আধুনিক চীনের ইতিহাসে 1911 খ্রিস্টাব্দে গণতান্ত্রিক বিপ্লব উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে চীনে মাঞ্চু রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে এবং একটি প্রজাতান্ত্রিক সরকার সান-ইয়াৎ-সেনের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে। যদিও এই প্রজাতন্ত্র ক্ষণস্থায়ী হয়েছিল এবং সানের পদত্যাগ এবং ইউয়ান সি কাই একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বিপ্লবের সমাপ্তি হয়।
1911 এর বিপ্লবের পটভূমি আলোচনা প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক ইমানুয়েল স্যু বলেছেন উনিশ শতক থেকে চীনের ইতিহাসে জাতীয় অবমাননার ইতিহাস। 1842 খ্রিস্টাব্দে নানকিং এর সন্ধি থেকে শুরু করে 1901 এর বক্সার প্রটোকল পর্যন্ত বিদেশী শক্তির সাথে চিন নানান অসম চুক্তি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়েছিল। চীনের কোন রাজ্য গুলি হাতছাড়া হয়েছিল এতদিন যারা মধ্য রাজ্যের বাসিন্দা হিসাবে গর্ব বোধ করত তাদের দেশ আধা-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছিল এই ধারণা বদ্ধমূল হয়েছিল যে চীনের এই দুরাবস্থার জন্য, মর্যাদাহানির জন্য মাঞ্চু রাজবংশই দায়ী। তাই মাঞ্চু রাজারা যখন সংস্কারের মাধ্যমে রাজতন্ত্র কে শক্তিশালী করার চেষ্টা করছিল চিনা জনসাধারণ তখন মাঞ্চু রাজাদের ক্ষমতাচ্যুত করার চিন্তাভাবনা করছিল।
চিনা জনসাধারণ মনে করত যে, চিনে শাসনরত মাঞ্চু শাসকরা বিদেশি তার্তার বংশদ্ভূত। তাদের মতে দেশীয় মিং দের ক্ষমতাচ্যুত করে মাঞ্চু রাজারা ক্ষমতা দখল করেছে। তাই চীনে মাঞ্চু বিরোধী জাতীয়তাবাদ তৎপর ছিল। তাইপিং বিদ্রোহ এবং শ্বেতপদ্ম সমিতির কার্যকলাপে আমরা এই ভাবনার বহিঃপ্রকাশ লক্ষ্য করেছি।
1911 এর বিপ্লবের মানসিকতা গঠনে বিদেশি জাতীয়তাবাদের যথেষ্ট প্রভাব ছিল গ্রিসের স্বাধীনতা যুদ্ধ জুলাই বিপ্লব ফেব্রুয়ারি বিপ্লব জার্মানি ইতালির ঐক্য আন্দোলন 1871 এর প্যারি কমিউন প্রতিষ্ঠিত এই সমস্ত বহির্দেশীয় ঘটনা চীনাদের মধ্যে আধুনিক জাতীয়তাবাদী জাগরণ কে ত্বরান্বিত করেছিল এরপর 1905 সালে ক্ষুদ্র এশীয় শক্তি জাপানের হাতে বৃহৎ ইউরোপীয় শক্তি রাশিয়ার পড়াজয় এবং ওই বছরই রাশিয়ার নারদনিক আন্দোলন চিনা বিপ্লবীদের অনুপ্রাণিত করেছিল।
ডক্টর সান ইয়াৎ সেন চীনের মানুষকে বুঝিয়েছিলেন, বিগত দুই হাজার বছর ধরে চীনের ইতিহাস একই বৃত্তের আবর্তে ঘুরছে। এক রাজবংশ থেকে অপর রাজবংশ, মাঝখানে কেবল দু-একটা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ; ফলাফল একই-- সেই রাজতন্ত্র। বর্তমান প্রতিকূল পরিস্থিতি এবং সাম্রাজ্যবাদী শৃংখল এর বন্ধন থেকে মুক্ত করতে হলে শাসন ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটানো দরকার। একমাত্র প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠাই চীনের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে প্রতিফলিত করতে পারে।
বিদেশি উপনিবেশিকতার হাত ধরে চিনে একপ্রকার মুৎসুদ্দি শ্রেণীর আবির্ভাব ঘটেছিল। এরা ঔপনিবেশিক শাসনের পক্ষে কাজ করতো। কিন্তু উনিশ শতকের শেষ দিকে এবং বিশ শতকের সূচনায় কিছু চিনা মালিকানাধীন ভারী শিল্প গড়ে উঠেছিল। এজাতীয় পুঁজিপতিরা একটি জাতীয় সরকার গড়ে তুলতে চেয়েছিল এবং এরা সান ইয়াৎ সেনের প্রজাতন্ত্র গঠনের আহ্বান কে স্বাগত জানিয়েছিল।
শিল্পায়ন ও রেলপথ স্থাপনের ফলে যে শ্রমিকশ্রেণীর আবির্ভাব ঘটেছিল তারা গ্রামীণ জীবনে ব্যর্থ হয়েই শহরে এসেছিল। গ্রামীণ দুর্দশার ওরা ভুক্তভোগী, যার কারণ মূলত উপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদ ও মাঞ্চু শাসন। এরা শহরে এসে নিজেদের অবস্থার উন্নয়ন করতে পারেনি। এই এই ভবঘুরে জনতা যেকোন উপায়ে পরিস্থিতির পরিবর্তন চেয়েছিল এবং এরা সান ইয়াৎ সেনকে সমর্থন করেছিল।
মাও সে তুং থেকে শুরু করে প্রায় সকলেই স্বীকার করেছেন যে 1911 এর বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের রূপকার ছিলেন সান ইয়াৎ সেন। কৃষক পরিবারে তার জন্ম। সানের কাকা ছিলেন একজন তাইপিং বিদ্রোহী। তাই গুপ্ত সমিতির কার্যকলাপ সম্পর্কে তার ভালো জানা ছিল। 1894 খ্রিস্টাব্দে তিনি Revive China Society বা জিং জং খুই নামে একটি গুপ্ত সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন যার প্রধান কার্যালয় ছিল হংকং। 1895 খ্রিস্টাব্দে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের চেষ্টা ব্যর্থ হন এবং দেশ ত্যাগ করেন।
ইতিমধ্যে চীনের অনেকগুলি গুপ্ত সমিতি গড়ে উঠেছিল এবং বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, যেমন- জি পাও, সু পাও প্রভৃতি মাঞ্চু রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করতে সক্ষম হয়েছিল। সু পাও পত্রিকার সম্পাদক চীনা সম্রাটকে 'অল্পবয়সী ভাঁড়' বলে অভিহিত করেন। সম্পাদককে শাস্তির জন্য হাজিরা করানো হয়েছিল। এদিকে সান ইয়াৎ সেন টোকিও থেকে বিপ্লবী সংগঠন গুলিকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করছিলেন। 1905 খ্রিস্টাব্দে সান তার নতুন ঐক্যবদ্ধ বিপ্লবী সংগঠন তুং মেন হুই গঠন করেন।
তুং মেন হুই তৈরীর কিছু আগে সান ইয়াৎ সেন জনগণের তিনটি নীতি বা সান মিন চু আই ঘোষণা করেন। এই তিনটি নীতি হল: জাতীয়তাবাদ অর্থাৎ মাঞ্চু শাসনের বিরোধিতা করা; গণতন্ত্র অর্থাৎ প্রজাতান্ত্রিক সংবিধান রচনা করে সকল জনগণের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা এবং শাসন আইন ও বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ করা; সমাজতন্ত্র বা জন জীবিকা অর্থাৎ জমির মালিকানার ক্ষেত্রে সমতা প্রতিষ্ঠা করে সামন্ততান্ত্রিক এবং পুঁজিবাদের উত্থান রোধ করা। তুম মেরি এর মুখপত্র মিন বাও বা দ্যা পিপল পত্রিকায় এই তিনটি নীতির পরিপ্রেক্ষিতে বিপ্লবী বুদ্ধিজীবীগণ দলের কর্মসূচি ব্যাখ্যা করলেন। এই দলের স্লোগান ছিল "মাঞ্চুদের বিতাড়িত করো", "চীনকে পুনরুদ্ধার করো", "জমির মালিকানার ক্ষেত্রে সমতা প্রতিষ্ঠা করো" প্রভৃতি। ফরাসি বিপ্লবের আদর্শ সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতা নতুন সংগঠনের চালিকাশক্তি হবে তা জোরের সঙ্গে ঘোষণা করা হলো। সান ইয়াৎ সেন একটি ইশতেহার প্রকাশ করেন যেখানে ঘোষণা করা হয় বীরদের বিপ্লব অতীতে ঘটে গেছে, বর্তমানে আমাদের দরকার জনগণের বিপ্লব। তার এই ঘোষণা গনরাজনীতির পক্ষে সওয়াল।
সান ইয়াৎ সেনের আদর্শবাদে অনেক অসম্পূর্ণতা ছিল। তার আদর্শে তিনি সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা এবং সামন্ত বিরোধিতার মাত্রা যোগ করতে পারেননি। তা সত্বেও তার নিখাদ দেশপ্রেম ও অদম্য আশাবাদ সেই শূন্যস্থান পূরণ করেছিল। জ্যাঁ শ্যেনো তাই তাকে পেশাদার বিপ্লবী বলে আখ্যায়িত করেছেন। রেল ব্যবস্থার রাষ্ট্রায়ত্তকরণকে কেন্দ্র করে 10 ই অক্টোবর গণঅভ্যুত্থানের সূচনা হয়, যা ইতিহাস Double Ten Rising নামে পরিচিত। সান ইয়াৎ সেন ও তার দল প্রথম দিকে ইতস্তত করলেও শীঘ্রই পরিস্থিতি বুঝে বিপ্লবীদের সমর্থন আন্দোলনে নামেন। মাঞ্চু শাসনকর্তারা পলায়ন করে। উ চাঙ বিপ্লবীরা একে একে বিভিন্ন প্রদেশকে মাঞ্চু শাসন মুক্ত করতে সক্ষম হয়। 1912 খ্রিস্টাব্দের 1লা জানুয়ারি নানকিং এ মিলিত হয়ে বিপ্লবীরা একটি সমান্তরাল সরকার গঠন করে। সান ইয়াৎ সেন এই অস্থায়ী সরকারের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।
Thank you sir.
উত্তরমুছুন