সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

প্রাচীন ভারতের ইতিহাস পুনর্নির্মাণে ধর্মনিরপেক্ষ সাহিত্য | Non-Religious Literature in Reconstructing the Ancient Indian History

প্রাচীন ভারতের ইতিহাস পুনর্নির্মাণে ধর্মনিরপেক্ষ সাহিত্য

ভারতের প্রাচীন ঐতিহ্য ধর্মের সঙ্গে গাঁথা হলেও ধর্ম নিরপেক্ষ বহু সাহিত্য সেকালে রচিত হয়েছিল। এগুলি ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে খুবই উল্লেখযোগ্য উপাদান।

ধর্মনিরপেক্ষ সাহিত্য গুলির মধ্যে প্রথমে অর্থশাস্ত্রের কথা বলতে হয়। রাজ্য শাসন ও আর্থিক ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করাই অর্থশাস্ত্রের মূল উপজীব্য। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র থেকে মৌর্য রাজত্বকালের বিশেষ করে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের শাসনকাল এর ইতিহাসের বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়। যদিও এগুলি সবই উপদেশমূলক। তাই বাস্তবে কতটা তা মানা হতো তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য কামন্দকের নীতিসার এবং নীতিবাক্যমৃত কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রেরই সংক্ষিপ্তসার।

কোনও বিখ্যাত শাসক সম্পর্কে তার সভাকবি কর্তৃক প্রশস্তি মূলক জীবনী রচনা প্রচলন প্রাচীনকালে শুরু হয়েছিল। যেমন হর্ষবর্ধনের সভাকবি বানভট্ট লিখেছিলেন হর্ষচরিত। চালুক্য রাজা ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্যর সভ্যাকবি রচনা করেছিলেন বিক্রমাঙ্কদেবচরিত। রামপালের সভাকবি সন্ধ্যাকর নন্দী দ্বর্থক ভাষায় রচনা করেন রামচরিত, যেখানে একই সাথে ভগবান রামচন্দ্র এবং পাল রাজা রামপালের জীবনচরিত বর্ণিত হয়েছে। এই গ্রন্থগুলির একটি বড় সমস্যা হচ্ছে এগুলি প্রশস্তিমূলক। তাই এক্ষেত্রে স্বজনপোষণ, তথ্যগোপন এবং অতিরঞ্জনের সম্ভাবনা প্রবল থাকে। তাই এইগুলি থেকে তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক কে অতিরিক্ত যত্নবান হতে হয়।

ভারতবর্ষে ইতিহাসাশ্রয়ী রচনার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হল কলহনের রাজতরঙ্গিনী। এটি একটি স্থানীয় ইতিবৃত্ত। এই গ্রন্থে সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত লেখক এক তথ্যনিষ্ঠ নিরপেক্ষ ইতিহাস উপহার দিয়েছেন। তবে প্রাক সপ্তম শতকের বর্ণনায় তিনি কিছুটা গল্প কাহিনী ও জনশ্রুতির ওপর নির্ভর করেছেন।

বেশকিছু সৃজনশীল সাহিত্য প্রাচীনকালে লেখা হয়েছিল। এখানে ঐতিহাসিক ঘটনার সরাসরি উল্লেখ না থাকলেও সাহিত্য কখনই সমকালীন সমাজ রাজনীতি এবং সাংস্কৃতিক পরিস্থিতিকে উপেক্ষা করতে পারে না। তাই কালিদাসের নাটক ও কাব্য সমূহ, দন্ডির দশকুমারচরিত, ভারবির কিরাতার্জুনীয়ম, শূদ্রকের মৃচ্ছকটিক এবং তামিল কবিদের সঙ্গম সাহিত্য ইতিহাসের বহু সাক্ষ্য বহন করে। রোমিলা থাপার মহাভারতের শকুন্তলা চরিত্র এবং অভিজ্ঞান শকুন্তলম এর শকুন্তলা চরিত্রের তুলনামূলক আলোচনা করে সমাজে নারীর অবস্থার পরিবর্তনশীল চরিত্রটি তুলে ধরেছেন।

বিজ্ঞান এবং বিবিধ বিদ্যা বিষয়ক কিছু গ্রন্থ ইতিহাস চর্চায় বিশেষ সহযোগী। যেমন পাণিনির ব্যাকরণ গ্রন্থ অষ্টাধ্যায়ী এবং তার টিকা পতঞ্জলির মহাভাষ্য সংস্কৃত ভাষার বিবর্তন তথা ভাষাতাত্ত্বিক ইতিহাস চর্চায় বিশেষ সহযোগী। তামিল ব্যাকরণ টোলকাপ্পিয়ম একইরকমভাবে উল্লেখযোগ্য। কিছু অভিধান গ্রন্থ যেমন অমর সিংহের অমরকোষ, হেমচন্দ্রের দেশীশনামমালা উল্লেখযোগ্য। গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ক আর্যভট্টের আর্যভট্টিও, ব্রহ্মগুপ্তের সূর্যসিদ্ধান্ত, বরাহমিহিরের বৃহৎসংহিতা; চিকিৎসাশাস্ত্র বিষয়ক চরকের চরকসংহিতা, সুশ্রুতের সুশ্রুত সংহিতা; কৃষি বিষয়ক কৃষি পরাশর ও কৃষিসুক্তি, স্থাপত্যবিদ্যা বিষয়ক মানোসল্লাস প্রভৃতি গ্রন্থগুলি বর্তমানে গতানুগতিক ইতিহাস চর্চার বাইরে অন্যান্য ধারার ইতিহাস চর্চার সূচনা হয়েছে সে ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উপযোগী।

Non-Religious Literature in Reconstructing the Ancient Indian History

Ancient India produced much literature that was non-religious in nature, despite the strong influence of religion on Indian traditions. These works hold significant importance in the field of historical research.

Among the non-religious literature, we should discuss first the ArthasashtraDiscussing the governance and financial system is the mainstay of ArthasastraKautilya's Arthashastra provides essential insights into statecraft and economic administration, particularly during the Mauryan rule, including Chandragupta Maurya's reign. While these texts offer valuable guidance, their historical accuracy can be a matter of debate, because of their instructional nature. Notable in the context is Kamandaka's Nitisara and Nitivakyamrita are the summaries of Kautilya's Arthashastra.

During ancient times, biographical literature or Prasashti about famous rulers was popular. For instance, Banabhatta, the court poet of Harshavardhana, wrote the Harshacharita, a biography of Emperor Harsha. Similarly, Chalukya King Shashtha (6th) Vikramaditya's court poet Bilhana composed the Vikramankadevacharita. Ramapala's court poet Sandhyakar Nandi wrote the Ramacharita, depicting the life of both Lord Rama and King Ramapala. However, these texts pose a significant challenge as they tend to be exaggerated, and their historical accuracy may need to be revised. Therefore, they require careful scrutiny of historical data.

One of the finest examples of historical literature in India is Kalhana's Rajatarangini. This local chronicle provides Informative and unbiased history from the 7th to the 12th century of Kashmir. However, in the pre-seventh century, the narrative relied to some extent on anecdotes and oral traditions.

While not directly mentioning historical events,  creative literature is an integral part of contemporary society, politics, and cultural context. Hence, the works of Kalidasa, including his plays and poetry, Dandin's Dashakumaracharita, Bhasa's dramas, and the Sangam literature of Tamil poets, contribute significantly to the understanding of the historical context. Romila Thapar's analysis of Shakuntala's character in the Mahabharata compared to her portrayal in the play Abhijnanasakuntalam illustrates how literature reflects the changing roles of women in society.

In the fields of science and various academic subjects, several texts played a significant role in historical research. Panini's grammar text, Ashtadhyayi, and its commentary by Patanjali, Mahabhashya, are crucial for understanding the transformation of the Sanskrit language and linguistic philosophy. The Tamil grammar text Tolkappiyam is similarly important. Some dictionary texts, such as Amar Singh's Amarakosha and Hemachandra's Desinamamala, hold relevance in historical linguistics.

In mathematics and astronomy, Aryabhata's Aryabhatiya, Brahmagupta's Suryasiddhanta, Varahamihira's Brihatsamhita, and in medical science, Charaka's Charakasamhita and Sushruta's Sushrutasamhita, provide valuable insights into ancient knowledge. In agriculture, texts like Krishiparashara and Krishisukti are noteworthy. In the field of architecture, works like Manasollasa by Someshvara III provide valuable information about contemporary building practices.

These texts, while not primarily historical, offer glimpses into various aspects of ancient Indian life, thought, and society, enriching our understanding of the historical context.


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য Please visit our Homepage and subscribe us. Suggested Topics || Ghajnavid Invasion || গজনী আক্রমণ || || মামুদের সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন || Somnath Temple Plunder || || তরাইনের যুদ্ধ ও তার গুরুত্ত্ব || মহম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমন ও তার চরিত্র || সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আ...

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগ...

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হ...