সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

বাংলায় অর্থনৈতিক নিষ্ক্রমণ (1757-1857)

বাংলায় অর্থনৈতিক নিষ্ক্রমণ (1757-1857)

বাংলায় ঔপনিবেশিক শাসনের অনিবার্য পরিণতি ছিল সম্পদ নিষ্কাশন। 1757 খ্রিস্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধে বাংলার স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজিত করে মিরোজাফরকে নবাব করার মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার মসনদের উপর পরোক্ষ কর্তৃত্ব কায়েম করেছিল। রাজনৈতিক প্রভাবের সুবিধা নিয়ে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও তার কর্মচারীরা নানা অসৎ উপায় প্রচুর সম্পদ অর্জন করেছিল এবং সেগুলি স্বদেশে চালান করেছিল। বাংলা থেকে এইভাবে একমুখী সম্পদ নিষ্কাশনের ঘটনাকে ঐতিহাসিকরা 'পলাশীর লুণ্ঠন' বলেও উল্লেখ করেছেন।

সম্পদ লুণ্ঠন মূলত দুটি ধারায় চলেছিল: 1. কোম্পানি অনুসৃত আর্থিক ও বাণিজ্যিক নীতি এবং 2. কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্য।

ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পলাশীর আগে এদেশ থেকে পণ্য ক্রয় করার জন্য ইংল্যান্ড থেকে বুলিয়ন নিয়ে আসত। কিন্তু পলাশী ও বক্সারের যুদ্ধে জয়লাভের পর 1765 খ্রিস্টাব্দে দেওয়ানির অধিকার হাতে আসার ফলে এদেশ থেকে পণ্য কেনার জন্য আর বুলিয়ন আনার প্রয়োজন হত না। বাংলার রাজস্বের টাকায় পণ্য কেনা শুরু হয়। এমনকি চীনে পণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রেও এই অর্থ ব্যবহৃত হতে থাকে। ফলে বুলিয়ান আমদানি কেবল বন্ধই হয় না, বাংলার রাজস্বের টাকা যা বাংলার উন্নয়নের খাতে খরচ করার কথা তা বিভিন্ন পথে ইংল্যান্ডে চলে যেতে থাকে। এছাড়াও বাংলা রাজস্বের টাকা বম্বে ও মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির প্রশাসনিক ব্যয় নির্বাহ এবং কোম্পানির সাম্রাজ্য বিস্তারের কাজে লাগানো হতো।

পলাশী পরবর্তী বাংলায় ইংরেজরা কিংমেকার এর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। ফলে নবাব বদলের ব্যবসা করে ইংরেজ কর্মচারীরা প্রচুর টাকা উপঢৌকন পরিতোষক এবং নাজরানা আদায় মারফত লাভ করেছিল। এইভাবে অর্থ উপার্জনে রবার্ট ক্লাইভের নাম বিশেষ উল্লেখ যোগ্য।

ইংরেজ কর্মচারীরা ব্যক্তিগত বাণিজ্যের মাধ্যমে প্রচুর মুনাফা অর্জন করত। বেশ কিছু অত্যাবশ্যক পণ্যের ব্যবসা করে বারওয়েল মোট 80 লক্ষ টাকা কামিয়ে ছিলেন। ওয়ারেন হেস্টিংস বাংলার গভর্নর থাকাকালীন অবৈধ চুক্তির মাধ্যমে তার প্রিয় পাত্রদের বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জনের পথ প্রশস্ত করে দিয়েছিলেন বাঁধ নির্মাণ বা আফিম, ঘোড়া, সামরিক সম্ভার প্রভৃতি পণ্যের সরবরাহ করার বরাত ঘুষ নিয়ে বেআইনিভাবে দিতেন। এই সমস্ত এজেন্টরা আবার দেশীয় উৎপাদকদের কাছ থেকে পণ্য কেনার সময় সেলামি আদায় করতেন।

উপরোক্ত উপায়ে অর্জিত সম্পদ স্বদেশে পাঠানোর একটা সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল। প্রথমদিকে মূল্যবান পাথর বা হিরে কিনে দেশে পাঠাতো। আর কোম্পানির তহবিলে জমা রেখে দেশে ফিরে গিয়ে তারা বিল অফ এক্সচেঞ্জ ভাঙিয়ে সেই টাকা তুলে নিতে পারত। কিন্তু এতে বিনিময় হার কেমন লাভজনক হত না এবং এই বিপুল সম্পদের উৎস সম্পর্কে কোম্পানির পরিচালক সভার মনে সন্দেহ সৃষ্টি হত। এই সমস্যার সমাধানের জন্য তারা ওলন্দাজ দিনেমার প্রভৃতি বণিকদের মাধ্যমে তারা সঞ্চিত সম্পদ দেশে পাঠাতে শুরু করে। ফলে এই ওলন্দাজ ও দিনেমার বণিকরা এইসব কর্মচারীদের দেওয়া অর্থ দিয়েই ভারত থেকে পণ্য কিনতে শুরু করে; দেশ থেকে বুলিয়ন আনা বন্ধ করে দেয়। ফলে ভারতীয় পণ্য কার্যত বিনামূল্যেই দেশের বাইরে চলে যেতে থাকে।

যদিও কোন কোন পন্ডিত যেমন থিওডোর মরিসন, পি জে মার্শাল প্রমুখরা একতরফা সম্পদ নিষ্কাশন এর বিষয়টিকে অস্বীকার করেছেন। তাদের মতে এই অর্থের পরিবর্তে বাংলা পেয়েছিল বিভিন্ন রকম সেবা যেমন বীমা, ব্যাংক, এজেন্সি হাউস, জাহাজ শিল্প, পাশ্চাত্য প্রযুক্তি প্রভৃতি। সুতরাং বাংলা একতরফাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, লাভবানও হয়েছিল। অন্যদিকে জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকগণ ও মার্শালের বক্তব্যকে অস্বীকার করেছেন এবং সাম্রাজ্যবাদী শোষণকে আড়াল করার কৌশল হিসেবে দেখেছেন। তাদের মতে প্রকৃতপক্ষে সম্পদ নিষ্কাশন এত প্রবল হয়েছিল যে কোন সম্পদশালী দেশ দরিদ্র দেশে পরিণত হতো।


Thanks for reading.

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগ...

আরবদের সিন্ধু অভিযানঃ প্রত্যক্ষ কারণ ও তাৎপর্য | Arab Conquest of Sindh: Immediate Causes and Significance

আরবদের সিন্ধু অভিযানঃ প্রত্যক্ষ কারণ ও তাৎপর্য সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আগেও বহুবার ভারতের বিভিন্ন জায়গায় অভিযান পাঠানো হয়েছিল। তবে এই(712 খৃ:) অভিযানের একটি প্রত্যক্ষ কারণ ছিল। জানা যায় যে সিংহলের রাজা ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ কে কয়েকটি জাহাজে করে উপঢৌকন পাঠাচ্ছিলেন কিন্তু পথে সিন্ধু দেশের জলদস্যুরা দেবল বন্দরে এ...

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হ...