সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

Transition Debate: Dobb-Sweezy debate, Posts & Brenar |যুগসন্ধিক্ষণ: ডব-সুইজি বিতর্ক, পোস্তান, ব্রেনার

যুগসন্ধিক্ষণ: ডব-সুইজি বিতর্ক, মাইকেল পোস্তান, রবার্ট ব্রেনার



কাল মার্কস সমাজ বিকাশের ধারাকে মোট চারটি পর্বে ভাগ করেছেন: আদিম সাম্যবাদ, দাস ব্যবস্থা, সামন্ত প্রথা এবং ধণতন্ত্র। পঞ্চম শতকে পশ্চিম ইউরোপে বর্বর জার্মানদের আক্রমণের পর থেকে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার সূচনা হয়েছিল এবং ত্রয়োদশ শতকের মাঝামাঝি থেকেই এই ব্যবস্থার পতনের লক্ষনগুলি লক্ষ্য করা যাচ্ছে 14 শতকের মাঝামাঝি থেকে অবক্ষয়ের চিহ্নগুলি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এদিকে দ্বাদশ শতক থেকে ইউরোপে দূরপাল্লার বাণিজ্যের সুবাদে নগর জীবন প্রাণের সঞ্চার হচ্ছিল যা কৃষি সর্বোচ্চ অর্থনীতিকে আঘাত করছিল। পশ্চিম ইউরোপে আলোচ্য পর্বেই সামন্ততন্ত্রের অবসান ঘটে এবং ধনতন্ত্রের সূচনা হয়। এই দুই পর্বের সন্ধিক্ষণকে যুগসন্ধিক্ষণ বলা হয়।

সামন্ততন্ত্রের অবক্ষয় সম্পর্কে পণ্ডিতরা সহমত হলেও তার কারণ গুলির আনুপাতিক গুরুত্ব বিষয়ে তাদের মধ্যে তীব্র মতপার্থক্য রয়েছে। যুগসন্ধিক্ষণ সংক্রান্ত প্রধান বিতর্কটি এসেছে মরিস ডব ও পল সুইজির পক্ষ থেকে ইতিহাসে ডব-সুইজি বিতর্ক নামে পরিচিত।

মরিস ডব

মরিস ডব Studies in The Development of Capitalism (1946) গ্রন্থে সামন্তপ্রথার পতনে 'অভ্যন্তরীণ স্ববিরোধ তত্ত্ব' খাড়া করেছেন। তাঁর মতে ভূমিদাস প্রথাকে অবলম্বন করেই সামন্ততান্ত্রিক অর্থনীতির বিকাশ ঘটেছিল। ম্যানর হাউসের উৎপাদন ছিল অভ্যন্তরীণ প্রয়োজন ভিত্তিক, যাকে বলা যেতে পারে Economy of no outlets. তাই উৎপাদনের প্রযুক্তিও ছিল মামুলি স্তরের এবং সাধনগুলি ছিল অতি সাধারন। তবে বাইরের সাথে একেবারেই যোগাযোগ ছিল না এমনটা নয়। লবণ মসলা প্রভৃতি দ্রব্য ম্যানরের বাইরে থেকে আমদানি করতে হত। 11 শতকে পশ্চিম ইউরোপে বাণিজ্যিক দিগন্ত উন্মুক্ত হয় ম্যানরের ওপর তার প্রভাব পড়েছিল। তবে এই প্রভাব সামন্ততন্ত্রের পতনে অনুঘটকের কাজ করেছিল, তা কখনোই চালিকা শক্তি ছিলনা।

ডাবের মযে সামন্ত প্রভু চাহিদা অনুযায়ী বাইরে থেকে বাণিজ্যিক পণ্য আমদানি করত। এই চাহিদা যত বাড়তে থাকে তারা ততই বাড়তি কর চাপাতে থাকে। যার পরিণতি পূর্ব ও পশ্চিম ইউরোপে ভিন্ন ভিন্ন হয়। পশ্চিম ইউরোপের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, করের চাপ সহ্য করতে না পেরে ভূমিদসরা ম্যানার ছেড়ে পালিয়ে জঙ্গলে অথবা নগর অঞ্চলে আশ্রয় নিত। সামন্ত আইন অনুযায়ী কোনো পলাতক ভূমিদাস এক বছর গা-ঢাকা দিয়ে থাকতে পারলে সে মুক্তি পেত। পশ্চিম ইউরোপে নগরের সংখ্যা বেশি থাকায় ভূমি দাসদের পক্ষে মুক্তি পাওয়া সোজা হয়েছিল; কারণ নগর প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া সামন্তপ্রভুর অনুচররা পলাতক ভূমিদাসদের সন্ধানে নগরের ঢুকতে পারত না। এদিকে ভূমিদাস ক্রমাগত পলায়নের ফলে তাদের সংখ্যা যত কমে যায় ততই সামন্ত প্রভু খাজনার নগদীকরণ করতে থাকে, যার ফলে উৎপাদন বাজারমুখী হতে থাকে এবং উৎপাদনের ওপর সামন্তপ্রভুর নিয়ন্ত্রণ পেতে থাকে, যা সামন্ততন্ত্রের পতনকে ত্বরান্বিত করে। অন্যদিকে পূর্ব ইউরোপে নগরের সংখ্যা ছিল কম। তাই প্রজাদের ম্যানরের বাইরে কোনো বিকল্প ছিলনা। তাই সেখানে ভূমিদাস পালানোর ঘটনা সেভাবে ঘটেনি, খাজনার নগদীকরণ হয়নি। এজন্যই যখন পশ্চিম ইউরোপে সামন্ততন্ত্রের অবসান হচ্ছে তখন পূর্ব ইউরোপে তা আরো দৃঢ় হচ্ছে।

পল সুইজি

মার্কিন অর্থনীতিবিদ পল সুইজি ডবের অভ্যন্তরীণ স্ববিরোধ তত্ত্বের সমালোচনা করে পাল্টা বাণিজ্যিকীকরণ তত্ত্ব খাড়া করেছেন Science and Society পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর Feudalism: a Critique প্রবন্ধে (১৯৫০)। একাদশ শতকের শেষ থেকে ভূমধ্যসাগরীয় এবং উত্তর সাগরীয় বাণিজ্য বাড়তে থাকার ফলে পশ্চিম ইউরোপের নগরজীবন জঙ্গম হয়ে উঠতে শুরু করে। ক্রুসেডের ফলে ভূমধ্যসাগরের পূর্বপ্রান্তে পশ্চিম ইউরোপীয় বণিকদের উপস্থিতি বৃদ্ধির সুবাদে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে ভূমধ্যসাগরীয় বাণিজ্যের তাৎপর্য বাড়তে থাকে। ধর্মযুদ্ধকে কেন্দ্র করে বাড়তে থাকা খ্রিস্টীয় উন্মাদনা ইউরোপে অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ বৃদ্ধি করে, যা বাণিজ্য বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করে। আন্তঃইউরোপীয় বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে পশ্চিম-মধ্য ইউরোপের অসংখ্য নতুন নগরের সৃষ্টি হয় এবং বহু ক্ষয়িষ্ণু নগর পুনর্জীবন লাভ করে।

নগর-জীবন যত সচল হতে থাকে নগরবাসীর চাহিদা এবং ক্রয় ক্ষমতা আনুপাতিক হারে বৃদ্ধি পেতে থাকে। নগরে কৃষি পণ্যের জোগান আসত ম্যানর থেকে। সামন্ত প্রভু যখন নতুন নতুন পণ্যের চাহিদা মেটাতে খাজনা বাড়িয়ে দেয় এবং নগদীকরণের সূচনা করেন তখন ম্যানারের কৃষক বাজারি চাহিদা অনুযায়ী পণ্য উৎপাদন করতে শুরু করে। এদিকে খাজনা মেটাতে ব্যর্থ প্রজা ম্যানার থেকে পালিয়ে নগর অঞ্চলে একটি বিকল্প জীবনের সন্ধান করতে থাকে। ফলে নগরাঞ্চলের জনসংখ্যা উত্তরোত্তর বাড়তে থাকায় শ্রমশক্তির যোগান বৃদ্ধি পায় এবং নগরজীবন পুনরুজ্জীবিত হয়। আবার ম্যানর থেকে ভূমিদাস পালানোর জন্য ভূমিদাস প্রথা ভেঙে পড়ে। সুতরাং খাজনার নগদীকরণ, বাজারমুখী উৎপাদন এবং ভূমিদাস প্রথার অবনমনের ফলে উৎপাদন ব্যবস্থায় সামন্ত প্রভুর নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে পড়ে এবং সামন্ততন্ত্রের পতন ঘটে।

মাইকেল পোস্তানের (Postan)-এর জনসংখ্যা তত্ত্ব

মরিস ডব এর 'অভ্যন্তরীণ স্ববিরোধ তত্ত্ব' এবং পল সুইজির 'বাণিজ্যকিকরন তত্ত্ব' দুটিকেই নাকচ করে দিয়ে একটি ভিন্নধর্মী মতামত তুলে ধরেন ইতিহাসবিদ মাইকেল পোস্তান (Postan)। তিনি ইউরোপের জনসংখ্যার হ্রাস-বৃদ্ধির প্রবনতার সঙ্গে সামন্ততন্ত্রের অবক্ষয়ের ও পুঁজিবাদের বিস্তারকে যুক্ত করেছেন। তাঁর মতে 12-13  শতকে ইউরোপের জনসংখ্যা দ্রুত হারে বৃদ্ধির ফলে আবাদি জমির উপর চাপ বেড়েছিল। যেহেতু কৃষি ছিল প্রধান জীবিকা সেহেতু অতিরিক্ত চাষাবাদের জন্য জমির উর্বরতা কমতে শুরু করে। সামন্ত প্রভুরা এই সময় খাজনার অতিরিক্ত আদায় শুরু করেন। খাদ্য শস্যর দাম বাড়ার ফলে বেঁচে থাকার তাগিদে ভূমিদাসরাও বেশি করে সামন্ত প্রভুর উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল। একদিকে কম জমি ও অন্যদিকে বেশি লোকসংখ্যা এই অবস্থায় সামন্ত প্রভু নিজেদের অবস্থান আরও শক্তিশালী করেছিল।

14 শতকের দ্বিতীয় ভাগ থেকে জমির উর্বরতা হ্রাস এবং দুর্ভিক্ষ ও মহামারীজনিত কারণে পরিস্থিতি পুরো পাল্টে যায়। জমিতে নিয়োগ করার মত লোকের অভাব দেখা দেয়। ফলে নিজেদের স্বার্থেই সামন্ত প্রভুরা ভূমিদাসদের উপর নিয়ন্ত্রণ করেন এবং খাজনার নগদীকরণ শুরু করেন। এভাবেই পশ্চিম ইউরোপে ভূমি দাসদের স্বাধীনতার ক্ষেত্র তৈরি হয়। এবং সামন্ত প্রথা ভেঙে পড়তে থাকে।

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য Please visit our Homepage and subscribe us. Suggested Topics || Ghajnavid Invasion || গজনী আক্রমণ || || মামুদের সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন || Somnath Temple Plunder || || তরাইনের যুদ্ধ ও তার গুরুত্ত্ব || মহম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমন ও তার চরিত্র || সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আ

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগার:-   কোনো ব্যাক্তিগত বা অলাভজনক

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল তা জনজীবনে তীব্রভ