সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ঋক বৈদিক যুগের আর্যদের রাজনৈতিক পরিস্থিতি | Political Condition in Rigvedic Period

ঋক বৈদিক যুগের  আর্যদের রাজনৈতিক পরিস্থিতি

বৈদিক সাহিত্য প্রধানত ধর্মীয় সাহিত্য। তাই রাজনৈতিক জীবন সংক্রান্ত তথ্য এখানে খুবই কম। তবু এমন কিছু কথা, যেমন যুদ্ধে জয়লাভের বাসনা, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সম্পদ লুন্ঠনের আকাঙ্ক্ষা,দেবতার নিকট যুদ্ধ সংক্রান্ত প্রার্থনা প্রভৃতি থেকে রাজনৈতিক পরিস্থিতির একটা আভাস পাওয়া যায়।

ঋকবেদে জন, গণ, বিশ  এই তিনটি শব্দ বহুবার উল্লিখিত হয়েছে। এগুলি একটি জনগোষ্ঠীকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে। ঋকবেদের গ্রাম কেবল একটি গ্রামীণ জনবসতি নয়, একটি গ্রামীণ জনগোষ্ঠীও। রামশরণ শর্মা বলেছেন পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কহীন কয়েকটি পরিবারকে নিয়ে এক একটি গ্রামীণ জনগোষ্ঠী গড়ে উঠত। নৃতাত্ত্বিক পরিভাষায় এগুলিকে ব্যান্ড বলা হয়। গ্রামের চেয়ে বড়ো জনগোষ্ঠীকে জন, গণ বা বিশ শব্দ দিয়ে বোঝানো হয়েছে। আর.এস. শর্মা ও মাইকেল হিৎজেল ট্রাইব বা ক্ল্যান জাতীয় বা কৌম জাতীয় শব্দ সক্রিয় উপস্থিতি লক্ষ্য করেছেন। পাঁচটি কৌম নিয়ে গড়ে উঠেছিল পঞ্চজনা। ভরত নামক কৌমটি একাধিক যুদ্ধে জয়লাভের জন্য গুরুত্ব পেয়েছিল।


ঋকবেদে 'রাজা ' শব্দটি উপস্থিত থাকলেও সে যুগে রাজতন্ত্র গড়ে ওঠেনি। কারণ রাজার উপাধি ছিল বিশপতি বা গোপতি। এগুলি রাজতেন্ত্রর রাজার উপাধি হতে পারে না। রাজতেন্ত্রর প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্য - একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, শাসনাধীন প্রজাবৃন্দ, শাসক গোষ্ঠী,সেনাবাহিনী,রাজস্ব ব্যবস্থা- এসব কিছুই ছিল না। আসলে যে সমাজে স্থায়ী কৃষি ব্যবস্থা এবং উদ্বৃত্ত উৎপাদন ছিল না,গবাদি পশুই ছিল প্রধান সম্পত্তি সেখানে নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের উপর রাজার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার সম্ভাবনা খুবই কম। আসলে রাজা ছিল দলপতি। তার সঙ্গে গোষ্ঠীর অন্যান্যদের জ্ঞাতি  সম্পর্ক ছিল। রাজার কাজ ছিল যুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া, সম্পদ লুন্ঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করা এবং লুন্ঠিত সম্পদ সদস্যদের ভাগ করে দেওয়া।


ঋকবেদে বিদথ নামে এক প্রতিষ্ঠানের কথা আছে। শর্মা দেখিয়েছেন যে বিদথ ছিল জনগোষ্ঠীর সমাবেশ ও অধিবেশনের স্থান। এখানে রাজা এবং কৌমের সদস্য সকল উপস্থিত থাকতেন। যুদ্ধ এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক বিষয় এখানে আলোচনা হত। পাশাপাশি সামাজিক ক্রিয়াকলাপ এমনকি বিশ্রাম ও বিনোদন চলত। অর্থাৎ ঋকবেদে রাজা বিদথ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতেন কিছুটা। এছাড়া পুরোহিত সম্প্রদায় তার যাগযজ্ঞ বা ভবিষ্যদ্বাণীর জন্য রাজার সমীহ আদায় করে চলত।


যুদ্ধকে ঋকবেদে গাবিষ্টি বলা হয়েছে। অর্থাৎ যুদ্ধের মূল উদ্দেশ্য ছিল গবাদি পশু লুন্ঠন।
গবাদি পশু সম্বলিত সমাজ ব্যবস্থায় এই ধরনের আকাঙ্ক্ষা খুবই স্বাভাবিক। ঋকবেদে আর্যবর্ণ  এবং দস্যুবর্ণের মধ্যে লড়াইয়ের কথাও  আছে।


যে রাজনৈতিক ঘটনা সব কিছুকে ছাপিয়ে গেছে সেটা হল দশরাজার যুদ্ধ। তৃৎসু ভরতদের রাজা সুদাস তার পুরোহিত বিশ্বামিত্রকে অপসারণ করে বশিষ্ঠকে পুরোহিত নিযুক্ত করেন। ফলে ক্ষিপ্ত বিশ্বামিত্র দশটি কৌমের রাজাকে একত্রিত করে সুদাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লাগিয়ে দেন। এই যৌথ বাহিনী পুরুর নেতৃত্বে ভরত গোষ্ঠীর কাছে পরাজিত হয়।


ঋকবেদে রাজনৈতিক ক্ষমতা বৃদ্ধির আভাসও পাওয়া যায়। সুদাসের পিতা দিবোদাস উত্তর পশ্চিম প্রান্তীয় অঞ্চল থেকে উপমহাদেশের মূল ভূখণ্ডে ভরত গোষ্ঠীর আগমনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।  দশরাজার যুদ্ধ ভরত গোষ্ঠীর ক্ষমতা বিস্তারের পরিচয় দেয়। এই যুদ্ধেই রাজা সুদাস নদীবক্ষে বাঁধ জাতীয় একটা জলাধার বিদীর্ণ করেছিলেন। এটি কোশাম্বির মতে নদীর জলের ওপর রাজনৈতিক কর্তৃত্ব স্থাপনের অন্যতম নজির। ভরত গোষ্ঠীর রাজাদের বংশ পরম্পরায় উল্লেখ এবং শত্রুহন্তা হিসেবে চিহ্নিতকরণের মধ্য দিয়ে বেদের সূত্রাকারবৃন্দ ভরত গোষ্ঠীর ক্ষমতায়নের ইঙ্গিত দিয়েছেন।

Political Condition in the Rigvedic Period

Vedic literature is mainly religious literature. So the information regarding political life is very little here. Yet words like the desire to win the war, the desire to loot the wealth from the battlefield, the war-related prayers to the gods, etc. give an idea of the political situation.

In the Rigveda, the words "Jan" (people), "Gana" (group), and "Vish" (all) have been mentioned several times. These are used to convey the understanding of a community. The term "gram" in the Rigveda doesn't refer only to a village but also to a rural community. Scholars like Ramsharan Sharma suggest that several unrelated families came together to form a rural community, called a "band" in anthropological terms. Larger communities were denoted by the words "Jan," "Gana," or "Vish." R.S. Sharma and Michael Hwritzel noted the presence of tribal or clan-based and national or ethnic words. The five tribes mentioned in the Rigveda coalesced into the Panchajana. The tribe called Bharata gained significance for its victories in multiple wars.

Although the term "Raja" (king) is present in the Rigveda, monarchy did not emerge during this period. The king's title was often "Bhishpati" or "Gopati," and these titles did not necessarily signify a ruler in a monarchy. The essential features of a monarchy, such as a specific territory, a subject population, a ruling class, a military force, and a stable revenue system, were absent. In a society where stable agriculture and surplus production were lacking, the establishment of rulership over a defined territory was improbable. In reality, the king was more of a chieftain, responsible for leading in war, maintaining a prominent role in looting wealth, and distributing the spoils among the members of the looting party.

The term "Vidath" in the Rigveda refers to a gathering place. Sharma suggests that Vidath was the assembly and meeting place for the community, where both the king and members of the tribe were present. Discussions on war, various political matters, social activities, and entertainment took place in Vidath. In essence, the king had some control over Vidatha.

The Rigveda uses the term "Gabhasti" to describe war, indicating that the primary purpose of war was looting cattle. The desire to loot wealth in a society based on cattle farming was quite natural. The Rigveda also mentions conflicts between the Aryas and Dasyus.

One significant political event recorded in the Rigveda is the Battle of the Ten Kings (Dasarajna). King Sudas of the Trtsu Bharata, after dismissing his priest Vishvamitra, appointed Vasishtha as his priest. This led to a coalition of ten kings, led by Vishvamitra, waging war against Sudas. In this joint military campaign, the Bharatas defeated the group of kings.

The Rigveda also conveys a sense of political expansion. Sudas' father Divadasa, hailing from the northwestern region, expanded Bharata tribal influence into the upper region of the subcontinent. The construction of a dam on the river Parushni by Sudas, resulting in the destruction of the dam by the neighboring Vedic tribe known as the Koshas, is symbolically significant for the establishment of political authority over a river's waters.

In summary, the Rigveda provides glimpses of political aspects such as community gatherings, the king's role in war and wealth distribution, discussions in Vidath, the purpose of war, conflicts between Aryas and Dasyus, and significant political events like the Battle of the Ten Kings.


Thanks for reading.

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য Please visit our Homepage and subscribe us. Suggested Topics || Ghajnavid Invasion || গজনী আক্রমণ || || মামুদের সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন || Somnath Temple Plunder || || তরাইনের যুদ্ধ ও তার গুরুত্ত্ব || মহম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমন ও তার চরিত্র || সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আ

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগার:-   কোনো ব্যাক্তিগত বা অলাভজনক

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল তা জনজীবনে তীব্রভ