সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ধর্মসংস্কার আন্দোলনে মার্টিন লুথারের ভূমিকা | Reformation and Martin Luthar

ধর্মসংস্কার আন্দোলন ও মার্টিন লুথার


 ইউরোপে ধর্মসংস্কার আনন্দলনের সূত্রপাত হয়েছিল জার্মানিতে মার্টিন লুথারের নেতৃত্বে। 1517 খ্রীষ্টাব্দে রোমান ক‍্যাথলিক চার্চের  আর্থিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিশেষ করে Indulgence বা ক্ষমাবিক্রয়পত্রের তীব্র সমালোচনা করেন। দুপক্ষের এই বাদানুবাদ সংস্কার আন্দোলনে পরিণত হয়। লুথার পোপতন্ত্রের সমালোচনা করলেও রাজশক্তির পক্ষে দাঁড়িয়ে ছিলেন। রাষ্ট্র ও পোপের মধ‍্যকার দ্বন্দ্ব ধর্মসংস্কার আন্দলনের পক্ষে লাভজনক হয়েছিল।

15 শতকের শেষ দিকে জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে মানবতাবাদী পণ্ডিতদের সমাবেশ ঘটতে থাকে। উচ্চশিক্ষায় ছাত্রসংখ‍্যাও বাড়ছিল। একই সঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষার প্রসারও ঘটেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে  নতুন চিন্তা ভাবনার জোয়ার সমাজের নিম্নতর স্তরেও পৌঁছে যাচ্ছিল। ফলে সমাজে বিশেষত শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ‍্যে ধর্মীয়  জীবনে কিছু সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়ে ছিল।

সমসাময়িক রাজনৈতিক পরিস্তিতি ধর্মসংস্কার আন্দোলনকে তরাণ্বিত করেছিল। জার্মানিতে লুথার যখন র্মাজনা পত্র বিক্রয়কে আক্রমণ করলে তখন যাজক সম্প্রদায়ের মধ‍্যে যে বির্তকের সূত্রপাত হয়। তাকে দুটি ভিন্নধর্মী মতার্দশের ভিতরকার সংঘাত হিসাবে ধরা হয়েছিল। কিন্তু অল্পদিনেই মতাদর্শগত সংঘাত রাজনৈতিক আন্দলনে পরিণত হয়। উওর জার্মানির কৃষকরা যে বিদ্রোহ করেছিল তা শুধু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের অনাচারের বিরুদ্ধে নয়, সামাজিক নিষ্পেশনের বিরুদ্ধেও, যা রাজশক্তিকে উদ্বিগ্ন করেছিল। রাজশক্তি এই বিদ‍্রোহ দমন করে ছিল। কিন্তু এর পর থেকে সংস্কার আন্দোলনের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে চেয়েছিল। তাই লুথারপন্থী প্রতিবাদ গুলিকে রাজা সমর্থন করেছিল, যাতে গণবিদ্রোহের সম্ভাবনা এড়ানো যায়। লুথারবাদ জার্মানিতে স্বীকৃতি পেয়েছিল এবং এর ফলে এক ধর্মকেন্দ্রীক রাজনৈতিক বিভাজনের সূচনা হয়েছিল।

লুথারের মতবাদের মূল কথা দুটি 1) সবাই নিজেই নিজের পুরোহিত, এবং 2) ঈশ্বর বিশ্বাসই হল মুক্তির একমাত্র পথ। তিনি বলতেন মন্দ প্রেতাত্মা সতত চারিদিকে ঘুরে বেরায় এবং মানুষকে কুপথে চালিত করে। লুথার এক অন্তহীন পাপবোধে আচ্ছন্ন ছিলেন। দৈব ও মানবজীবণ সম্পর্কে  তার ভাবনা ছিল পরস্পর বিরোধী। তার মতে মানুষ  প্রাথমিক কর্তব‍্য ছিল ঈশ্বরের অনুগমন করা। আবার তিনি বলছেন মানুষ জীবণের প্রয়োজনে ঈশ্বর থেকে বিচ্ছন্ন এবং  যুক্তিনির্ভর আর যুক্তি দিয়ে ঈশ্বরকে পাওয়া  যায় না। লুথার এই ঈশ্বর ও মানবের বিচ্ছিন্নতা দূর করতে চেয়েছিলেন। তার মতে ঈশ্বর ও মানুষের মধ্যে সেতুর কাজ করে ঈশ্বর বিশ্বাস। ঈশ্বরের প্রতি নিসংশয় বিশ্বাস থাকলেই মানুষের মুক্তি সম্ভব। ঈশ্বর বিশ্বাসীদের ধর্মীয় আচার আচরণের প্রয়োজন হয়না। ঈশ্বর বিশ্বাসের উৎপত্তি যেহেতু বাইবেল তথা ঈশ্বরের বাণী, তাই বাইবেলের বাণী প্রচার করেই মানুষকে ঈশ্বর বিশ্বাসী করা সম্ভব। 

তিনি আরো বলেন খ্রীষ্টানরা ( সেই সময় ) বাইবেল থেকে বিচ্ছিন্ন। পোপতন্ত্র ঈশ্বরের সৃষ্টি নয়। ভালো কাজ করলেই ঈশ্বর পাওয়া  যায় না, ভালো মানুষ  হতে হয়। আর একজন ভালো মানুষের মুক্তির জন্য  পুরোহিতের দরকার হয় না, সে নিজেই নিজের পুরোহিত। এইজন‍্যই মার্জনা পত্র কিনে মুক্তির পথ খোঁজা অবান্তর।

লুথারবাদের উৎপত্তি রাষ্ট্র ও চার্চের সম্পর্কে প্রভাব ফেলেছিল। লুথার বললেন দূনীতি গ্রস্থ চার্চেকে নিয়ন্ত্রণ করার পূর্ণ অধিকার শাসকের আছে। এইভাবে তিনি প্রোটেস্ট‍্যান্ট আন্দোলনকে রাষ্ট্রপক্ষীয় করে তোলেন। কারণ প্রোটেস্ট‍্যান্ট আন্দোলনকে রক্ষা করতে গেলে আঞ্চলিক রাষ্ট্রশক্তির সমর্থন অপরিহার্য ছিল। An Appeal to  the Christian Nobility of the German Nation পুস্তিকায় রাজন‍্যবর্গকে ক‍্যাথলিক চার্চ ধ্বংস করার আহ্বান করেছিলেন।


Thanks for reading.

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য Please visit our Homepage and subscribe us. Suggested Topics || Ghajnavid Invasion || গজনী আক্রমণ || || মামুদের সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন || Somnath Temple Plunder || || তরাইনের যুদ্ধ ও তার গুরুত্ত্ব || মহম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমন ও তার চরিত্র || সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আ

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল তা জনজীবনে তীব্রভ

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগার:-   কোনো ব্যাক্তিগত বা অলাভজনক