১৮ শতক ইউরোপে জ্ঞানদীপ্তির যুগ। ফ্রান্স ছিল জ্ঞানদীপ্তির অন্যতম কেন্দ্র। ফেনেলো থেকে ফ্রান্সে যুক্তিবাদের জয়যাত্রা সূচনা হয়েছিল। ফরাসি দারশনিকরা কেবল দর্শন চর্চার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, তাঁরা সমকালীন ফরাসি রাষ্ট্র, সমাজ, অর্থনীতি ও ধর্মে পরিব্যপ্ত স্বৈরাচার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখেন। ফরাসি বিপ্লব সময়কার বিখ্যাত তিনজন দার্শনিক হলেন, মন্টেস্কু ভলতেয়ার ও রুশো।
মন্তেস্কু অভিজাত পরিবারের মানুষ হলেও উদারনৈতিক দর্শনের সমর্থক ছিলেন। তার পার্শিয়ান লেটার্স গ্রন্থে তিনি সমকালীন ফ্রান্সের স্বৈরাচার, দুর্নীতি, অভিজাততন্ত্রের স্বার্থপরতা ও চার্চের গোঁড়ামি তুলে ধরেন। গ্রেটনেস এন্ড ডেকাডেন্স অব রোমানস্ গ্রন্থে দেখিয়েছেন কিভাবে ভৌগলিক পরিবেশ, জনসংখ্যা, প্রাকৃতিক সম্পদ একটি দেশের জীবনযাত্রা, আইন, শাসন, বিচারব্যবস্থা ইত্যাদির উপর প্রভাব বিস্তার করে। তিনি রোমান আইনের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। মন্টেস্কুর শ্রেষ্ঠ রচনা দি স্পিরিট অফ দ্য লজ প্রকাশিত হয় ১৭৪৮সালে। এই গ্রন্থে তিনি তার বিখ্যাত ক্ষমতা বিভাজন তত্ত্বের ব্যাখ্যা করেন। ইংল্যান্ডে গিয়ে মন্তেস্কুর ধারণা হয়েছিল সরকারের তিনটি পৃথক বিভাগের মধ্যে শাসন, আইন প্রণয়ন ও বিচার ক্ষমতা বিভক্ত হলে জনগণের অধিকার রক্ষা পায়। মন্টেস্কু গণতন্ত্রের কথা বলেন নি, তিনি নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র কথা বলেছিলেন।
ফরাসী বিপ্লবের প্রাক্কালে দার্শনিকদের অবদান
এযুগের অপর চিন্তাবিদ ও লেখক হলেন ভলতেয়ার।তিনি প্রাশিয়ার রাজা দ্বিতীয় ফ্রেডারিক এর গৃহ শিক্ষক ছিলেন। তার লেখা বিখ্যাত কাঁদিদ গ্রন্থে চার্চের দুর্নীতি এবং ভ্রষ্টাচারকে তীব্র আক্রমণ করেন। তিনি দাবী করেন, ফ্রান্সের সকল সমস্যার উৎস চার্চ, তাই চার্চ ব্যবস্থা ভেঙে ফেলা উচিৎ। তাঁর দ্বিতীয় বিখ্যাত গ্রন্থ লেতর ফিলজফিক -এ তিনি ফ্রান্সের পুরাতনতন্ত্রকে আক্রমণ করেন। তিনি গনতন্ত্রের কথা বলেননি, কিন্তু ব্যক্তিস্বাধীনতার কথা বলেছিলেন। তিনি জ্ঞানদীপ্ত স্বৈরাচারের পক্ষে মত প্রকাশ করেন। তবে সাধারণ মানুষের অধিকারের কথা তার লেখায় স্থান পায়নি।
এযুগের ফ্রান্সের দার্শনিকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ছিলেন রুশো। তিনি তাঁর কনফেসন গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, মানুষ স্বভাবতই সৎ, কিন্তু সমাজ তাঁকে অসৎ করে তোলে। তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট যেখানে তিনি দেখিয়েছেন শাসক ও শাসিতের মধ্যে চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র গঠিত হয়েছে। শাসিত শ্রেণি হল সার্বভৌমত্বের অধিকারী, রাজা সার্বভৌম নন। তিনি general will বা জনগণের অধিকারের কথা বলেছেন। রুশো সরাসরি বিপ্লবের কথা না বললেও তার চিন্তা ধারার মধ্যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এর ইঙ্গিত ছিল।
এই বিখ্যাত তিনজন দার্শনিক ছাড়াও ফ্রান্সে দুটি দার্শনিক গোষ্ঠী ছিল - বিশ্বকোষ ও ফিজিওক্র্যাট । বিশ্বকোষ গোষ্ঠীর নেতা ছিলেন ডেনিস দিদেরো এই গোষ্ঠীর সদস্যদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন জড়বাদী, নাস্তিক এবং স্বৈরাচারী ও রক্ষণশীল চার্চের বিরোধী। জাঁ মেসলিয়ে ফরাসি চার্চব্যবস্থা, অভিজাততন্ত্র ও রাজতন্ত্রের তীব্র সমালোচনা করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান। মরেলি ও লিঙ্গুয়ে ব্যাক্তিগত সম্পত্তি ও বংশগত অধিকার বিলপের কথা বলেন।
স্কটিশ অর্থনীতিবিদ এডাম স্মিথের মুক্ত অর্থনীতির চিন্তাভাবনা দ্বারা প্রভাবিত ফ্রান্সের এক অর্থনীতিবিদদের গোষ্ঠী হল ফিজিওক্র্যাট। ফ্রান্সে এদের নেতা ছিলেন কুইসনে। 1758 খ্রিস্টাব্দে ইয়াবলো ইকনমিক গ্রন্থে কুয়েসেনে সমকালীন ফ্রান্সের মার্কেনটাইল অর্থনীতির সমালোচনা করে মুক্তবাণিজ্যের পক্ষে সওয়াল করেন ।
এখন প্রশ্ন হল, দার্শনিকদের কর্মকান্ড বিপ্লবকে কতটা তরান্বিত করেছিল। ইংরেজ দার্শনিক এডমন্ড বার্ক ফরাসি বিপ্লবকে দার্শনিকদের ষড়যন্ত্র বলে উল্লেখ করেছেন। কারণ, তাঁর মতে, ফ্রান্সের মত অচলবস্থা অন্যান্য দেশেও ছিল, যা সংস্কারের মাধ্যমে কাটিয়ে ওঠা যেত। কিন্তু এই দার্শনিকরা জনগনকে প্ররোচিত করেছিল। কিছু ঐতিহাসিক অবশ্য বিপ্লবে দার্শনিকদের কোনো অবদান নেই বলে মনে করেন। কারন দার্শনিকদের পার্স্পরিক মতৈক্য ছিল না। এদের পাঠকও ছিল শিক্ষিত বুর্জোয়ারা। সাধারন মানুষের সাথে এদের যোগাযোগ তেমন ছিল না যে এরা বিপ্লবের জন্য তাদের উত্তেজিত করতে পারবে।
মনে রাখতে হবে, বিপ্লবের সুতিকাগৃহ ছিল সালোঁ, কাফে, রেঁস্তেরা প্রভৃতি, যেখানে দার্শনিকদের বক্তব্যগুলি আলোচিত হত। বিপ্লবের প্রাক্কালে ফ্রান্সে পত্রপত্রিকার সংখ্যা ছিল ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে অধিক (১৬৯)। হাত-বাজার, অফিস, আদালত, থিয়েটার সর্বত্র এসব নিয়ে আলোচনা চলত, যা সাধারণ মানুষকে সচেতন করেছিল। বিপ্লবের কারণ অবশ্যই চলমান অর্থনৈতিক দুর্দশা, সামাজিক ক্ষোভ ও রাজনৈতিক ব্যর্থতার মধ্যে নিহিত ছিল। কিন্তু মনে রাখতে হবে, সেযুগে কোনও রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব ছিল না। তাই মানুষের ক্ষোভ, আশা আকাঙ্খাকে সমন্বিত রূপ দেওয়া এবং পরিবর্তনের দাবীগুলিকে স্থির করার ক্ষেত্রে যে ভূমিকা বুদ্ধিজীবিদের বা রাজনৈতিক দলগুলির থাকে তা-ই দার্শনিকরা করেছিল। তাই দার্শনিকদের ভূমিকাকে কোনোভাবেই খাঁটো করা যাবে না।
Sir please correction the year. French Revolution took place in 1789 not in 1989!
উত্তরমুছুন