দ্বিতীয় নগরায়ন
ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম নগরায়ন হয়েছিল হরপ্পা সভ্যতায়। হরপ্পার পতনের পর উপমহাদেশে বৈদিক আর্যরা গ্রামীণ সভ্যতার বিকাশ ঘটিয়েছিল। দ্বিতীয়বার নগরজীবনের আবির্ভাব হলো খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে। আলোচ্য পর্বে কৃষি শিল্প ও বাণিজ্যের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি উপমহাদেশের অর্থনীতিতে যে জোয়ার নিয়ে এসেছিল তার অন্যতম ফলশ্রুতি ছিল উপত্যকায় নগরায়নের আবির্ভাব।
সমসাময়িক লিখিত বিবরণ এবং প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে প্রাপ্ত উপাদানগুলি থেকে আমরা আলোচ্য পর্বে নগরায়নের নিয়মিত উপস্থিতি লক্ষ্য করি। পূর্ব পঞ্চম শতকে বৈয়াকরণিক পাণিনির রচনায় গ্রাম ও শহরের স্পষ্ট পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। মহাপরিনির্বাণ সূত্র থেকে জানা যায় বুদ্ধের সময় 60 টি নগর ছিল। এরমধ্যে 6 টি ছিল প্রধান। এগুলি হল বারানসী, কৌশাম্বী, চম্পা, শ্রাবস্তী রাজগৃহ ও কুশিনগর। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য কুশিনগর ছাড়া বাকি পাঁচটি কোনো-না-কোনো মহাজনপদের রাজধানীর ছিল।
বৌদ্ধ সাহিত্য নগর গুলির অভ্যন্তরীণ বৈশিষ্ট্যের বিবরণ আছে ছোট-বড়-মাঝারি নির্বিশেষে প্রত্যেক নগরের চারিদিকে বিশাল প্রাকার পরিখা থাকত। প্রতি নগরে প্রাসাদ, প্রশস্ত রাস্তা ঘাট, ব্যস্ত বিপনী এর লিখিত প্রমাণ পাওয়া গেছে। সাহিত্যগত তথ্য থেকে জানা যায় রাজা অমাত্য বণিক কারিগরদের কর্মব্যস্ত জীবন যাত্রার কথা। তবে নগর জীবনের খুঁটিনাটি বুঝতে হলে প্রথম তাত্ত্বিক সাক্ষ্যের ওপর নির্ভর করতে হয়। এরকম একটি প্রত্নক্ষেত্র হলো গঙ্গা-যমুনার অঞ্চলে অবস্থিত হস্তিনাপুর। মহাভারতের বর্ণনার সাথে এর মিল আছে। দোয়াব অঞ্চলের আরও একটি প্রসিদ্ধ প্রত্নক্ষেত্র হল অত্রঞ্জিখেরা। এখানে বুদ্ধের সময়কালে কৃষ্ণচিক্কন কৌলালের স্তরটি পাওয়া গেছে। এলাহাবাদের কৌশাম্বী, বারাণসীর রাজঘাট, মগধের রাজগীর, মধ্যপ্রদেশের এরান এবং অবন্তীর উজ্জয়িনীতে নগরায়নের প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য পাওয়া গেছে। গান্ধারের রাজধানী তক্ষশীলায় নগরসুলভ চরিত্র উদঘাটিত হয়েছে। দীর্ঘনিকায়তে পাটলিপুত্র কে পাটলিগ্রাম বলা হয়েছে; কারণ পাটলিপুত্র তখনও শহরে পরিণত হয়নি। এটি নদীর তীরে অবস্থিত একটি বাণিজ্য কেন্দ্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছিল এবং বুদ্ধ ভবিষ্যৎবাণী করেছিল যে এই বাণিজ্যকেন্দ্রটি একদিন শ্রেষ্ঠ নগরে পরিণত হবে। বিন্ধ্য পর্বতের দক্ষিনে বিস্তৃত এলাকায় লৌহ উপকরণের ব্যবহার থাকার সত্বেও সেখানে নগরায়নের বিকাশ সম্ভব হয়নি।
নগর গড়ে ওঠার পেছনে কৃষি অর্থনীতির সাফল্য অপরিহার্য। উদ্বৃত্ত উৎপাদন না হলে পরগাছা নগরের উদ্ভব হয় না তবে উদ্বৃত্ত উৎপাদন কিভাবে সম্ভব সে প্রসঙ্গে গর্ডন চাইল্ড বলেছেন, প্রযুক্তির অগ্রগতির সাহায্যে কৃষির উপকরণ গুলিতে ব্যাপক উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব হলেই উৎপাদন বাড়ে এবং উৎপাদনের উদ্বৃত্ত তৈরি হয়। এই উদ্বৃত্ত উৎপাদন নগরবাসীর মধ্যে বন্টনের জন্য আবার দরকার হয় একটি শক্তিশালী ও সক্রিয় প্রশাসন যন্ত্র।
ডিডি কোসাম্বি এবং রামশরণ শর্মা মধ্য গাঙ্গেয় নগরায়নের উদ্ভব ব্যাখ্যা করেছেন এইভাবে-- উপত্যকায় লোহার যন্ত্রপাতি, বিশেষ করে লাঙ্গলে লোহার ফলার ব্যবহার দিনের পর দিন বাড়তে থাকার ফলে এখানকার ঘন জঙ্গল কেটে পরিষ্কার করে ঘন আঠালো মাটি কর্ষণ করা সম্ভব হয়েছিল। ইতিপূর্বে তামার অস্ত্র দিয়ে তা সম্ভব ছিল না। এইভাবে উদ্বৃত্ত উৎপাদন নগরায়নের সূচনা করেছিল।
অন্যদিকে অমলানন্দ ঘোষ মনে করেন নগরায়নের পশ্চাতে ছিল খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ও সংগঠন। মহাজনপদ গুলির উত্থান এবং গণ রাজ্যগুলির পতন ঘটে রাজতন্ত্রের প্রসারের ফলে উদ্বৃত্ত উৎপাদন উৎপাদকের কাছ থেকে আহরণ করে পরগাছা সম্প্রদায়ের মধ্যে বন্টন করা সম্ভব হয়েছিল। উত্তর ভারতে এইরকম রাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ঘটেছিল বলে নগরায়ন সম্ভব হয়েছিল। দক্ষিণ ভারতে তাই রাজতন্ত্রের অনুপস্থিতির জন্য লোহার ব্যবহার সত্বেও নগরায়ন সম্ভব হয়নি।
দ্বিতীয় নগরায়ন কখনও কোথায় হয়েছিল?
উত্তরমুছুনদ্বিতীয় নগরায়ন এর উল্লেখযোগ্য নগর গুলি কী কী
উত্তরমুছুন