হরপ্পা বহির্ভূত তাম্রাশ্মীয় সংস্কৃতি
কায়থা সংস্কৃতি
ভারতীয় উপমহাদেশের তাম্র প্রস্তর যুগের সংস্কৃতির সর্বাধিক অগ্রগতি ঘটেছিল সিন্ধু উপত্যকা এবং তার আশেপাশের অঞ্চলে। তবে হরপ্পা সভ্যতার বৃত্তের বাইরে ভারতবর্ষের অন্যান্য কয়েকটি অঞ্চলে সমকালীন যুগেই স্বতন্ত্র তাম্র প্রস্তর যুগীয় সংস্কৃতির উদ্ভব ঘটেছিল। যদিও নগরায়নের ধারা এই অঞ্চল গুলিকে স্পর্শ করেনি। এ রকমই একটি সংস্কৃতি হল মালবের কায়থা সংস্কৃতি।
দক্ষিণ-পূর্ব রাজস্থানের বৃহত্তর এলাকা জুড়ে অবস্থিত উপত্যকা। প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের ফলে এখানে একশোরও বেশি প্রাগৈতিহাসিক গ্রামীণ কেন্দ্রে পাওয়া গেছে। এগুলোর মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য হল কায়থা ও নভদাতলি। কায়থাকে কেন্দ্র করে এই সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল বলে একে কায়থা সংস্কৃতিও বলা হয়। কায়থা সংস্কৃতির সময়কাল 2400থেকে1800 খ্রিঃপূঃ।
কায়থা সংস্কৃতির প্রধান অঙ্গ মৃৎপাত্র। হাতে তৈরি মৃৎপাত্র যেমন আছে তেমনি আছে কুমোরের চাকায় তৈরি পাত্র। এগুলির মধ্যে বেশিরভাগই রঙিন ও নকশা কাটা। হালকা লাল বেগুনি রংয়ের মৃৎপাত্র পাওয়া গেছে। বহুল পরিমাণে তামার পণ্য সামগ্রীও প্রত্নক্ষেত্রগুলি থেকে পাওয়া গেছে; যেমন- তামার বল, তামার কুঠার ,বাটালি প্রভৃতি। বহু ক্ষুদ্রাশ্মীয় আয়ুধ এবং পুঁতি পাওয়া গেছে। পুঁতিগুলি সম্ভবত হরপ্পা সভ্যতার কোন কেন্দ্র থেকে আমদানি করা হত। অর্থাৎ এরা বাণিজ্যও করত।
মালওয়া সংস্কৃতি
উপমহাদেশে তাম্র প্রস্তর যুগের সংস্কৃতি উৎকৃষ্ট পরিচয় পাওয়া যাবে হরপ্পা সভ্যতায়। তবে হরপ্পার বৃত্তের বাইরে ভারতের অন্যান্য কয়েকটি অঞ্চলে ওই সময়কালেই তাম্র প্রস্তর সংস্কৃতির উদ্ভব ঘটেছিল। হরপ্পা বহির্ভূত এরকমই একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কৃতি হল মালওয়া সংস্কৃতি।
মধ্যপ্রদেশের পশ্চিমাংশ এবং মহারাষ্ট্রের বিশাল এলাকা মালওয়া সংস্কৃতির সীমানার মধ্যে পড়ে। এই সংস্কৃতির সময়কাল দ্বিতীয় সহস্রাব্দের সূচনার মাঝামাঝি পর্যন্ত। এখানকার বাড়িগুলি মাটি ও গাছপালা দিয়ে তৈরি চৌকো বা গোলাকার হত। খড় বা ঐ জাতীয় জিনিস দিয়ে এর ছাউনি হত। বাড়ির দেওয়ালে চুন লেপা থাকত। ছোট ছোট গোলাকার বাড়িগুলি সম্ভবত শস্যগোলা হিসেবে ব্যবহৃত হত। ইনামগাঁও-এ একটি ঘর পাওয়া গেছে যা দেখতে অনেকটা মন্দিরের মতো এবং এর মধ্যে একটি অগ্নিকুণ্ড কয়েকটি পোড়া শস্যদানা পাওয়া গেছে।
মলওয়া সংস্কৃতি ছিল কৃষিনির্ভর। এখানে ধান, গম ও তৈলবীজের অবশেষে পাওয়া গেছে। কার্পাসের চাষ হত বলে অনেকে মনে করেন কারণ এখানে সুতো তৈরীর জন্য পোড়ামাটির তকলি পাওয়া গেছে। এখানকার মৃৎপাত্রগুলি উল্লেখের দাবি রাখে। রঙে, চিত্রনে এবং জ্যামিতিক রেখায় এগুলি ছিল আকর্ষণীয়। তামার ব্যবহার খুব বেশি ছিল না। পাথরের ব্যবহার নিয়মিত চলত। এরা সম্ভবত লিঙ্গপূজা ও ষাঁড়পূজা করত।
জোরওয়ে সংস্কৃতি
মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলে পরবর্তী তাম্র প্রস্তর যুগীয় সংস্কৃতির সন্ধান পাওয়া যায়। এখানকার প্রত্ন ক্ষেত্র গুলি হল আহম্মদনগর জেলার জোরওয়ে, নেভাসা, দৈমাবাদ; পুনা জেলার ইনামগাঁও, সোনাগাঁও, চাঁদলি এবং নাসিক। জোরওয়ে ছিল এগুলির মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। রেডিও কার্বন ডেটিং অনুসারে এই সময়কাল মালওয়া সংস্কৃতির পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ 1400 খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে 1100 খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত।
এখানকার বাড়িগুলি কাঠের খুঁটির কাঠামোর ওপর শক্ত করে মেঝে বানিয়ে তৈরি হত। মালওয়া সংস্কৃতির মতই এখানেও বাড়িগুলির মাটির দেওয়ালে চুন লেপা থাকতো। পাথর ও তামা উভয়ের ব্যবহার তারা করত। চ্যালসিডনি পাথরের কাস্তে এইখান থেকে পাওয়া গেছে। এছাড়া হাতুড়ি, পালিশ করা কুঠার, বাটালি ও বড়শির ব্যবহার ছিল। এরা ধান, গম বার্লি এবং ডাল চাষ করত বলে জানা যায়। আরও জানা যায় এরা বাঁধ দিয়ে বন্যার জলকে চাষের কাজে লাগাত।
এদের মৃতপাত্র উল্লেখের দাবি রাখে। উজ্জ্বল ও মসৃণ কালো নকশাকাটা লাল-কমলা এবং ধূসর রঙের মৃৎপাত্রের অবশেষ এখান থেকে পাওয়া গেছে। এখানকার মানুষ কাপড় বোনার কৌশল আয়ত্ত করেছিল। কার্পাস ও পশম বস্ত্রের সন্ধান এখান থেকে পাওয়া গেছে। এরা মাতৃদেবীর পূজা করত যা কৃষিজীবী সমাজের সঙ্গে বেশ মানানসই। মৃত্যু সম্পর্কে এদের সুনির্দিষ্ট চিন্তা ভাবনা ছিল। মৃতকে উত্তর-দক্ষিণে শায়িত করে কবর দেওয়া হত এবং কবরের ভিতর নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দিয়ে দেওয়া হত। মৃত ব্যক্তির প্রেতাত্মাকে নিষ্ক্রিয় করার জন্য কবর দেওয়ার আগে মৃতদেহের গোড়ালির নিচের অংশ কেটে নেওয়া হত।
সিমেট্রি এইচ(H) সংস্কৃতি
হরপ্পা সভ্যতার পরবর্তী স্তরে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে তাম্র প্রস্তর যুগীয় সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়েছিল এবং বিভিন্ন অঞ্চলে এর আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল ভিন্ন ভিন্ন ভাবে। হরপ্পার উত্তরাধিকারী সংস্কৃতি হিসেবে গড়ে উঠেছিল সিমেট্রি এইচ(H) কালচার। হরপ্পা ও বাহাওয়ালপুর জেলার বিভিন্ন এলাকায় এই সংস্কৃতির উন্মেষ ঘটেছিল। এই সংস্কৃতির প্রথম নিদর্শন এইচ নম্বর সমাধি ক্ষেত্রে পাওয়া গেছিল বলে এর এরূপ নামকরণ হয়েছে।
এখানকার মানুষ পোড়া ইটের ছোট ছোট বাড়ি তৈরি করত। হরপ্পা সভ্যতার উন্নত হস্তশিল্প, পণ্য সামগ্রী এবং লিপির লেশমাত্র এখানে পাওয়া যায় না। এখানে ধান ও গম চাষ হত বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। তামার ব্যবহার তাদের জানা ছিল। মাটির পাত্র গুলো ছিল লাল রঙের। সমাধি নির্মাণে এদের উপর হরপ্পার প্রভাব ছিল। প্রথমদিকে দেহগুলোকে শায়িত করে কবর দেওয়া হত। পরে দেহের অস্থি সমূহের ভগ্নাংশ সমাধিস্থ করা হত।
Thanks for reading.
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন