সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

Philosopher's Movement | French Revolution: 1989 | ফরাসী বিপ্লবের প্রাক্কালে দার্শনিকদের অবদান

১৮ শতক ইউরোপে জ্ঞানদীপ্তির যুগ। ফ্রান্স ছিল জ্ঞানদীপ্তির অন্যতম কেন্দ্র। ফেনেলো থেকে ফ্রান্সে যুক্তিবাদের জয়যাত্রা সূচনা হয়েছিল। ফরাসি দারশনিকরা কেবল দর্শন চর্চার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, তাঁরা সমকালীন ফরাসি রাষ্ট্র, সমাজ, অর্থনীতি ও ধর্মে পরিব্যপ্ত স্বৈরাচার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখেন। ফরাসি বিপ্লব সময়কার বিখ্যাত তিনজন দার্শনিক হলেন, মন্টেস্কু ভলতেয়ার ও রুশো।

মন্তেস্কু অভিজাত পরিবারের মানুষ হলেও উদারনৈতিক দর্শনের সমর্থক ছিলেন। তার পার্শিয়ান লেটার্স  গ্রন্থে তিনি সমকালীন ফ্রান্সের স্বৈরাচার, দুর্নীতি, অভিজাততন্ত্রের স্বার্থপরতা ও চার্চের গোঁড়ামি তুলে ধরেন। গ্রেটনেস এন্ড ডেকাডেন্স অব রোমানস্  গ্রন্থে দেখিয়েছেন কিভাবে ভৌগলিক পরিবেশ, জনসংখ্যা, প্রাকৃতিক সম্পদ একটি দেশের জীবনযাত্রা, আইন, শাসন, বিচারব্যবস্থা ইত্যাদির উপর প্রভাব বিস্তার করে। তিনি রোমান আইনের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। মন্টেস্কুর শ্রেষ্ঠ রচনা দি স্পিরিট অফ দ্য লজ প্রকাশিত হয় ১৭৪৮সালে। এই গ্রন্থে তিনি তার বিখ্যাত ক্ষমতা বিভাজন তত্ত্বের ব্যাখ্যা করেন। ইংল্যান্ডে গিয়ে মন্তেস্কুর ধারণা হয়েছিল সরকারের তিনটি পৃথক বিভাগের মধ্যে শাসন, আইন প্রণয়ন ও বিচার ক্ষমতা বিভক্ত হলে জনগণের অধিকার রক্ষা পায়। মন্টেস্কু গণতন্ত্রের কথা বলেন নি, তিনি নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র কথা বলেছিলেন।

ফরাসী বিপ্লবের প্রাক্কালে দার্শনিকদের অবদান

এযুগের অপর চিন্তাবিদ ও লেখক হলেন ভলতেয়ার।তিনি প্রাশিয়ার রাজা দ্বিতীয় ফ্রেডারিক এর গৃহ শিক্ষক ছিলেন। তার লেখা বিখ্যাত কাঁদিদ  গ্রন্থে চার্চের দুর্নীতি এবং ভ্রষ্টাচারকে তীব্র আক্রমণ করেন। তিনি দাবী করেন, ফ্রান্সের সকল সমস্যার উৎস চার্চ, তাই চার্চ ব্যবস্থা ভেঙে ফেলা উচিৎ। তাঁর দ্বিতীয় বিখ্যাত গ্রন্থ লেতর ফিলজফিক  -এ তিনি ফ্রান্সের পুরাতনতন্ত্রকে আক্রমণ করেন। তিনি গনতন্ত্রের কথা বলেননি, কিন্তু ব্যক্তিস্বাধীনতার কথা বলেছিলেন। তিনি জ্ঞানদীপ্ত স্বৈরাচারের পক্ষে মত প্রকাশ করেন। তবে সাধারণ মানুষের অধিকারের কথা তার লেখায় স্থান পায়নি।

এযুগের ফ্রান্সের দার্শনিকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ছিলেন রুশো। তিনি তাঁর কনফেসন গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, মানুষ স্বভাবতই সৎ, কিন্তু সমাজ তাঁকে অসৎ করে তোলে। তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট যেখানে তিনি দেখিয়েছেন  শাসক ও শাসিতের মধ্যে চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র গঠিত হয়েছে। শাসিত শ্রেণি হল সার্বভৌমত্বের অধিকারী, রাজা সার্বভৌম নন। তিনি general will বা জনগণের অধিকারের কথা বলেছেন। রুশো সরাসরি বিপ্লবের কথা না বললেও তার চিন্তা ধারার মধ্যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এর ইঙ্গিত ছিল।

এই বিখ্যাত তিনজন দার্শনিক ছাড়াও ফ্রান্সে দুটি দার্শনিক গোষ্ঠী ছিল - বিশ্বকোষ ও ফিজিওক্র্যাট । বিশ্বকোষ গোষ্ঠীর নেতা ছিলেন ডেনিস দিদেরো এই গোষ্ঠীর সদস্যদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন জড়বাদী, নাস্তিক এবং স্বৈরাচারী ও রক্ষণশীল চার্চের বিরোধী। জাঁ মেসলিয়ে ফরাসি চার্চব্যবস্থা, অভিজাততন্ত্র ও রাজতন্ত্রের তীব্র সমালোচনা করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান। মরেলি ও লিঙ্গুয়ে ব্যাক্তিগত সম্পত্তি ও বংশগত অধিকার বিলপের কথা বলেন। 

স্কটিশ অর্থনীতিবিদ এডাম স্মিথের মুক্ত অর্থনীতির চিন্তাভাবনা দ্বারা প্রভাবিত ফ্রান্সের এক অর্থনীতিবিদদের গোষ্ঠী হল ফিজিওক্র্যাট। ফ্রান্সে এদের নেতা ছিলেন কুইসনে। 1758 খ্রিস্টাব্দে ইয়াবলো ইকনমিক গ্রন্থে কুয়েসেনে সমকালীন ফ্রান্সের মার্কেনটাইল অর্থনীতির সমালোচনা করে মুক্তবাণিজ্যের পক্ষে সওয়াল করেন ।

এখন প্রশ্ন হল, দার্শনিকদের কর্মকান্ড বিপ্লবকে কতটা তরান্বিত করেছিল। ইংরেজ দার্শনিক এডমন্ড বার্ক ফরাসি বিপ্লবকে দার্শনিকদের ষড়যন্ত্র বলে উল্লেখ করেছেন। কারণ, তাঁর মতে, ফ্রান্সের মত অচলবস্থা অন্যান্য দেশেও ছিল, যা সংস্কারের মাধ্যমে কাটিয়ে ওঠা যেত। কিন্তু এই দার্শনিকরা জনগনকে প্ররোচিত করেছিল। কিছু ঐতিহাসিক অবশ্য বিপ্লবে দার্শনিকদের কোনো অবদান নেই বলে মনে করেন। কারন দার্শনিকদের পার্স্পরিক মতৈক্য ছিল না। এদের পাঠকও ছিল শিক্ষিত বুর্জোয়ারা। সাধারন মানুষের সাথে এদের যোগাযোগ তেমন ছিল না যে এরা বিপ্লবের জন্য তাদের উত্তেজিত করতে পারবে। 

মনে রাখতে হবে, বিপ্লবের সুতিকাগৃহ ছিল সালোঁ, কাফে, রেঁস্তেরা প্রভৃতি, যেখানে দার্শনিকদের বক্তব্যগুলি আলোচিত হত। বিপ্লবের প্রাক্কালে ফ্রান্সে পত্রপত্রিকার সংখ্যা ছিল ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে অধিক (১৬৯)। হাত-বাজার, অফিস, আদালত, থিয়েটার সর্বত্র এসব নিয়ে আলোচনা চলত, যা সাধারণ মানুষকে সচেতন করেছিল। বিপ্লবের কারণ অবশ্যই চলমান অর্থনৈতিক দুর্দশা, সামাজিক ক্ষোভ ও রাজনৈতিক ব্যর্থতার মধ্যে নিহিত ছিল। কিন্তু মনে রাখতে হবে, সেযুগে কোনও রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব ছিল না। তাই মানুষের ক্ষোভ, আশা আকাঙ্খাকে সমন্বিত রূপ দেওয়া এবং পরিবর্তনের দাবীগুলিকে স্থির করার ক্ষেত্রে যে ভূমিকা বুদ্ধিজীবিদের বা রাজনৈতিক দলগুলির থাকে তা-ই দার্শনিকরা করেছিল। তাই দার্শনিকদের ভূমিকাকে কোনোভাবেই খাঁটো করা যাবে না।  

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য Please visit our Homepage and subscribe us. Suggested Topics || Ghajnavid Invasion || গজনী আক্রমণ || || মামুদের সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন || Somnath Temple Plunder || || তরাইনের যুদ্ধ ও তার গুরুত্ত্ব || মহম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমন ও তার চরিত্র || সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আ...

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগ...

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হ...