ব্রিটিশ শক্তির সম্প্রসারণ প্রতিরোধে মাইসোরের অবদান
ওয়েদর বংশীয় রাজাদের ক্ষমতাচ্যুত করে হায়দার আলীর 1761 খ্রিস্টাব্দে মহীশূরের ক্ষমতা দখল করেন। 1764 এর মধ্যে হায়দার আলী পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলি দখল করে মহীশূরকে একটি শক্তিশালী রাজ্যে পরিণত করেন। মহীশুরের অমিত সম্পদ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মাদ্রাজ কুটিকে প্রলুব্ধ করেছিল। রাজ্যের উত্তরাঞ্চলের কালো মাটিতে প্রচুর তুলা চাষ হতো। পশ্চিম দিকেও মৃত্তিকা অত্যন্ত উর্বর। প্রচুর দক্ষ কারিগর এবং আমদানি রপ্তানি বাণিজ্যের প্রচুর্য মহীশুরের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করেছিল। ফরাসিদের সাথে ঘনিষ্ঠতা মাদ্রাজ কুঠির উষ্মার অন্যতম কারণও ছিল। তার দরবারে একাধিক ফরাসি অফিসারদের যাতায়াত ছিল। ইঙ্গ-ফরাসি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় হায়দার ফরাসিদের নানাভাবে সাহায্য করেছিল। তবে এর পিছনে হায়দারের মনে ইংরেজ বিরোধী কোন মনোভাব ছিল না। ছিল ফরাসিদের প্রতি কৃতজ্ঞতা। কারণ ফরাসিরা মহীশুরের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার সময় হায়দারকে সাহায্য করেছিল। হায়দার ইংরেজ মিত্র আর্কটের নবাবের শত্রুদের নানাভাবে সাহায্য করে ব্রিটিশের আরও বিরাগভাজন হন। মাহফুজ খানকে আশ্রয় দেন, চাঁদা সাহেবের পুত্রকে চাকরি দেন। এছাড়া হায়দারের সাথে আর্কটের রাজনৈতিক শত্রুতাও ছিল।
এই অবস্থায় 1766 খ্রিস্টাব্দে ইষ্ট-ইণ্ডিয়া কোম্পানীর মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি হায়দ্রাবাদের নিজামের সাথে মিত্রতায় আবদ্ধ হয়ে মহীশূর আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। শুরু হয় প্রথম ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ। ইংরেজ মারাঠা যৌথবাহিনী মহীশূর আক্রমণ করলে নিজামের মিত্র পেশেয়া মাধব রাও মহীশুরে ব্যাপক লুণ্ঠন চালায়। ত্রিশক্তির মুখে পড়ে হায়দার কূটনীতির সাহায্যে ইংরেজকে নিঃসঙ্গ করেন। টাকা দিয়ে মারাঠাদের এবং নিজামকে নিরস্ত্র করেন। ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চলাকালীন নিজাম আবার ইংরেজদের পক্ষে চলে যায়। তা সত্ত্বেও একাই যুদ্ধ চালিয়ে হায়দার তার অশ্বারোহী বাহিনীর সাফল্যের সুবাদে ইংরেজদের প্রচণ্ড চাপে ফেলে দেন। 1769 নাগাদ হায়দার মাদ্রাজের উপকণ্ঠে এসে হাজির হলে ইংরেজরা হায়দারের সাথে মাদ্রাজের সন্ধি (1769 ) স্বাক্ষর করে। উভয় উভয়ের বিজিত অঞ্চল ফিরে পায়। ঠিক হয় কোনো তৃতীয় শক্তি দ্বারা কেউ আক্রান্ত হলে একে অপরকে সামরিক সাহায্য দেবে। কোম্পানির পরিচালক সভা এই সন্ধিকে কোম্পানির স্বার্থ ও মর্যাদার পক্ষে ক্ষতিকর বলে ব্যাখ্যা করেছিল।
মাদ্রাজের সন্ধিতে পারস্পরিক সহযোগীতা করার যে শর্ত ছিল, 1770 এ যখন মারাঠা পেশয়া মাধব রাও মহীশূর আক্রমন করল তখন ইংরেজরা সেই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করল। এদিকে হায়দার কোম্পানির বোম্বে কুটির সাথে যে বাণিজ্যিক চুক্তি করেছিল লন্ডনের পরিচালক সভা তা বাতিল করেছিল। 1778 খ্রিস্টাব্দে যখন ইংরেজরা ফরাসি ঘাঁটি মাহে, যেখান থেকে ফরাসিরা হায়দারকে সামরিক সরঞ্জম পাঠাতো, তা দখল করলে দ্বিতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধের আবহ তৈরি। হায়দার মাহে রক্ষায় তৎপর হয়ে ওঠে, নিজাম মারাঠা ও নাগপুরের ভোসলের সাথে একটা জোট গঠন করে।
1784 খ্রিস্টাব্দে যুদ্ধ শুরু হয়। হায়দার প্রাথমিক সাফল্য পায়। তবে ইংরেজ সেনাপতি আয়ার কুট 1781 পোর্টোনোভা এবং পাল্লিলোর ও সেলিঞ্জারের যুদ্ধে হায়দারকে পরাস্ত করে। ভেল্লর ইংরেজদের দখলে চলে যায়। এদিকে হায়দার পুত্র টিপু সুলতান ইংরেজ সেনাপতি ব্রেথওয়েটকে বন্দী করেন; ফরাসি নৌবহর ইংরেজদের বিব্রত করে তোলে। যুদ্ধ চলাকালে হায়দার কর্কট রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। টিপু যুদ্ধ চালিয়ে যায়। যুদ্ধ প্রায় সমান তালে চলে। টিপু এদিকে বেদনুর ও ম্যাঙ্গালোর দখল করে। অন্যদিকে ইংরেজরা কোয়েম্বাটোর দখল করে রাজধানী সেরিঙ্গাপত্তম দখল করতে উদ্যোগ হয়। শেষে উভয়য়ের মধ্যে বিজিত অঞ্চল ফেরত ও যুদ্ধবন্দীদের মুক্তি দেওয়া প্রতিশ্রুতিতে ম্যাঙ্গালোরের সন্ধি (1784) সাক্ষরিত হয়। তড়িঘড়ি এরকম চুক্তি করার জন্য গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস মাদ্রাজ গভর্নর ম্যাকার্টনিকে সমালোচনা করেন এবং একে অপমানজনক শান্তি প্রতিষ্ঠা বলে উল্লেখ করেন।
মাদ্রাজ বা ম্যাঙ্গালোরের সন্ধি ছিল অমীমাংসিত এবং ইংরেজদের কাছে ফলহীন। তাই নতুন গভর্নর জেনারেল জানতেন মহীশুরের সাথে যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী। 1790 খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ কোম্পানি মারাঠা ও নিজামের সাথে টিপুর বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষামূলক চুক্তি স্বাক্ষর করে। ঠিক হয়, কোনো পক্ষ টিপুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলে অন্যপক্ষ সাহায্য করবে এবং বিজিত অঞ্চলগুলি প্রত্যেকে ভাগ করে নেবে। এছাড়াও ইংরেজ কোম্পানি কুর্গের রাজা ও কান্নানের বিবির সঙ্গে দুটি প্রতিরক্ষামূলক চুক্তি করে। এভাবে টিপুকে মিত্রহীন করা হয়। ফরাসি বিপ্লবের জন্য টিপুর পক্ষে ফরাসিদের সমর্থন আদায় করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। 1789 খ্রিস্টাব্দের টিপু ইংরেজদের মিত্র ত্রিবাঙ্কুর রাজ্য আক্রমণ করলে তৃতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধের সূচনা হয়।
যুদ্ধের প্রথম দিকে টিপু সাফল্য লাভ করে। কর্নওয়ালিসের পাঠানো সেনাপতি মেডিস বিপাকে পড়ে যান। টিপু কোয়েম্বাটুর দখল কর। কিন্তু 1792 নাগাদ যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়। কর্নওয়ালিস সেরিঙ্গাপত্তমের উপকণ্ঠ-এ এসে হাজির হন। টিপু সেরিঙ্গাপত্তমের সন্ধি (1792) স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন। সন্ধি অনুযায়ী টিপু তার রাজ্যের অর্ধাংশ ছেড়ে দেন। তার দুই পুত্রকে ইংরেজদের ক্ষতিপূরণ 3 কোটি 30 লক্ষ টাকার জামিন হিসেবে বন্দী রাখতে বাধ্য হন। মহীশুরের বিজিত এলাকা ইংরেজ, মারাঠা ও নিজাম ভাগ করে নেয়। সেই মুহুর্তে টিপুকে কর্নওয়ালিস ধ্বংস করলেন না; কারন তাতে তার মিত্র রাজ্যগুলি সন্ত্রস্ত হতে পারত বা কোর্ট অব ডিরেক্টরসের অনুমোদন না-ও আসতে পারত।
ক্ষতিপূরণের প্রচুর অর্থ দিতে গিয়ে মহীশুরের অর্থনীতি ভেঙে পড়ে। যুদ্ধের কথা মাথায় রেখেই টিপু সুলতান অর্থনীতিকে ঢেলে সাজানোর চেষ্টা করেন। ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার সংস্কার করেন, বণিকদের কাছ থেকে প্রচুর ঋণ নেন এবং কৃষিপণ্য ও গ্রামীণ শিল্পের উপর একচেটিয়া অধিকার কায়েম করেন। ফ্রান্সের প্রজাতান্ত্রিক সরকারের সাথে কোন সম্পর্ক স্থাপন হয়নি। তা সত্ত্বেও জ্যাকোবিন দলের সদস্য হন এবং রাজধানীতে স্বাধীনতার বৃক্ষ রোপন করেন। ইংরেজদের বিরুদ্ধে সাহায্য পাওয়ার আশায় তিনি কনস্টান্টিনোপল, আরব প্রভৃতি দেশে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করেন এবং ফরাসি গভর্নর এর কাছে প্রতিনিধি পাঠান।
এদিকে নতুন গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়েলেসলি তীব্র সাম্রাজ্যবাদী নীতি অবলম্বন করেন। অধীনতামূলক মিত্রতা নীতির প্রস্তাব দিয়ে টিপুকে এক চরমপত্র পাঠানো হয়। টিপু তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করার ফলে চতুর্থ ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধের সূচনা হয়। 1799 খ্রিস্টাব্দে টিপু ইংরেজদের হাতে চূড়ান্তভাবে পরাজিত হয় এবং রাজধানী সেরিঙ্গাপত্তম রক্ষা করতে গিয়ে বীরের মৃত্যুবরণ করেন। এইভাবে মহীশুরের পতন ঘটে। ইংরেজরা টিপুর রাজ্য নিজাম ও নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয় এবং কিছু অংশ মহীশুরের পুরনো নবাব ওয়েদার বংশের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
ইংরেজদের বিরুদ্ধে টিপুর পরাজয়কে ঐতিহাসিকগন নানা ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। কয়েকজন ঐতিহাসিক মনে করেন অশ্বারোহী বাহিনীর গুরুত্ব হ্রাস করার ফলে এবং হায়দারের রণকৌশল ত্যাগ করার ফলে টিপুর পরাজয় হয়েছিল। সুদক্ষ ও তীব্র গতিসম্পন্ন অশ্বারোহী বাহিনী হায়দারের সময় ইংরেজদের কাছে ত্রাস হয়ে উঠেছিল হায়দারের অশ্বারোহী ছিল 34000 এবং পদাতিক ছিল 15000। টিপুর সময় সেই অনুপাত দাঁড়ায় 20000 : 50000। টিপুর জীবনীকার মহিবুল হাসান অবশ্য এই যুক্তি মানেন না। তার মতে টিপু হায়দারের রণকৌশল বা অশ্বারোহী বাহিনীর ব্যবহার থেকে বিরত থাকেন নি। কর্নওয়ালিস ও মেডসের বিরুদ্ধে টিপুর সাফল্য এসেছিল অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনীর যৌথ ব্যবহারের ফলে। তবে অনেক ক্ষেত্রে টিপু অশ্বারোহী বাহিনীকে ঠিকমতো ব্যবহার করতে পারেন নি।
দ্বিতীয়ত, হায়দার আলী ইংরেজদের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক নীতি গ্রহণ করেছিলেন এবং সর্বদা তাদের চাপের মধ্যে রেখেছিলেন। কিন্তু টিপু আত্মরক্ষামূলক নীতি অবলম্বন করেছিলেন। মহিবুল হাসান বলেছেন, "He was most interested in arts of peace than the arts of war"। এই নীতি দ্বারা ইংরেজদের মত ধূর্ত ও শক্তিশালী শত্রুর মোকাবিলা করা অসম্ভব। চতুর্থ যুদ্ধে শ্রীরঙ্গপত্তম রক্ষার জন্য বসে না থেকে বড়মহল আক্রমণ করলে ইংরেজদের সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারত।
তৃতীয়ত, ভারতে তৎকালীন রাজনৈতিক অনৈক্য টিপুর পরাজয়ের অন্যতম কারণ। মারাঠা ও নিজাম বিদেশি ইংরেজদের সাহায্য করেছিল। তৃতীয় যুদ্ধের সময় পশ্চাদ অপসারণকারী কর্নওয়ালিসকে যদি মারাঠারা ঠিক সময় সাহায্য না করত তাহলে হয়তো ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধের ফল অন্য হত। চতুর্থ যুদ্ধে মারাঠারা যদি নিরপেক্ষ না থেকে একজোটে ইংরেজদের প্রতিহত করত তাহলে হয়তো টিপুর হার এত সহজ হতো না। টিপুর নিজের কর্মচারীদের বিশ্বাসঘাতকতাও তার পরাজয়ের অন্যতম কারণ।
চতুর্থত, হায়দার আলী ফরাসিদের সাহায্য যতটা পেয়েছিলেন টিপু ততটা পাননি। তৃতীয় যুদ্ধে ফরাসিরা নিরপেক্ষ ছিল। নতুন ফরাসি প্রজাতন্ত্র টিপুকে সাহায্য দেয়নি। চতুর্থ যুদ্ধে মরিশাস থেকে মাত্র 700 সেনা এসেছিল। ফরাসিদের সাহায্য যেখানে হায়দারের সাফল্যের অন্যতম কারণ, টিপু তা থেকে বঞ্চিত হয়েছিল।
সর্বোপরি টিপুকে লড়াই করতে হয়েছিল একটি উন্নত ও সুসংঘাত শক্তির বিরুদ্ধে। পিটের আইন অনুযায়ী গভর্নর জেনারেল অপ্রতিহত ক্ষমতার অধিকারী হন। অর্থাৎ টিপুকে লড়তে হয়েছিল ব্রিটিশ ভারত সম্রাজ্যের বিরুদ্ধে, যেখানে হায়দারকে লড়তে হয়েছিল কেবল মাদ্রাজ কুঠির বিরুদ্ধে। গভর্নরের প্রত্যেকটি পদক্ষেপের পিছনে ছিল ব্রিটেনের সম্মতি ও সক্রিয় সহযোগীতা, কারণ বৃটেন তখন বিশ্বব্যাপী উপনিবেশ গড়ে তোলার লক্ষে ধাবমান। এখানে টিপুর ব্যর্থতা অনিবার্য।
Thanks for reading.
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন