সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

The Political Idea of Balban | বলবনের রাজতান্ত্রিক আদর্শ

বলবনের রাজতান্ত্রিক আদর্শ



গিয়াসউদ্দিন বলবনের 22 বছরের শাসনকাল সুলতানি সাম্রাজ্যের ইতিহাস অন্যতম স্থান অধিকার করে আছে। ১২৬৫ খ্রিস্টাব্দে নাসির উদ্দিন মোহাম্মদ নিঃসন্তান অবস্থায় মারা যান, মৃত্যুর পূর্বেই তিনি বলবন কে সিংহাসনে উত্তরাধিকারী মনোনীত করেছিলেন। বলবনের রাজতন্ত্রের মর্যাদা ও শক্তি বৃদ্ধির জন্য সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন। ইলতুৎমিশের মৃত্যুর পর প্রায় 30 বছর ধরে দিল্লি সুলতানির বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়েছিল। বলবন প্রথমেই রাজতন্ত্রের মর্যাদা ও শক্তি বৃদ্ধির কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় বুঝেছিলেন তুর্কি আমিরদের ক্ষমতা বিনষ্ট না করা পর্যন্ত রাজকীয় মর্যাদা ও ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। তিনি এও বুঝেছিলেন রাজশক্তিকে দৃঢ়রূপে প্রতিষ্ঠা করতে গেলে সুগঠিত সেনাবাহিনী আবশ্যক।

তিনি প্রথমেই রাজদরবারের মর্যাদা ও গাম্ভীর্য রক্ষার দিকে নজর দেন। পারস্যের রাজদরবারের অনুকরনে তিনি কতগুলি নতুন নীতি প্রণয়ন করেন। তিনি নিজেকে তুর্কি বীর আফ্রাসিয়রের বংশধর বলে দাবি করেন। পারসিক আদব কায়দায় তিনি রাজদরবারে সিজদা ও পায়বক্স রীতি প্রবর্তন করেন, যার অর্থ নতজানু হয়ে সিংহাসনের পদচুম্বন করা। তিনি শরীয়তের বিধান অনুযায়ী ধর্মকে রক্ষা করা ও দোষীর শাস্তি বিধান করার নীতি মেনে চলতেন। অভিজাত ও ব্যক্তি নন এমন কাউকে উচ্চ পদে নিয়োগ করতেন না।

তিনি অনুভব করেছিলেন চল্লিশচক্র এর ক্ষমতা খর্ব না করলে রাজতন্ত্রের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা যাবে না। তিনি নানা উপায় অবলম্বন করে চল্লিশ চক্র কে ধ্বংস সাধন করেন ও রাজ্যে শান্তিশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন।

বলবন সামরিক বিভাগকে সুগঠিত করার উদ্দেশ্যে ইমাদ- উল- মূলক নামে এক অত্যন্ত যোগ্য ব্যক্তি কে সামরিক বিভাগ এর মন্ত্রী পদে নিয়োগ করেন। তিনি কঠোর নিয়মানুবর্তিতা প্রবর্তন করে সেনা বাহিনীকে শক্তিশালী করে তুলতে সমর্থ হয়েছিলেন। বলবন ক্ষমতা লাভের পরই আলওয়ার অঞ্চলের মেওয়াটি দস্যুদের দমন করেছিলেন। তবে বারবার মঙ্গল আক্রমণের কারণে তার পক্ষে নতুন সাম্রাজ্য বিস্তার করা সম্ভব হয়নি। এছাড়াও তার সময়ে বঙ্গদেশের শাসনকর্তা তুঘ্রীল খান দিল্লির অধীনতা অস্বীকার করলে, সুলতান স্বয়ং পুত্র বুঘড়া খানকে নিয়ে বঙ্গদেশ অভিযান করেছিলেন এবং নির্মমভাবে বিদ্রোহ দমন করেছিলেন।

বলবনি প্রথম শাসক যিনি উপলব্ধি করেছিলেন উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে নিরাপত্তার উপর ভারতের নিরাপত্তার নির্ভর করছে। তিনি উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলে দুর্গ নির্মাণের আদেশ দেন ও প্রথমে তার নিকট আত্মীয় শেরখান সাঙ্কর কে উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে দায়িত্ব দেন ও তার মৃত্যুর পর বলবন তার দুই পুত্র মোহাম্মদ ও বুঘরা খানকে উত্তর-পশ্চিম প্রদেশের নিরাপত্তার জন্য নিযুক্ত করেছিলেন। ১২৮৬ খ্রিস্টাব্দের মোঙ্গল আক্রমণ প্রতিহত করতে গিয়ে বলবনের পুত্র মোহাম্মদ নিহত হলে বলবন ভগ্নহৃদয়ে লাহোর অভিযান করেন, লাহোর পুনরুদ্ধার করলেও ওই বছরই তার মৃত্যু হয়।

পরিশেষে বলা যায় ইলতুৎমিশের মৃত্যুর পর বলবনের মত একজন কঠোর দৃঢ়চেতা শাসকের উত্থান না ঘটলে দিল্লি সুলতানি সাম্রাজ্যকে রক্ষা করা কঠিন হতে পারত। তাই বারনি লিখেছেন "sultan with his sword secured many people of God from being molested and plunder by the Heos."

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য Please visit our Homepage and subscribe us. Suggested Topics || Ghajnavid Invasion || গজনী আক্রমণ || || মামুদের সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন || Somnath Temple Plunder || || তরাইনের যুদ্ধ ও তার গুরুত্ত্ব || মহম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমন ও তার চরিত্র || সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আ...

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগ...

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হ...