বক্সারের যুদ্ধ: প্রেক্ষাপট, কারন ও গুরুত্ব
পলাশীর যুদ্ধে সিরাজকে ক্ষমতাচ্যুত করে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মীরজাফরকে বাংলা নবাব করেছিল। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই মীরজাফর এর সঙ্গে ইংরেজদের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। তখন তারা মীর জাফরের জামাতা মীর কাসিমের সাথে গোপন চুক্তি করে তাকে বাংলার মসনদে বসান(১৭৫৯)। বিনা যুদ্ধে এহেন রাজা বদল এর ঘটনা বাংলার ইতিহাসে রক্তপাতহীন বিপ্লব নামে পরিচিত।
মসনদে অধিষ্ঠিত হয়ে মীর কাসেম চুক্তিমতো ইংরেজদের সমস্ত পাওনা মিটিয়ে দেন। মেদিনীপুর, বর্ধমান ও চট্টগ্রামের জমিদারি, নগদ দশ লক্ষ টাকা এবং উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের 29 লক্ষ টাকা উপঢৌকন দিয়ে দেন। এরপর তিনি রাজ্যের শক্তি বৃদ্ধির দিকে নজর দেন। অবাধ্য কর্মচারী বিহারের দেওয়ান রাম নারায়নকে পদচ্যুত করে হত্যা করেন। রাজধানী মুর্শিদাবাদ থেকে বিহারের মুঙ্গেরে স্থানান্তর করেন। সামরিক বাহিনীকে শক্তিশালী করার জন্য সেনাবাহিনীকে ইউরোপীয় প্রথায় শিক্ষিত করার উদ্যোগ নেন। সমরু, মার্কার ও জেন্টিল নামে তিন ইউরোপীয় সেনাপতি কে নিয়ে আসা হয়। মুঙ্গেরে একটি কামান ও বন্দুকের কারখানাও খোলেন। জগত সেঠ ও তার মতো অসৎ ব্যাংকারদের নতুন ব্যবস্থা থেকে বাতিল করা হয়। আর্থিক উন্নতির জন্য জাগির গুলির উপরে তিনি পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে নতুন কর ধার্য করেন এবং জমিদারদের বেশি করে কর দিতে বাধ্য করেন। মোঘল বাদশা শাহ আলমের কাছ থেকে তিনি বছরের 26 লক্ষ টাকার বিনিময়ে নবাবী ফরমান এনে বাংলার ওপর নিজের কর্তৃত্বকে আইনগত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করেন।
মীরজাফরের উপরিউক্ত উদ্যোগ গুলি ইংরেজরা খারাপ ভাবে নেয় নি। কিন্তু ইংরেজদের সঙ্গে তার বিরোধের মূল কারণ ছিল দস্তকের অপব্যবহার। এই একই কারণে সিরাজের সঙ্গে ইংরেজদের বিরোধ বেঁধেছিলো। 1717 খ্রিস্টাব্দে ফারুকশিয়ার যে ফরমান জারি করেছিলেন তাতে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বছরে তিন হাজার টাকার বিনিময়ে বিনাশুল্কে বাণিজ্যের অধিকার দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারীরা তাদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যতে দস্তকের অপব্যবহার করছিল এবং মীরকাসেমের সময় তা মারাত্মক রূপ ধারণ করেছিল। এর ফলে একদিকে যেমন নবাবের বাণিজ্যশুল্ক কমে যাচ্ছিল অন্যদিকে অসম প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হয়ে দেশীয় বণিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল। কেবল দস্তকের অপব্যবহারই নয়, কোম্পানির কর্মচারীদের ভারতীয় দালালরা নবাবের লবণ ব্যবসার মতো একচেটিয়া বাণিজ্যতেও হাত বসাচ্ছিল।
দস্তকের অপব্যবহার বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে কোম্পানির গভর্নরকে মীর কাশেম চিঠি লিখলেন। কিন্তু তাতে কোনো ফল না হলে কোম্পানির বণিকদের পণ্যবাহী জাহাজ আটক করা হল। এরপর গভর্নর ভ্যান্সিটার্ট এর সাথে এক আলোচনায় স্থির হল যে, ইংরেজ বণিকরা 9% এবং দেশীয় বণিকরা 25% হারে বাণিজ্য শুল্ক দেবে। বাণিজ্য সংক্রান্ত কোনো বিরোধ হলে তা নবাবের কর্মচারীরাই নিষ্পত্তি করবে। কিন্তু কলকাতা কাউন্সিল তা মানতে রাজি হলো না। তারা লবণ বাণিজ্যের উপর শুল্ক 2.5% হারে দেবে এবং ইংরেজ বণিকদের বিচার ইংরেজরাই করবে এই দাবি তোলে। নবাব তখন তার কর্মচারীদের কড়া নির্দেশ দেন অবাধ্য ইংরেজ বণিকদের কঠোর হাতে দমন করতে। এই সময় নবাব আরো এক কঠোর সিদ্ধান্ত নেন-- অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দেশীয় বণিকদের আর শুল্ক দিতে হবে না। ফলে ইংরেজ বণিকরা এতদিন দস্তক এর অপব্যবহার করে যে অসম বাণিজ্যের সুবিধা পেয়ে আসছিল তা এবার হারাতে বসল। এই প্রেক্ষিতেই ইংরেজরা মীর কাশেমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। 1763 এর জুলাই মাসের পর মীর কাসেম কাটোয়া, গিরিয়া ও উদয়নালার যুদ্ধে ইংরেজদের হাতে পরাজিত হন। এরপর মুঘল বাদশাহ দ্বিতীয় শাহ আলম এবং অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলার সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে (বক্সারের) যুদ্ধে(1764) অবতীর্ণ হন এবং পরাজিত হন।
মীর কাসিম এর সঙ্গে ইংরেজদের সংঘর্ষের প্রধান কারণ দস্তকের অপব্যবহার না মীর কাসেমের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা তাই নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। সমসাময়িক ইংরেজ কর্তাব্যক্তি ভেরেলস্ট মীর কাসেমের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষাকেই এই সংঘর্ষের কারণ হিসেবে দেখেছিলেন। ভেরেলেস্ট কে অনুসরণ করে ঐতিহাসিক ডডওয়েল লিখেছেন, মীরকাসেম ইংরেজদের নিয়ন্ত্রণ মুক্ত হতে চেয়েছিল; অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য ছিল অজুহাত মাত্র। পি জে মার্শাল ওই একই কথা বলেছেন। তার মতে মীর কাসেম পূর্ব ভারতে একটি স্বাধীন রাজ্য গড়ে তোলার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। যদি অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য সংক্রান্ত সমস্যা দেখা না দিত তাও তিনি যেকোনো অজুহাতে ইংরেজবিরোধী সংঘাতে অবতীর্ণ হতেন। অন্যদিকে ঐতিহাসিক কালীকিংকর দত্ত ও বিনয় ভূষণ চৌধুরী এই সংঘাতের পিছনে কোম্পানির অর্থনৈতিক স্বার্থকেই দায়ী করেছেন। তাঁরা মনে করেন মীর কাসেমের শাসন নীতি ইংরেজদের অর্থনৈতিক স্বার্থের বিরোধী হওয়ায় তারা মীর কাসেমকে অপসারিত করতে মনস্থ করেন। 24 শে জানুয়ারি 1767 সালের ক্লাইভের কোম্পানির পরিচালন সভাকে পাঠানো একটি চিঠিতে দেখা যায়, তিনি লিখেছেন, সাম্প্রতিককালে বাংলার যাবতীয় রক্তপাত, হত্যা ও ঝামেলার মূলে ছিল অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য। এদিক থেকে দ্বিতীয় মতটিই সঠিক বলে মনে হয়।
গুরুত্ব
সামরিক দিক থেকে বলা যায়, বক্সারের যুদ্ধে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা, অযোধ্যা এবং মুঘল বাদশাহ এর সম্মিলিত বাহিনীকে পরাজিত করেছিলেন। ইংরেজদের এই জয়লাভ তাদের সামরিক গৌরব বহুগুণে বৃদ্ধি করেছিল এবং এক প্রবল আত্মবিশ্বাসের জন্ম দিয়েছিল। অন্যদিকে ভারতীয় সামরিক শক্তির চরম দুর্বলতা সকলের সমক্ষে প্রকাশিত হয়েছিল।
অর্থনৈতিক দিক থেকে বক্সারের যুদ্ধের গুরুত্ব ছিল সবচেয়ে বেশি। যুদ্ধের পর থেকে বাংলার বুকে যে লুন্ঠনের সূচনা হয়েছিল বক্সারের যুদ্ধে জয়লাভের পর আরো তীব্র হলো রাজনৈতিক আধিপত্য কে পুঁজি করে কোম্পানি ও তার কর্মচারীরা অবাধে লুণ্ঠন চালাতে থাকলো। দস্তকের অপব্যবহার নিয়ে বলার মত আর কেউ রইল না। অবাধে বিনাশুল্কে বাণিজ্য এবং কোম্পানির এজেন্ট দের অত্যাচারে বাংলার অর্থনীতি ধ্বংস হতে থাকল। দেশীয় শিল্প এবং দেশীয় বাণিজ্য ধ্বংসপ্রাপ্ত হল এবং সম্পদের বহির্গমন বহুগুণ বেড়ে গেল।
Thank u sir
উত্তরমুছুনদস্তকের অপ ব্যবহারের ফলে সিরাজের সঙ্গে ইংরেজদের বারে বারে বিরোধ বাধে। এখানে দস্তক বলতে কী বোঝানো হয়েছে বা দস্তক কথার অর্থ কি?
উত্তরমুছুনThank you sir.
উত্তরমুছুন