অবশিল্পায়ন বিতর্ক
Global contribution in World GDP |
অবশিল্পায়ন বলতে সব্যসাচী ভট্টাচার্য বুঝিয়েছেন, যদি দেশের মানুষ শিল্পকর্ম ছেড়ে চাষাবাদের জীবিকা অর্জন শুরু করে অর্থাৎ জাতীয় আয়ে কৃষিজ অংশ বাড়তে থাকে এবং শিল্পজ অংশ কমতে থাকে তাকে অবশিল্পায়ন বলে। ভারতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অন্যতম ফলশ্রুতি ছিল অবশিল্পায়ন। যদিও ঔপনিবেশিক ঐতিহাসিকগণ অবশিল্পায়ন তত্ত্ব মানতে চান না।
মুঘল যুগ থেকে কুটির শিল্পে ভারত বিশ্বে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করেছিল। বিশেষ করে বস্ত্র শিল্পের খ্যাতি ছিল জগৎজোড়া। ইংল্যান্ডে প্রথম শিল্প বিপ্লব হয়েছিল। তার নেগেটিভ প্রভাব পড়েছিল ভারতে। শিল্প বিপ্লব এবং ঔপনিবেশিক শাসন নীতির যৌথ আঘাতে ভারতে কুটির শিল্পের অবক্ষয় সূচিত হয়।
অনেক ঐতিহাসিক অবশ্য অবশিল্পায়নের পশ্চাতে ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লব বা ঔপনিবেশিক ষড়যন্ত্রকে দায়ী করেন না। তাদের মতে সমসাময়িক রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা, যেমন বর্গী আক্রমণ, ছিয়াত্তরের মন্বন্তর, ফকির ও সন্ন্যাসী বিদ্রোহ প্রভৃতি ঘটনা কুটির শিল্পের অগ্রগতির পথে অন্তরায় হয়েছিল। ডি. আর. গ্যাডগিল মনে করেন, আঠারো উনিশ শতকে দেশীয় রাজাদের ক্ষমতা হারানোর ফলে তাদের দরবারে কুঠির শিল্পজাত পণ্যের যে চাহিদা ছিল তা আর থাকে না। বস্তুত এই সমস্ত কারণে দেশীয় শিল্পের সাময়িক ক্ষতি হলেও কোন স্থায়ী বিপর্যয় ঘটে নি।
ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লবের পর থেকে প্রকৃতপক্ষে ভারতে কুটির শিল্পের বিনাশ সাধন শুরু হয় । শিল্পায়নের জন্য ইংল্যান্ডের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল সস্তায় প্রচুর কাঁচামাল এবং উৎপাদিত পণ্যের ভালো বাজার। অন্যান্য উপনিবেশের মতই ইংল্যান্ড ভারতকেও কাঁচামাল উৎপাদনকারী ও ভোগ্যপণ্য আমদানিকারী দেশে পরিণত করেছিল। ইংল্যান্ডে মিলের কাপড় সস্তায় যাতে ভারতে আমদানি হয় তার জন্য মিলের কাপড়ের উপরে আমদানি শুল্ক কমিয়ে 2.5 শতাংশ আনা হয়। ফলে মিলের কাপড়ে দেশের বাজার ভরে যায় এবং অসম প্রতিযোগিতায় দেশীয় বস্ত্র তার বাজার হারায়। অন্যদিকে ইংল্যান্ডে ভারতীয় বস্ত্রের উপরে অস্বাভাবিক হারে শুল্ক চাপিয়ে সেদেশে ভারতীয় পণ্য বিক্রি বন্ধের পাকাপাকি বন্দোবস্ত করা হয়।
মার্কিন গবেষক মরিস ডি মরিস অবশ্য অবশিল্পায়ন তত্ত্বকে অস্বীকার করেছেন। তার মতে, জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে এবং জাতীয় আয় বৃদ্ধি পেলে জাতীয় শিল্পকে অক্ষত রেখে আমদানি বাড়ানো যেতে পারে। দ্বিতীয়তঃ আমদানি বৃদ্ধি পেলে জাতীয় শিল্পের কোনো কোনো ক্ষেত্রে ক্ষতিসাধন হলেও অন্যান্য ক্ষেত্রে দেশীয় শিল্পের বৃদ্ধি ঘটে; যেমন 19 শতকে সুতা কাটুনিরা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সস্তায় বিলিতি সুতো কিনে কাপড় বুনে প্রতিযোগিতা করতে পারত। তৃতীয়তঃ কুটির শিল্পজাত পণ্যের বাজার বরাবরই বজায় থাকে, তার প্রতিযোগিতা দেশীয় শিল্পের সাথে কখনই নয়।
মরিসের বক্তব্য নানাভাবে সমালোচিত হয়েছে। জাপানি ঐতিহাসিক তরু মৎসুই দেখিয়েছেন 19 শতকে তাঁতিদের সংখ্যা এবং অবস্থার কি অবনতি ঘটেছিল। বিপান চন্দ্র দেখিয়েছেন, এদেশে সুতোর আমদানি শুরু হয়েছিল বিলেতি পণ্যের বাজার দখল করার অনেক পরে। ততদিনে তাঁতিরা শেষ হয়ে গেছিল। সব্যসাচী ভট্টাচার্য দেখিয়েছেন উনিশ শতকে জাতীয় আয় বৃদ্ধির কোন প্রমাণ নেই। সুতরাং বলাই যায় অবশিল্পায়ন কোন অলীক কল্পনা নয়, বরং বাস্তব।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন