সমুদ্র গুপ্তের রাজনৈতিক অবদান
কুষাণদের পতনের ৫০ বছর বা তার অল্প কিছু পরে উত্তর ভারতে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসেবে গুপ্তদের উত্থান ঘটে। প্রথম গুপ্ত রাজা শ্রীগুপ্ত। তবে প্রথম শক্তিশালী গুপ্ত সম্রাট হলেন প্রথম চন্দ্রগুপ্ত। আর যে সম্রাটের সময় গুপ্ত সাম্রাজ্য বিস্তৃত রূপ ধারণ করেছিল তিনি হলেন সমুদ্রগুপ্ত। সমগ্র উত্তর ভারতে সমুদ্রগুপ্ত তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন এবং দক্ষিণ ভারতের পূর্ব উপকূলে, এমনকি উপমহাদেশের বাইরেও তার প্রভাব বিস্তৃত হয়।
সমুদ্রগুপ্তের মুদ্রা |
সমুদ্রগুপ্তের উত্তর ভারত আভিযান
এলাহাবাদ প্রশস্তি থেকে সমুদ্রগুপ্তের রাজনৈতিক কৃতিত্বের বিবরণ পাওয়া যায়। এছাড়াও এরান(মধ্যপ্রদেশ) লেখ এবং বেশ কিছু মুদ্রা সমুদ্র গুপ্ত সম্পর্কে তথ্য প্রদান করে। এলাহাবাদ প্রশস্তির সপ্তম স্তবকে এবং একাদশ স্তবকে সমুদ্রগুপ্তের উত্তর ভারত জয়ের বিবরণ আছে। তিনি উত্তর ভারতের নয়জন রাজাকে পরাজিত করেন। এরা হলেন রুদ্রদেব (বিদিশার রাজা), মতিল (বুলন্দ রাজা ), নাগ দত্ত (দত্ত নামধারী উত্তরবঙ্গীয় রাজা), চন্দ্রবর্মন (পুষ্করণা অঞ্চলের রাজা), গণপতিনাগ (গঙ্গা যমুনা দোয়াব অঞ্চলের শাসক), নাগসেন (মথুরা ও সন্নিহিত অঞ্চলের নাগ বংশের রাজা), অচ্যুত (অহিচ্ছত্র রাজা), নন্দিন (নাগ বংশের শাসক) এবং বলবর্মন (নাগ বংশের শাসক)। এদের রাজ্যগুলিকে নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন বলে সমুদ্র গুপ্তের উত্তর ভারতের রাজ্যজয় নীতি 'উন্মূল্য' নামে পরিচিত।
উপরোক্ত নয়জন শাসক ছাড়াও সমুদ্র গুপ্ত কোত বংশীয় এক রাজাকে (কোতকুলরাজ) পরাস্ত করেন। পূর্বে রাঢ় বা পুন্ড্রবর্ধন থেকে পশ্চিমে গাঙ্গেয় উপত্যকার উপরিভাগ পর্যন্ত সকল আটবিক রাজ্য তিনি জয় করেন।
দক্ষিণ ভারত অভিযান
এরপর তিনি দাক্ষিণাত্য জয়ে উদ্যোগী হন। তিনি দাক্ষিণাত্যের ১২ জন রাজাকে পরাজিত করেন। এরা হলেন বিষ্ণুগোপ (কাঞ্চি), হস্তী বর্মন (বেঙ্গি), নীলরাজ (অবমুক্তা), উগ্রসেন (পলাক্ক), স্বামীদত্ত (কট্টর), ধনঞ্জয় (কুস্থলপুর ) কুবের (দেবরাষ্ট্র ), মহেন্দ্রগিরি (পিষ্ঠপুরম ), দমন (এরন্ডপল্ল), মহেন্দ্র (কোশল ), ব্যাঘ্ররাজ (মহাকান্তার) ও মন্তরাজ (কৌরল)। দাক্ষিণাত্য অভিযানের ক্ষেত্রে তিনি 'গ্রহণমোক্ষানুগ্রহ' নীতি গ্রহণ করেছিলেন। গ্রহন্মোক্ষানুগ্রহ বলতে-- গ্রহণ (রাজ্য জয়), মোক্ষ (পরাজিত রাজ্যকে মুক্তিদান) ও অনুগ্রহ(বশ্যতা স্বীকার করলে রাজ্য প্রদান)। অর্থাৎ তিনি রাজ্যগুলি নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত না করে কর ও আনুগত্যের বিনিময়ে পূর্বতন শাসকদের হাতে ফিরিয়ে দেন।দক্ষিণ ভারতে কেন এই নীতি গৃহীত হয়েছিল তাই নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্ক আছে। অনেকেই মনে করেন যে, কাঞ্চির পল্লবদের কাছে অপ্রতিরোধ্য বাধা পেয়ে তিনি বিজিত এলাকা গ্রাস করতে অসমর্থ হন। তবে অপেক্ষাকৃত বেশি গ্রহনযোগ্য অভিমতটি হল-- এলাহাবাদ প্রশস্তির বিবরণ যদি রাজ্যজয়ের ক্রমপর্যায় অনুশারে হয় তাহলে মনে করা যেতে পারে, তিনি উত্তর ভারতের সামরিক সাফল্যের পর দক্ষিনাপথ অভিযান করেন। কিন্তু ইতিমধ্যে উত্তর ভারতে প্রতিপক্ষরা (অচ্যুত, নাগসেন, গনপতিনাগ--সপ্তম স্তবকে উল্লিখিত) আবার বিরোধিতা শুরু করলে সমুদ্রগুপ্ত তার দক্ষিন ভারত অভিযান অসমাপ্ত রেখে উত্তর ভারত প্রত্যাবর্তন করেন এবং পূর্ববর্তী তিন এবং আরও ছয় রাজ্য অর্থাৎ মোট নয়টি রাজ্যকে পরাস্ত করেছিলেন। তাই পরিস্থিতি এবং সময় তাকে দক্ষিণ ভারতে ভিন্ননীতি গ্রহনে বাধ্য করেছিল। এ প্রসঙ্গে আরও একটি যুক্তি বেশ গ্রহণযোগ্য। এলাহাবাদ প্রশস্তির দ্বাদশ স্তবক থেকে জানা যায় সমুদ্রগুপ্ত শ্রীলঙ্কাসহ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দ্বীপগুলির সঙ্গে নিয়মিত সম্পর্ক বজায় রাখার প্রয়াস করতেন। তাই মনে করা হয় এই দেশগুলির সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্যই তিনি পূর্ব উপকূলকে কেবল নিয়ন্ত্রনে রাখতে চেয়েছিলেন এবং এর জন্য পূর্ব উপকূলকে সাম্রাজ্যভূক্ত না করলেও চলত, কেবল অনুগত বানালেই হত। আর মনে রাখতে হবে যে, সমুদ্রগুপ্তের দক্ষিণ ভারত অভিযান পূর্ব উপকূলেই সীমাবদ্ধ ছিল।
সীমান্তবর্তী রাজ্য ও অন্যান্য
সীমান্তের পাঁচটি রাজ্য তার করদ রাজ্যে পরিণত হয়েছিল, যথা: নেপাল, কর্তৃপুর, সমতট, দাভক ও কামরূপ। এছাড়া নয়টি অরাজতান্ত্রিক গোষ্ঠী তার কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল। এগুলি হল সনকানিক, খারপারিক, আভীর, কাক, মদ্রক, যৌধেয় ও প্রার্জুন।সমকালীন আরও কয়েকটি রাজ্য সমুদ্রগুপ্তের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখে চলতেন। এরা স্বেছায় আনুগত্য প্রদর্শন করতেন, গুপ্ত নামমুদ্রা ও শীলমোহর পেতে চাইতেন এবং কন্যাদান করে ধন্য হতেন। এলাহাবাদ প্রশস্তি অনুযায়ী এরা হলেন কোন এক কুষাণ শাসক, কোন এক শক শাসক এবং সিংহলের শাসক। তবে এরা করদ শাসক ছিলেন না।
এভাবে একের পর এক রাজ্য জয়ের শেষে তিনি অশ্বমেধ যজ্ঞ করেন এবং পরাঙ্কদেব, একরাট, সর্বরাজোচ্ছেত্তা ও অপ্রতিরথ উপাধি নেন। তাঁর সাম্রাজ্যবাদী কার্যকলাপ বিচার করে ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথ সমুদ্র গুপ্তকে ভারতের নেপোলিয়ান আখ্যা দিয়েছেন। রাধাকুমুদ মুখার্জির মতে তাঁর হাত ধরে উপমহাদেশে হিমালয় থেকে দক্ষিণে নর্মদা, পূর্বে ব্রহ্মপুত্র পর্যন্ত রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়। তাঁর কিছু অন্য গুনও ছিল কাব্যচর্চার জন্য সমুদ্রগুপ্ত কবিরাজ উপাধি পেয়েছিলেন। তাঁর প্রচলিত মুদ্রা থেকে জানা যায় তিনি সঙ্গীতানুরাগীও ছিলেন।
Thanks for reading.
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন