তাইপিং বিদ্রোহের কারন ও পটভূমি
উনিশ শতকের মধ্যভাগে মাঞ্চু সরকার যে কেবল বিদেশী সুযোগসন্ধানী ও আমন্ত্রণকারী হাতে বিপন্ন হয়েছিল তা নয়, দেশের অভ্যন্তরে নানা বিদ্রোহের ফলে গুরুতর সংকটের মুখে পড়েছিল ।এসব অভ্যন্তরীন বিদ্রোহের প্রকৃত কারণ ছিল দুর্ভিক্ষ এবং সামন্ততান্ত্রিক ও ঔপনিবেশিক শাসনের ফলে জনগণের চরম দুর্দশা। চল্লিশের দশক থেকে চিনে একাধিক ছোট খাটো বিদ্রোহ হলেও ১৮৫০ থেকে বড় মাপের বিদ্রোহ দেখা দিতে থাকে। এগুলির মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক বিদ্রোহ ছিল তাইপিং বিদ্রোহ (1850-64)।
মাঞ্চু শাসনে চীনের জনসংখ্যা দ্রুত হারে বৃদ্ধি পেয়েছিল, কিন্তু সেই অনুপাতে চাষযোগ্য জমির পরিমান বাড়েনি। ফলত সাধারণভাবেই মাথাপিছু জমির পরিমাণ কমে যায়। একে ছোট জমি, তার ওপর ছিল সুদখোর মহাজন, জমিদার ও অসৎ ব্যবসায়ীদের কার্যকলাপ। এই প্রেক্ষিতে জমির মালিকানা ক্রমশ অল্প সংখ্যক ধনী মানুষের হাতে সীমিত হচ্ছিল এবং বাড়ছিল ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা। এদিকে শিল্প না হওয়ার কারণে গ্রাম ছেড়ে রোজগারের আশায় শহরে আগত ভূমিহীন কৃষকদের কর্মসংস্থান হয়নি। দু'চারটে কুলি মজুর ছাড়া বেশির ভাগ মানুষই বেকার অথবা সমাজ বিরোধী তে পরিণত হয়েছিল।
বেআইনি আফিমের ক্রমবর্ধমান চালান চিনা অর্থনীতির সাংঘাতিক ক্ষতি করেছিল। ১৮৪০ - ৫০ এর মধ্যে গড়ে প্রতি বছরে ২০ থেকে ২৩ লক্ষ টেইল মূল্যের রুপো বিদেশে চলে যেতে থাকে। এর ফলে রুপোর মুদ্রা ও তামার মুদ্রার বিনিময় মূল্যে বিরাট পার্থক্য দেখা যায়। উনিশ শতকের গোড়ায় টেইলের বিনিময় ছিল ১০০০ তাম্রমুদ্রা। ১৮৫০ এ গিয়ে তা হয় ২২০০ থেকে ২৩০০ তাম্রমুদ্রা। এর ফলে করের হার অপরিবর্তিত থাকলেও করের বোঝা বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়, যার সরাসরি প্রভাব গিয়ে পড়ে কৃষক ও কারিগর দের ওপর। এর ফলে করদাতাদের ওপর রাজকর্মচারীদের নিগ্রহের ঘটনা অহরহ ঘটতে থাকে।
আফিম যুদ্ধে পরাজয়জনিত সন্ধি গুলির ফলের চীন তার বন্দরগুলি হারায় এবং আমদানি বাণিজ্যের ওপর শুল্ক বৃদ্ধির ক্ষমতা হারায়। ফলে বাজার বিদেশি পণ্যে ছেয়ে যায়। ১৮৪২ এ ব্রিটেন থেকে আমদানিকৃত পণ্যমূল্য ছিল প্রায় ৯.৬৫ লক্ষ। ১৮৪৫ গিয়ে তা দাঁড়ায় প্রায় ২৪ লক্ষ পাউন্ড। ক্রমবর্ধমান বিদেশী পণ্যের চাপে চিনা রেশম শিল্পসহ দেশীয় হস্তশিল্পের বিনাশ হতে থাকে।
অর্থনৈতিক দুর্গতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল প্রাকৃতিক বিপর্যয়। বন্যা, দুর্ভিক্ষ ও খরার ফলে জনজীবন হয়েছিল আরও বিপন্ন। ১৮৪০ এর দশকের শেষদিকে চীনে কতগুলি মারাত্মক দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল।
তাইপিং বিদ্রোহের অন্যতম কারণ ছিল দুর্বল ও দুর্নীতিগ্রস্ত মাঞ্চু শাসন। দেশের এই কঠিন পরিস্থিতিতে মাঞ্চু শাসক ও কর্মচারীরা সততার সঙ্গে দেশরক্ষার বদলে আপন স্বার্থরক্ষায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। অন্যদিকে কিছু সংখ্যক যে সৎ কর্মচারী ছিল তারা আধ্যাত্মিকতা ও দর্শনচর্চায় মনোনিবেশ করেছিলেন।
মাঞ্চু সামরিক ব্যবস্থাতে দেখা দিয়েছিল চরম অবনতি। পাশ্চাত্য দেশগুলোর সাথে শক্তিপরিক্ষায় বারংবার পরাজয় সত্বেও সেনাবাহিনীকে আধুনিক করে গড়ে তোলার কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এদিকে যেমন বারবার পরাজয়ের ফলে মাঞ্চু সামরিক বাহিনীর মনোবল ভেঙে গেছিলো তেমন অন্যদিকে তেমন জনগণের মধ্যে থেকে মাঞ্চু শাসনের ভয় উধাও হয়ে যাচ্ছিল।
তাইপিং বিদ্রোহের সূচনা হয়েছিল দক্ষিণ চীনে। দক্ষিণ চীনের বিশেষ পরিস্থিতি বিদ্রোহের উত্থানে সহায়ক হয়েছিল। পিকিং থেকে বহু দূরে অবস্থিত দক্ষিণ চীনে মাঞ্চু শাসনের নিয়ন্ত্রণ তেমন কিছু ছিল না। কিন্তু ইউরোপীয়দের দীর্ঘদিনের বসবাসের ফলে এই অঞ্চলে পশ্চিমাদের বিশেষ করে খ্রিস্টান মিশনারীদের প্রভাব ভালোই ছিল। তার ওপর এই অঞ্চলে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে ছোটখাটো সংঘাত লেগেই থাকত। হাক্কা এবং বেন্ডি এই দুই গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষ লেগেই ছিল। হাক্কারা তাইপিং বিদ্রোহে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল। এদের পরিশ্রমী, সাহসী ও স্বাধীনতাপ্রিয়তা তাদের বিদ্রোহে অংশগ্রহনে প্রনোদিত করেছিল।
Thank you sir
উত্তরমুছুন