সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

হর্ষবর্ধন এর রাজনৈতিক অবদান | Political Contributions of Harsha Vardhana

হর্ষবর্ধন এর রাজনৈতিক অবদান

গুপ্ত পরবর্তী উত্তর ভারতের রাজনীতিতে হর্ষবর্ধন ছিলেন এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। মাত্র ১৬ বছর বয়সে তিনি রাজা হিসাবে কার্যভার গ্রহণ করেন এবং নিজ প্রতিভাবলে উত্তর ভারতের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। দক্ষিণ ভারতে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী চালুক্য রাজ পুলকেশী তাঁকে 'সকলোত্তরপথনাথ' বলে অভিহিত করেছিলেন।  হর্ষবর্ধনের রাজত্বকালের ইতিহাস জানা যায় তাঁর সভাকবি বানভট্টের হর্ষচরিত, হিউ এন সাং এর ভ্রমণ বৃত্তান্ত, বাঁশঘেরা লেখ, চালুক্য রাজ দ্বিতীয় পুলকেশীর আইহোল লিপি প্রভৃতি উপাদান থেকে।

হর্ষবর্ধন থানেশ্বরের পুষ্যভূতি রাজবংশের সন্তান ছিলেন । গৌড়ের রাজা শশাঙ্ক এবং মালব রাজ দেবগুপ্তের যৌথ বাহিনী কনৌজ আক্রমণ করেন। তখন কনৌজের শাসক ছিলে মৌখরি রাজ গ্রহবর্মণ, যার স্ত্রী ছিলেন থানেশ্বর রাজ রাজ্যবর্ধনের (হর্ষের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা) ভগিনী রাজ্যশ্রী। এই অবস্থায় ভগিনীপতির রাজ্য রক্ষার্থে রাজ্যবর্ধন শশাঙ্ক ও দেবগুপ্তের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। কিন্তু শশাঙ্কের হাতে থানেশ্বরের রাজা রাজ্যবর্ধনের হত্যা হয়।  শশাঙ্কের হাতে নিঃসন্তান গ্রহবর্মনের মৃত্যু এবং ভগিনী রাজ্যশ্রী অপহরণের পর কনৌজের সিংহাসন শূন্য হয়ে যায় । এই প্রেক্ষিতে হর্ষবর্ধন একইসাথে পিতৃরাজ্য থানেশ্বর এবং ভগিনীপতির রাজ্য কনৌজের রাজত্ব ভার গ্রহণ করেন। কনৌজে তাঁর রাজধানী স্থাপন করেন (৬০৬ খ্রী:)। 

সিংহাসন আরোহনের পর হর্ষবর্ধন শশাঙ্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। শশাঙ্ক ও দেবগুপ্ত পশ্চাদপসরণ করেন। এই অভিযানে হর্ষ কামরূপরাজ ভাস্করবর্মন এর মিত্রতা লাভ করেছিলেন। রাজা হর্ষ প্রথমে বিন্ধ্যারণ্যে থেকে ভগিনী রাজ্যশ্রীকে উদ্ধার করেন। তারপর তিনি বাংলা অভিযান করেন। শশাঙ্কের সঙ্গে তার যুদ্ধের ফল কি হয়েছিল তাই নিয়ে বিতর্ক আছে। রমেশচন্দ্র মজুমদার এর মতে শশাঙ্ক যতদিন জীবিত ছিলেন হর্ষবর্ধন গৌড়ের কোন ক্ষতি করতে পারেননি। শশাঙ্কের মৃত্যুর পর হর্ষবর্ধন মগধ ও গঞ্জাম দখল করেছিলেন।

হর্ষবর্ধন ভারতব্যপী সাম্রাজ্য বিস্তারের কথা ভেবেছিলেন, যার উল্লেখ পাওয়া যায় হরষচরিতে। সাম্রাজ্য বিস্তারের উদ্দেশ্যে তিনি বলভী ও গুর্জর রাজ্য, চালুক্য রাজ্যে অভিযান চালিয়েছিলেন। সমসাময়িক দ্বিতীয় ধ্রুবসেন বালাদিত্যের সময় পশ্চিম ভারতের বলভী যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল। বলভীদের সাথে দ্বন্দ্বে হর্ষ সফল হতে পারেননি। জানা যায় যে যুদ্ধের পর বলভি রাজের সাথে হর্ষের কন্যার বিবাহ হয়েছিল অর্থাৎ একটা কূটনৈতিক সমঝোতা হয়েছিল। এদিকে গুর্জররা হর্ষের হাত থেকে রক্ষা পেতে চালুক্য রাজ দ্বিতীয় পুলকেশীর সাথে মিত্রতায় আবদ্ধ হয়েছিল। হর্ষবর্ধনের সমসাময়িক দক্ষিণ ভারতের চালুক্য রাজা ছিলেন দ্বিতীয় পুলকেশী। আইহোল লিপিতে বলা হয়েছে মালব, গুজরাট ও গুর্জর রাজ্য পুলকেশীর সাম্রাজ্যভূক্ত ছিল। সম্ভবত এই তিন  এলাকাকে কেন্দ্র করে হর্ষ ও পুলকেশীর মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছিল। আইহোল লিপি থেকে জানা যায় এই যুদ্ধে হর্ষবর্ধন শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন। হর্ষের দক্ষিণ ভারত জয়ের আশা অসমাপ্ত থেকে যায়।

শশাঙ্কের বিরুদ্ধে একাধিক সামরিক অভিযান চালিয়ে হর্ষবর্ধন উত্তর ভারতে ক্রমশ শক্তিশালী রাজায় পরিণত হন। পশ্চিম দিকে শক্তিশালী বলভীর রাজা দ্বিতীয় ধ্রুবসেন বালাদিত্যর  সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। বালভীর রাজাকে পরাস্ত করতে না পারলেও নিজ কন্যার সঙ্গে বালভীর  রাজার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে বৈবাহিকসম্পর্কে আবদ্ধ হন। দ্বিতীয় পুলকেশীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর হর্ষ সিন্ধু অভিযান করেন। সিন্ধুদেশ লুণ্ঠন করেন। কিন্তু অধিকার করতে পারেননি। পূর্বদিকেও তার একাধিক অভিযান চলেছিল। ইনি মগধ অধিকার করেছিলেন এবং উড়িষ্যার কঙ্গোদ দখল করে নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত  করেছিলেন। হর্ষচরিত থেকে আরো জানা যায় যে, তিনি কোনো এক তুষারাবৃত দেশ অভিযান করেছিলেন। এটি সম্ভবত হিমালয় সন্নিহিত তুখার নামে ছোট্ট একটি রাজ্য।

আইহোল লিপিতে রবিকীর্তি হর্ষবর্ধনকে 'সকলোত্তরপথনাথ' বলে উল্লেখ করেছেন। এর অর্থ হর্ষবর্ধন সমগ্র উত্তর ভারতের  অধীশ্বর হয়েছিলেন। এই মন্তব্য নিয়ে সন্দেহ আছে। হিউ এন সাং এর লেখা থেকে জানা যায়, উত্তর ভারতের এমন অনেক রাজ্য ছিল যেখানে হর্ষের কোন আধিপত্য ছিল না। হিউ এন সাং হর্ষকে পঞ্চভারতের অধীশ্বর বলেছেন। আধুনিক ঐতিহাসিকদের মতে,  এই পঞ্চভারত  হল পূর্ব পাঞ্জাব, কনৌজ, মিথিলা, গৌড় ও উৎকল। সুতরাং বলা যায়, সম্ভবত বিজয়ী রাজা দ্বিতীয় পুলকেশীর কৃতিত্বকে গৌরবান্বিত করার জন্যই আইহোল লিপিতে এরকম অতিরঞ্জন করা হয়েছে। 

Political Contributions of Harsha Vardhana

Harshavardhana was a significant figure in the post-Gupta political landscape of northern India. He ascended the throne at the young age of 16 and, through his remarkable abilities, established a vast empire across north India. His contemporary and rival in southern India, the Chalukya ruler Pulakeshin II, referred to him as Sakalottarapathanatha (Lord of the entire northern region). The history of Harsha’s reign is primarily known from his court poet Banabhatta’s Harshacharita, the travel accounts of the Chinese traveler Xuanzang, the Banskhera inscription, and the Aihole inscription of Pulakeshin II.

Harshavardhana belonged to the Pushyabhuti dynasty of Thanesar. The ruler of Gauda, Shashanka, and the Malwa king Devagupta jointly attacked Kannauj, where Grahavarman of the Maukhari dynasty was the ruler. Grahavarman was married to Rajyashri, the sister of Rajyavardhana (Harsha’s elder brother), the ruler of Thanesar. In an attempt to protect his brother-in-law’s kingdom, Rajyavardhana waged war against Shashanka and Devagupta but was eventually killed by Shashanka. Meanwhile, Grahavarman also died, and Rajyashri was captured, leaving the throne of Kannauj vacant. In this situation, Harsha assumed control over both his paternal kingdom, Thanesar, and the kingdom of his brother-in-law, Kannauj, establishing the latter as his capital in 606 CE.

Following his coronation, Harsha launched a military campaign against Shashanka, forcing him and Devagupta to retreat. During this campaign, Harsha allied with the Kamrupa ruler Bhaskaravarman. He first rescued his sister Rajyashri from the Vindhya forests and then advanced towards Bengal. However, the outcome of his conflict with Shashanka remains uncertain. According to historian Ramesh Chandra Majumdar, Harsha was unable to weaken Shashanka’s rule while he was alive. After Shashanka’s death, Harsha annexed Magadha and Ganjam to his empire.

Harsha aspired to expand his rule across India, as indicated in the Harshacharita. He launched campaigns against the kingdoms of Balabhi and Gurjara and attempted to invade the Chalukya kingdom. During the reign of Dhruvasena II Baladitya, Balabhi was a powerful state in western India. Harsha was unsuccessful in defeating the Balabhis but eventually entered into a diplomatic alliance by marrying his daughter to the Balabhi king. Meanwhile, the Gurjaras, seeking protection from Harsha, allied with the Chalukya ruler Pulakeshin II.

Pulakeshin II, Harsha’s contemporary in southern India, is credited in the Aihole inscription with ruling over Malwa, Gujarat, and the Gurjara region. This territorial overlap likely led to conflicts between Harsha and Pulakeshin. The Aihole inscription states that Harsha was decisively defeated in this battle, ending his ambitions of conquering southern India.

Despite his failure in the south, Harsha continued military campaigns elsewhere. He launched an invasion of Sindh, plundering the region, though he could not establish control over it. In the east, he conquered Magadha and annexed Kangoda in Odisha into his empire. The Harshacharita also suggests that Harsha conducted an expedition in a snow-covered region, possibly a small Himalayan kingdom called Tukhar.

In the Aihole inscription, Ravikirti referred to Harsha as Sakalottarapathanatha, implying his sovereignty over all of northern India. However, this claim is disputed. Xuanzang’s writings indicate that several northern Indian states remained independent of Harsha’s control. Instead, Xuanzang described him as the ruler of Pancha-Bharata (Five Regions of India), which modern historians interpret as Eastern Punjab, Kannauj, Mithila, Gauda, and Utkala. Thus, it is likely that the Aihole inscription exaggerated Harsha’s achievements to glorify Pulakeshin II’s victory over him.

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য Please visit our Homepage and subscribe us. Suggested Topics || Ghajnavid Invasion || গজনী আক্রমণ || || মামুদের সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন || Somnath Temple Plunder || || তরাইনের যুদ্ধ ও তার গুরুত্ত্ব || মহম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমন ও তার চরিত্র || সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আ...

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগ...

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হ...