ফরাসী বিপ্লবের প্রাক্কালে অর্থনৈতিক সংকট
ফরাসি বিপ্লবের কারণ নিয়ে সমকালীন ও আধুনিক ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে। ফরাসি বিপ্লব সম্পর্কে আধুনিককালের ঐতিহাসিকরা প্রাক বিপ্লব যুগের ফরাসি অর্থনৈতিক সংকটের উপর জোর দিয়েছেন। যদিও সমকালীন ঐতিহাসিকরা অর্থনৈতিক কারণকে তেমনভাবে গুরুত্ব দেননি। অনেকেই আবার মনে করেন বিপ্লবের প্রাক্কালে ফরাসি অর্থনীতিতে কোনো সংকটের অস্তিত্বই ছিল না। তবে একথা বলা যায় যে, বিপ্লবের প্রাক্কালে ফ্রান্সের রাজকোষে প্রবল অর্থসংকট দেখা দিয়েছিল। এর প্রথম কারণটি যদি হয় রাজা চতুর্দশ লুইয়ের ঋণ নিয়ে যুদ্ধবিগ্রহের জড়িয়ে পড়া; অন্য কারণটি তেমনই ছিল রাজপরিবারের বিলাসবহুল জীবনযাপন। বুঁরবো রাজাদের আয় এর চেয়ে ব্যয় ছিল বেশি। চতুর্দশ লুই এর সময় থেকে রাজারা ঋণ নিয়ে যুদ্ধ করতেন এতে রাজার ঋণের পরিমাণ বেড়ে ছিল। আয়ের 50% ব্যাংকারদের সুদ দিতে হত। ষোড়শ লুই এর সময় এই ঋণ বেড়েছিল তিনগুণ।
বুঁরবো রাজারা সৈন্যবাহিনী ও রাজপ্রাসাদের কর্মচারীদের জন্য বাজেটের 50 শতাংশ ব্যয় করত। যে কারণে রাজার অর্থনৈতিক সংকট থেকে মুক্তির জন্য দরকার ছিল হয় ব্যয় কমানো অথবা আয় বাড়ানো। এই অর্থনৈতিক সংকট থেকে পরিত্রাণের আশায় রাজা 1789 খ্রিস্টাব্দের 5 ই মে স্টেটস জেনারেলের আহবান করলে বিপ্লব শুরু হয়ে যায়।
বিপ্লবের প্রাক্কালে ফ্রান্সের কৃষি অর্থনীতিতে বড় ধরনের বিপর্যয় দেখা দিয়েছিল। ফ্রান্সের কৃষি ব্যবস্থা ছিল ইউরোপের অন্যান্য দেশের মতো মধ্যযুগীয় ও অনগ্রসর। জর্জ লেফেভর দেখিয়েছেন, গত দশ বছর ধরে কৃষিতে এই সংকট চলছিল। বুরবঁ শাসকেরা আধুনিক কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তোলার দিকে নজর দেয় নি, অথচ কৃষিই ছিল আরথনীতির মেরুদন্ড। কৃষি ছাড়াও বিপ্লবের প্রাক্কালে শিল্প ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও সংকট দেখা দিয়েছিল। অনেকে ফ্রান্সের শিল্প বাণিজ্যের ক্ষেত্রে মন্দার জন্য 1786 খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের সঙ্গে স্বাক্ষরিত অবাধ বাণিজ্য চুক্তি কে দায়ী করে থাকেন। কারণ এই চুক্তির ফলে ব্রিটেনের শিল্পজাত পণ্য অবাধে ফ্রান্সে প্রবেশ করে এবং ফরাসী শিল্প উৎপাদন প্রতিযোগীতায় হেরে যায়। মুক্ত অর্থনীতিবাদীরা অবশ্য মারকেন্টাইল অর্থনীতিকে দায়ী করেন।
ফরাসি সরকার করের হার বৃদ্ধি করে আর্থিক সংকট কাটিয়ে উঠতে চেষ্টা করে। কিন্তু বর্ধিত করে বেশিটাই গিয়ে পড়ে কৃষকদের ওপর। এই বর্ধিত করের মধ্যে ছিল টাইল এর মত প্রত্যক্ষ কর এবং গ্যাবেল এর মত পরোক্ষ কর। আর্থিক সমস্যার সমাধানের জন্য ফরাসিরা অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত পুরানো দুটি পদ্ধতি ব্যবহার করতঃ রাষ্ট্রকে দেউলিয়া ঘোষণা করা ও সমস্ত ধরনের ঋণ বাতিল করা। 1770 এর দশকে ফরাসি অর্থমন্ত্রী তুর্গো মুক্তবাজার অর্থনীতি ও ন্যায্য কর নীতি চালু করতে প্রয়াসী হয়েছিলেন। তার পরবর্তী সময়ের অর্থমন্ত্রীগন যথাক্রমে নেকার, কলোন ও ব্রিয়েন- এরা সকলেই ফরাসি অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য একাধিক সিদ্ধান্ত নিলেও অভিজাতদের চাপে তা বাস্তবায়িত করা সম্ভব হয়নি। তবে কলোন ও ব্রিয়েনের প্রচেষ্টার ফলেই ফ্রান্সে এক নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। কোন কোন ঐতিহাসিক এই পরিস্থিতিকে "ফরাসি প্রাক বিপ্লব" বলে আখ্যায়িত করেছেন।
আঠারো শতকের শেষ দিকে ইউরোপে প্রায় সর্বত্র দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছিল। কিন্তু ফ্রান্সে তার প্রভাব ছিল সবচেয়ে বেশী কারণ ফরাসী সরকার জনসংখ্যা বৃদ্ধিজনিত সমস্যার সমাধান করতে পারেন। দ্বিতীয়ত, বুর্জোয়াদের অধিক ধনশালী হয়ে ওঠার ফলে সমাজে ক্রয়ক্ষমতা জনিত ভারসাম্য নষ্ট হয়েছিল। খাদ্যপণ্যের দাম প্রায় ১০০-১৩০% বেড়ে গেছিল। অথচ গত ৩০ বছরে শ্রমের মূল্য বেড়েছিল মাত্র ২২%। এর সাথে যুক্ত হয়েছিল কালোবাজারি, ফটকাবাজি আর ১৭৮৮ এর দুর্ভিক্ষ, যা খাদ্যদাঙ্গায় পরিণত হয়েছিল।
অর্থনীতিতে সংকট, সমৃদ্ধি না বৈষম্য বিপ্লবের জন্য কোনটা দায়ী তা নিয়ে বিতর্ক থেকেই যায়। রাজকোষ যে সংকটে পড়েছিল তাতে কোনও সন্দেহ নেই। আর তৃতীয় এস্টেটের অন্তর্ভুক্ত ছোট কৃষক ও সাঁকুলোৎ দের অবস্থা চরম সংকটাপন্ন হয়েছিল।ঐতিহাসিক লেফেভর তৃতীয় এস্টেটের আর্থিক সংকটকেই বিপ্লবের জন্য দায়ী করেছেন। কিন্তু বুর্জোয়ারা এই সময় প্রচুর সম্পত্তির মালিক হয়ে উঠেছিল এবং তাদের এই সম্পত্তিই তাদের অভিজাত সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সামাজিক অসন্তোষের কারণ ছিল। এরাই ছিল বিপ্লবের চালক। তাই ঐতিহাসিক তকভিল বুর্জোয়াদের সমৃদ্ধিকেই বিপ্লবের জন্য দায়ী করেন। পরিশেষে জর্জ রুডের অনুশরনে বালা যায়, বিপ্লবের প্রাক্কালে তৃতীয় সম্প্রদায়ের সকল শ্রেনীর মধ্যে প্রথম দুই সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে যে আরথ-সামাজিক ক্ষোভের জন্ম হয়েছিল তা-ই বিপ্লবের প্রেক্ষাপট রচনা করেছিল।
Thank you sir 🙏.
উত্তরমুছুন