সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

বাংলায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত / Permanent Settlement in Bengal

বাংলায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত



চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও জমিদার দের সাথে জমিস্বত্ব ও রাজস্ব আদায় সংক্রান্ত একটি চুক্তি, যার মাধ্যমে জমিদাররা শর্তসাপেক্ষে জমির উপর চিরকালীন স্বত্ব লাভ করেছিল। প্রথমে বাংলা, বিহার ও উড়িশার উপর এই ব্যবস্থা কার্যকর করা হয় এবং পরবর্তীকালে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সীর উত্তর অংশে প্রযুক্ত হয়। চিরস্থায়ী ব্যবস্থা গ্রামবাংলার সমকালীন সমাজ ও অর্থনীতিকে দারুনভাবে প্রভাবিত করে। 

প্রেক্ষাপট

মুঘল আমল থেকে বঙ্গদেশে জমিদাররা রাজস্ব আদায়ের কাজে যুক্ত থাকত। মুঘল দেওয়ান ও তার অধীনস্ত জাগিরদাররা রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে জমিদারদের উপর নির্ভরশীল ছিল। ১৭৬৫ সালে বক্সারের যুদ্ধে জয়লাভের পর মুঘল বাদশাহ দ্বিতীয় শাহ আলমের কাছ থেকে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী বাংলা বিহার ও উড়িশার দেওয়ানীর অধিকার পায়। কোম্পানির অন্যতম উদ্দেশ্যই ছিল পর্যাপ্ত পরিমানে রাজস্ব বাবদ আয় বৃদ্ধি। কিন্তু তা সম্ভব হচ্ছিল না, যার অন্যতম কারণ দ্বৈতশাসন অর্থাৎ পৃথক ফৌজদারের উপস্থিতি। তাই ১৭৭০ এর ভয়ানক দুর্ভিক্ষের দায় রেজা খা ও সিতাব রায়ের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়। কোম্পানীর কলকাতা প্রেসিডেন্সির গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংস দ্বৈতশাসনের অবসান ঘটান। হেস্টিংস ভূমিরাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন তার ফল হয় ভয়ানক। তার প্রবর্তিত ইজারাদারি ব্যবস্থায় নীলামের মাধ্যমে সরবোচ্চ রাজস্ব প্রদানের প্রতিশ্রুতি প্রদানকারীকে ৫ বছরের জন্য জমি দেওয়া হত, যা পাঁচসালা ব্যবস্থা (১৭৭২-৭৭) নামে পরিচিত। এই ব্যবস্থায় অনভিজ্ঞ বেনিয়াদের হাতে জমি চলে যায়, যার ফলে কোম্পানির প্রায় ২ কোটি ২০ লক্ষ টাকার রাজস্বে ঘাটতি হয়। এবার হেস্টিংস জমিতে ইজারাদারদের বাতিল করে জমিদারদের পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করলেন, তবে নিলামের মাধ্যমেই এবং ১ বছরের চুক্তিতে। এই ব্যবস্থা একসালা ব্যাবস্থা নামে পরিচিত। নিলাম ব্যবস্থাই আবার কাল হল। যুক্তিপূর্ণ রাজস্ব নির্ধারণ না হওয়ায় একসালা ব্যবস্থাও ব্যর্থ হল। এই প্রেক্ষিতে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ও পরিচালন সভা নতুন করে ভাবতে শুরু করলেন। 

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন ও শর্তাবলী

১৭৮৬ খ্রীঃ কর্নওয়ালিস গভর্নর জেনারেল হয়ে ভারতে আসেন। তার প্রধান কাজ ছিল রাজস্ব সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান করা এবং ঔপনিবেশিক স্বার্থে জমিদারদের সঙ্গে কোম্পানীর একটা সুসম্পর্ক গড়ে তোলা। ফিজিওক্র্যাট চিন্তাধারায় বিশ্বাসী জমিদার বংশের সন্তান কর্ণওয়ালিশ জমিদারী ব্যবস্থার পক্ষপাতী ছিলেন। ১৭৮৯ খ্রীঃ কর্নওয়ালিস বাংলা ও বিহারের জমিদারদের সাথে দশসালা বন্দোবস্ত করেন এবং বলা হয় কোম্পানীর পরিচালন সভার অনুমোদন এলে এই ১০ বছর মেয়াদের চুক্তি চিরস্থায়ী চুক্তিতে রুপান্তরীত হবে। এক্ষেত্রে বিরোধিতা এসেছিল রাজস্ব বিভাগের প্রধান জন শোর এবং দলিল বিভাগের প্রধান জেমস গ্রান্টের পক্ষ থেকে। জন শোর ১০ বছর পর চুক্তির সংস্করণ চেয়েছিলেন। আর গ্রান্ট চেয়েছিলেন সরাসরি কৃষকদের সাথে বন্দোবস্ত করতে।

১৭৯২ খ্রীঃ কোম্পানির পরিচালন সভার অনুমোদন এল। ১৭৯৩ এ দশসালা বন্দোবস্ত চিরস্থায়ী ব্যবস্থায় পরিণত হল। বলা হল জমিদাররা জমির উপর বংশানুক্রমিক অধিকার পাবে। তবে নির্দিষ্ট দিনে সূর্যাস্তের আগে প্রদেয় রাজস্ব কোম্পানীর কোশাগারে জমা করাতে হবে, নাহলে তার জমিদারী বাজেয়াপ্ত করা হবে। ১৭৮৯-৯০ এ আদায়কৃত মোট রাজস্বের ৯/১০ অংশ হারে প্রতি বছর রাজস্ব জমা দিতে হবে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে রাজস্ব মকুব হবে না। 

সরকারের উদ্দেশ্য 

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পশ্চাতে সরকারের উদ্দেশ্য কি ছিল তা নিয়ে বিতর্ক আছে। রজনীপাম দত্ত তার গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, কোম্পানী জমিদারদের জমি দিয়ে তাদের অনুগত মিত্র বানাতে চেয়েছিল।কারণ ক্রমবর্ধমান বিদ্রোহের পর্বে জমিদারদের তারা ঢাল হিসাবে ব্যবহার করতে চেয়েছিল। বিনয়ভূষণ চৌধুরী অবশ্য এই মত মানেন না। তাঁর মতে সেই সময় বাংলায় গনবিদ্রোহজনিত সমস্যা ছিল না। 

দ্বিতীয়ত, কোম্পানী রাজস্ব বাবদ আয় সম্পর্কে সুনিশ্চিত হতে চেয়েছিল। এবং রাজস্ব আদায় সংক্রান্ত ঝামেলা থেকে মুক্ত হতে ছেয়েছিল। অনেকজন কৃষকের কাছ থেকে রাজস্ব আদায়ের চেয়ে একজন জমিদারের কাছ থেকে আদায় অনেক সহজ। 

তৃতীয়ত, অশোক মিত্র বলেছেন, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু করে ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লবের স্বার্থে ভারতকে কৃষিনির্ভর করে রাখতে চেয়েছিল।

গ্রামসমাজে কি প্রভাব পড়েছিল 

চিরস্থায়ী বন্দবস্তে রাজস্বের হার জমিদারের জন্য সুনিশ্চিত হল। তবে জমি হারানোর দুশ্চিন্তা একেবারে দূর হল না। কারণ, সূর্যাস্ত আইন। রাজশাহি, দিনাজপুর, নদিয়া, বীরভূম, বিষ্ণুপুর প্রভৃতি এলাকার বহু জমিদার জমিদারী হারায়। এইসব জমিদারিগুলি অনেক ক্ষেত্রে ভুইফোড় জমিদারের হাতে চলে যায়। তবে দ্রুত জমিদাররা সংকট মোচনের রাস্তা খুঁজে পায়। সূর্যাস্ত আইনের অন্যতম প্রতিষেধক ছিল পত্তনি ব্যবস্থা। নিজের জমিদারী বিভিন্ন খন্ডে ভাগ করে পত্তনিদারদের হাতে রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ত্ব তুলে দেওয়া হয়। অনাবাসী ভুঁইফোড় জমিদারের ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটি বেশী লক্ষনীয়। ফলে গ্রামীন সমাজে বিভিন্ন স্তরে বিভক্ত বিপুল সংখ্যক মধ্যস্বত্বভোগীর আবির্ভাব ঘটে। 

কোম্পানী গ্রামীণ স্তরে এক অনুগত মিত্র সম্প্রদায় পেয়ে যায়। ফলে গ্রামীন কৃষক অসন্তোষ নিয়ন্ত্রন করা সম্ভবপর হয়। একই সাথে এই জমিদারের সন্তান সন্ততিরা অর্থের জোরে পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণ করে এবং বিভিন্ন সরকারী পদগুলিতে চাকুরী নেয়। এদের হাত ধরেই ১৯ শতকে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড সূচিত হয়। 

রমেশ চন্দ্র দত্ত চিরস্থায়ী ব্যবস্থার ভূয়সী প্রশংসা করলেও এই ব্যবস্থায় সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হয় কৃষকরা। কারণ একদিকে বিপুল সংখ্যক মধ্যস্বত্বভোগীর ভরণপোষণের বোঝা অন্যাদিকে জমিদারদের কৃষকদের নিরক্ষরতার সুযোগ গ্রহনের ফলে কৃষকরা সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ে। জমিদার ও সরকারে মধ্যে যেমন চুক্তি থাকত কৃষক ও জমিদের মধ্যে তেমন কিছু হত না। নিরক্ষর চাষীরাও কোথাও টিপসই দিতে ভয় পেত। ফলে তাদের কেবল জমিদারে কৃপার উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকতে হত। তার উপর ১৭৯৯ সালে সপ্তম আইনে রাজস্ব দিতে অপারগ কৃষককে জমি থেকে উৎখাত করার অধিকার দিয়ে জমিদারদের অপ্রতিহত ক্ষমতা দিয়ে দেওয়া হয়।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য Please visit our Homepage and subscribe us. Suggested Topics || Ghajnavid Invasion || গজনী আক্রমণ || || মামুদের সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন || Somnath Temple Plunder || || তরাইনের যুদ্ধ ও তার গুরুত্ত্ব || মহম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমন ও তার চরিত্র || সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আ

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগার:-   কোনো ব্যাক্তিগত বা অলাভজনক

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল তা জনজীবনে তীব্রভ