সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

1857 এর বিদ্রোহের চরিত্র

1857 এর বিদ্রোহের চরিত্র

1857-র বিদ্রোহ ভারতের ঔপনিবেশিক শাসনের ইতিহাসে এক জলবিভাজিকা স্বরূপ। পূর্ববর্তী বিদ্রোহ গুলির তুলনায় আকার আয়তনে এই বিদ্রোহ ছিল ব্যাপকতর। বিদ্রোহের ব্যাপকতা ও গুরুত্ব নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে সন্দেহ নেই কিন্তু এর প্রকৃত চরিত্র উদঘাটন করতে গিয়ে প্রায় বিদ্রোহের সমসাময়িক কাল থেকেই বিতর্কের সূচনা হয়েছে। বিতর্কের তিনটি দিক 1. এই বিদ্রোহ কেবল সিপাহী বিদ্রোহ না গণবিদ্রোহ? 2. এই বিদ্রোহ কি সামন্ত শ্রেণীর প্রতিক্রিয়া? 3. এই বিদ্রোহকে জাতীয় সংগ্রাম বলা যায় কিনা?

সমসাময়িক ইংরেজ চার্লস রেইকস তাঁর Notes on the Revolt in North Western Province of India গ্রন্থে 1857 এর বিদ্রোহকে সিপাহী বিদ্রোহ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। সমসাময়িক বেশ কিছু ভারতীয় একই রকম মত পোষণ করেছেন। কিশোরী চাঁদ মিত্র এই বিদ্রোহ গণবিদ্রোহের ছিটেফোটাও লক্ষ্য করতে পারেননি শম্ভুচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এবং হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় লেখাতেও একই রকম কথা উঠে এসেছে। একথা ঠিক যে বিদ্রোহের সূচনা হয়েছিল ভারতে ব্রিটিশ আর্মির ভারতীয় সৈনিকদের দ্বারা। তবে পরবর্তীকালে কৃষক কারিগর এবং সাধারণ মানুষ এই বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য সৈনিকদের বড় অংশই এসেছিল কৃষক পরিবার থেকে তাই অনেক ক্ষেত্রেই তাদের 'উর্দিপরা কৃষক' বলা হত। আরেক সমসাময়িক ইংরেজ জে বি নর্টন তাঁর Topics for Indian Statesman এ লিখেছিলেন এটি কোন সামান্য সিপাহী বিদ্রোহ ছিল না, এই বিদ্রোহ গণবিদ্রোহের রূপ নিয়েছিল। বিদ্রোহ কেবল অযোধ্যাতে সীমাবদ্ধ ছিল না উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং মধ্য ভারতজুড়ে এই বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়েছিল এবং বৃটিশ সরকারকে বিদ্রোহ দমন করতে প্রায় এক বছর ধরে সামরিক অভিযান পরিচালনা করতে হয়েছিল। এর থেকেই এই বিদ্রোহের বিপুল গণভিত্তি প্রমাণিত হয়।

কেমব্রিজ ঐতিহাসিক এরিক স্টোকস ১৮৫৭ এর বিদ্রোহকে গ্রামীণ ভূস্বামী, সামন্ত প্রভু এবং তার অনুচরদের দ্বারা সংঘটিত বিদ্রোহ বলে মনে করেন। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার এই বিদ্রোহকে 'সামন্ত শ্রেণীর শেষ আর্তনাদ' বলে অভিহিত করেছেন। ইন্দ্রনাথ সেন লিখেছেন বিদ্রোহীরা কালের চাকাকে পিছনে ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। এদের লক্ষ্য ছিল প্রতিবিপ্লব। একথা ঠিক যে 19 শতকের মধ্যে লগ্নে ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থায় সামন্ততান্ত্রিক উপাদান অত্যন্ত সক্রিয় ছিল এবং সামন্ততান্ত্রিক পরিবেশেই বিদ্রোহের সূচনা হয়েছিল। বেশকিছু সামন্ত প্রভু বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়েছিল, বিদ্রোহীদের ঐক্যবদ্ধ করেছিল। তবে সকল সামন্ত প্রভু যে বিদ্রোহীদের পক্ষে ছিল এমনটা নয় অনেকেই বিদ্রোহ দমনে ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে কাজ করেছিল। প্রকৃতপক্ষে ইংরেজি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় সে যুগে বিদ্রোহীদের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন ছিলেন না। তাই সহজেই বিদ্রোহের নেতৃত্ব সামন্ত শক্তির হাতে চলে গেছিল। কিন্তু একটি বিদেশি শাসন বিরোধী লড়াই কখনো সামন্ততান্ত্রিক লড়াই হতে পারেনা।

কাল মার্কস তার নিউইয়র্ক ডেইলি ট্রিবিউন পত্রিকায় 1857 এর বিদ্রোহকে "ভারতবর্ষের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম" বলে উল্লেখ করেছেন। এদিকে বিনায়ক দামোদর সাভারকার 1857 বিদ্রোহকে ভারতের জাতীয় সংগ্রাম বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু রমেশচন্দ্র মজুমদার মনে করেন ভারতীয়দের জাতীয়তাবাদী চেতনার তখন 'ভ্রূণ অবস্থা'। সুতরাং সেখানে কোনো জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম গড়ে উঠতে পারে না। তিনি আরো বলেছেন বিদ্রোহের মধ্যে কোন কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা, নির্দিষ্ট কর্মপদ্ধতি ও সংগঠন ছিল না। নেতারা ব্যক্তিগত আশা-আকাঙ্ক্ষার দ্বারা পরিচালিত হয়েছিলেন। সর্বভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গি এদের মধ্যে গড়ে ওঠেনি। সেদিনের রণাঙ্গন ছিল সীমাবদ্ধ, দেশবাসীর বিরাট অংশ ছিল নিষ্ক্রিয়। একথা ঠিক যে 19 শতকের মাঝামাঝি ভারতবর্ষে  জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার মতো আধুনিক আদর্শ গুলির সঙ্গে পরিচিত ছিল না। বিদ্রোহীদের যথার্থ পরিকল্পনা ও যোগ্য নেতৃত্বের অভাব ছিল কিন্তু এটাও ঠিক যে দেশের বিভিন্ন অংশে বিদেশি শাসনের বিরুদ্ধে হিন্দু মুসলিম জনতা ঐক্যবদ্ধ ভাবে লড়াই করেছিল, যা পরবর্তীকালে জাতীয় আন্দোলনেও লক্ষ্য করা যায় না।

সব দিক থেকে বিচার করলে 1857 বিদ্রোহ কে যেমন সামন্ততান্ত্রিক বিদ্রোহ বলা যায় না তেমনি স্বাধীনতা সংগ্রামে বলা যায় না। এই বিদ্রোহ ছিল ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে হিন্দু-মুসলিম জনতার ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ।

Thanks for reading.

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য Please visit our Homepage and subscribe us. Suggested Topics || Ghajnavid Invasion || গজনী আক্রমণ || || মামুদের সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন || Somnath Temple Plunder || || তরাইনের যুদ্ধ ও তার গুরুত্ত্ব || মহম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমন ও তার চরিত্র || সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আ...

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগ...

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হ...