আকবরের রাজপুত নীতি
আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় ভারতের আঞ্চলিক রাজ্যগুলির মধ্যে রাজপুতদের শক্তি ছিল সবচেয়ে বেশি। আবুল ফজলের বিবরণীতে তাদের সামরিক শক্তির বিবরন আছে। আকবর সহজেই উপলব্ধি করেন যে এই শক্তিশালী জনগোষ্ঠীকে শত্রু না বানিয়ে রাষ্ট্রপরিচালনায় এদের সহযোগী করে তোলাই সাম্রাজ্যের পক্ষে মঙ্গলজনক। তাই এক্ষেত্রে তিনি কূটনীতির আশ্রয় নিলেন। আকবরের রাজপুত নীতির তিনটি পর্ব লক্ষ্য করা যায়ঃ ১৫৭২ খ্রিস্টাব্দে গুজরাট অভিযান পর্যন্ত প্রথম পর্ব, ১৫৭৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দ্বিতীয় পর্ব এবং ১৫৭৮ এর পরে অবশিষ্ট বছরগুলি হলো তৃতীয় পর্ব।
সুলতানি শাসনে একমাত্র আলাউদ্দিন খলজি ছাড়া কেউই রাজপুতদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করেননি। হুমায়ুন অবশ্য বুঝেছিলেন যে স্থানীয় রাজন্যবর্গের সঙ্গে একটি স্থায়ী সম্পর্ক গড়ে তোলা দরকার। এই উদ্দেশ্যে তিনি রাজপুতদের আফগান মিত্রতা থেকে সরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। বৈরাম খাঁ নিজ আধিপত্য নিরঙ্কুশ করার জন্য চুগতাই অভিজাতদের দমন করে রাজপুতদের ক্ষমতার ভাগ দিয়েছিলেন।
১৫৬১-৬২ খ্রিস্টাব্দে আকবর রাজপুতনায় বিবাহ-কূটনীতি চালু করেছিলেন। সে সময় অম্বর-এর রাজা ভরমল মেওয়াটের মুঘল হাকিমের হাতে নানা ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে আকবরের স্মরণাপন্ন হন। ভারমলকে রক্ষার শর্ত হিসেবে আকবর তার আনুগত্য এবং কন্যার পানি দাবি করেন। শেষ পর্যন্ত ভারমল তার শর্ত পূরণ করলে যথেষ্ট মর্যাদার সঙ্গে আকবর ও হরখাবাঈয়ের বিবাহ সম্পন্ন হয়। এরপর কয়েক বছরের মধ্যে পান্না, গড়কটাঙ্গ,ভাটা-খোরা প্রভৃতি রাজ্যগুলির সঙ্গে মৈত্রীপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করেন। ১৫৬২-৬৪ এর মধ্যে তিনি কতকগুলি জনপ্রিয় সিদ্ধান্ত নেন; পরাজিত রাজ্যের নারী ও শিশুদের বাধ্যতামূলক দাসে পরিণত করার প্রথা তুলে দেন, হিন্দু তীর্থযাত্রী কর এবং জিজিয়া কর প্রত্যাহার করে দেন।
অম্বরের রাজা ভারমল যেভাবে মুঘলদের প্রতি আনুগত্য দেখিয়েছিলেন অন্যান্য রাজপুত শক্তিগুলির ততটা আগ্রহ ছিল না। এদের মধ্যে অন্যতম ছিল মেবার। আকবরের মেবার আক্রমণের পশ্চাদে যদিও সমৃদ্ধ গুজরাটকে নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্যও ছিল। মালবের পলাতক শাসক রাজা বাজবাহাদুরকে মেবারের রানা উদয় সিংহ আশ্রয় দিয়ে আকবরের বিরাগভাজন হন। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই আকবর মেবার আক্রমণ করেন। কয়েক মাসের মধ্যেই মঙ্গলগড়, চিতোরগড় মোগলদের হাতে চলে যায়। উদয় সিংহ নতুন রাজধানী উদয়পুর থেকে মোগলদের বিরুদ্ধে বিরোধিতা করে যান। উদয় সিংহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র প্রতাপ সিংহ রাজধানী চিতোর পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট হন। ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে রাজা মানসিংহের নেতৃত্বাধীন মুঘল বাহিনী হলদিঘাটের যুদ্ধে প্রতাপ কে পরাজিত করেন। মেবারের দক্ষিণ-পশ্চিম পার্বত্য এলাকায় প্রতাপের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। প্রতাপের দুই ভাই জগমাল এবং শক্তি সিংহ উচ্চ মনসব এবং জাগির পান। মেবারের এক সামন্ত রাজপুরার রায়দুর্গা শিশোদিয় একইভাবে মোগলদের পক্ষে চলে আসে।
এরপর কাছোয়া রাজপুত রাজ্য অম্বরের রাজাকে বংশানুক্রমিক উচ্চ মনসব দেওয়ার প্রথা চালু করেন, যা ঔরঙ্গজেব পর্যন্ত চলেছিল। এই প্রথম প্রথা ভেঙে তিনি রাজা মানসিংহ কে ১০ হাজারি মনসব প্রদান করেন। রাজ পরিবারের বাইরে ও রাজপুত সামন্তদের ও উচ্চ মনসব দেওয়া হয়। এদের নিজ রাজ্যকেই ওয়াতান জাগীর এর মর্যাদা দেওয়া হল ১৮৮৬-৮৭ সালে কাছোয়া পরিবারের চার সদস্য জগন্নাথ, রাজা অক্ষরণ, ভগবন্ত দাস এবং মানসিংহ সুবা আজমীর, আগ্রা, লাহোর, এবং কাবুলের আমীরের পদ লাভ করেন। বহু ক্ষেত্রে নিজও ওয়াতন থেকে যে পরিমান রাজস্ব আদায় হত তার থেকে মনসব পদের বেতন ছিল বেশী। সেই অতিরিক্ত বেতন মিটিয়ে দেওয়া হত অন্যত্র জাগীর প্রদানের মাধ্যমে, যেমনঃ মানসিংহকে মালব এবং পরে পাঞ্জাবে জাগীর দেওয়া হয়।
রাজপুতানার সঙ্গে আকবরের সম্পর্ক আরো নিবিড় হয় চিতর ও রনথম্বোর এর পতনের পর। বিকানীরের রাজা কল্যানমল তার ভাইয়ের কন্যাকে আকবরের সাথে বিবাহ দেন। জয়সলমীর এর রাজকন্যা ও যোধপুরের রাজকন্যার সাথেও তার বিবাহ হয়। শিরোহি এবং বাঁশওয়ারার রাজারাও মুঘলদের অধীনতা স্বীকার করে মনসব ও জায়গীর লাভ করেন। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে যুবরাজ সেলিমের সঙ্গে ভগবান দাস এর কন্যা মানবাঈয়ের বিবাহ হন। যোধপুরের মোটারাজের কন্যা জগতগোঁসাই, বিকানিরের রাজকন্যা এবং জয়সলমীরের রাজকন্যার সাথে সেলিমের বিবাহ হয়।
একমাত্র উদয়পুর (চিতোর) ছাড়া রাজপুতানার সমস্ত রাজশক্তির সাথে আকবরের একটা বোঝাপড়াভিত্তিক সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছিল এবং কাছোয়াদের প্রতি আকবর একটু বেশিই দুর্বল ছিলেন। কিন্তু কোন সময়েই তাঁর সারবভৌমত্ত্বের অধিকার বিস্মিত হন নি। সুযোগ পেলেই রাজপুতানার উপর নিরঙ্কুশ অধিকার প্রতিষ্ঠা করতেন। ১৫৮৩ খ্রীঃ মাড়োয়ারের রাজা মালদেবের মৃত্যুর পর গদি নিয়ে চন্দ্রসেন ও রামরাঈয়ের মধ্যে দ্বন্দ দেখা দিলে আকবর সমগ্র মাড়োয়ার নিজ হাতে রাখেন এবং পরে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ উদয় সিংহের হাতে দেন। ভট্টার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছিল। যদিও মাড়োয়ার ছিল মালদেবের ওয়াতন জাগির। নাগোরকোটে বিদ্রোহ দেখা দিলে একই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল।
পরিশেষে, মনসব পদ গ্রহনের মাধ্যমে রাজপুত রাজ্যগুলি আক্ষরিক অর্থে নিজেদের স্বাধীনতা খুয়েইছিল। কিন্তু আকবরের সাথে সুসম্পর্কের ফলে রাজপুতদের আর্থিক শ্রীবৃদ্ধির পথ খুলে গেছিল।রাজপুতদের কাছে মুঘল দরবারে চাকুরি ছিল যথেষ্ট লাভজনক। যদিও রাজপুতানার নিজস্ব রাজ্যকে ওয়াতন জাগীর হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল, কিন্তু তাঁরা যে তনখা জাগীর লাভ করেছিল তা বেশ লাভজনক ছিল। অন্যদিকে, রাজপুত রাজাদের সাহায্যে আকবর মুঘল সাম্রাজ্য বিস্তারের ব্যবস্থা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সতীশচন্দ্র বলেছেন, মিরজা হাকিমের বিদ্রোহ দমনের পর থেকে মুঘল-রাজপুত মৈত্রীর বন্ধন যে দৃঢ় হয় তারপর থেকে আকবর ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে রাজপুত বাহিনিকে পাঠাতে থাকেন।
এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।
উত্তরমুছুনএই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।
উত্তরমুছুন