করে স্পেনীয় জনবসতি গড়ে উঠতে থাকে।কোটেসি এর মধ্যে সবথেকে বড় জনবসতি। এভাবে ওই অঞ্চলে উপনিবেশিক অর্থনীতি গড়ে ওঠে। ধাতু নিষ্কাশনকে কেন্দ্র করে প্রযুক্তি বিজ্ঞানের উন্নতি হয়। জার্মান ধাতুবিদরা মেক্সিকোতে নতুন পদ্ধতি প্রবর্তন করেন। ফলে আকরিক থেকে ধাতু নিষ্কাশন লাভজনক হয়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন