সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

১৭৬৫ এর দেওয়ানী লাভ / 1765 Diwani of Bengal

১৭৬৫ এর দেওয়ানী লাভ / 1765 Diwani of Bengal




দেওয়ানী ব্যবস্থা ভারতে মোগল শাসন পদ্ধতি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিটি প্রদেশের সরকারি ক্ষমতা দুটি ভাগে বিভক্ত ছিলঃ দেওয়ানী ও নিজামত। প্রথমটির অধীনে ছিল রাজস্ব আদায় ও ভূমি সংক্রান্ত মামলা এবং দ্বিতীয়টির অধীনে ছিল শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষা ও ফৌজদারি মামলা। তবে মুঘল শাসনের শেষের দিকে এই দুই ক্ষমতা একই ব্যক্তির হাতে চলে আসে। নবাব আলীবর্দী খাঁ ছিলেন একাই ছিল বাংলার দেওয়ান ও সুবাদার। ১৭৬৪ সালে বক্সারের যুদ্ধে জয়লাভ করে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি একই সাথে বাংলা, অযোধ্যা ও দিল্লি কে পরাস্ত করেছিল। কোম্পানী পরাজিত অযোধ্যার রাজা সুজা-উদ্দৌলার সাথে এলাহাবাদের প্রথম চুক্তি (১৭৬৫) স্বাক্ষর করে। এলাহাবাদ ও কারা এবং ৫০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ আদায় করে। কোম্পানীর এর পরবর্তী পদক্ষেপ ছিল মুঘল বাদশাহ-র কাছ থেকে বাংলা বিহার ও উড়িশার দেওয়ানীর অধিকার আদায় করা। কোম্পানী এলাহাবাদ ও কারা  বাদশাহের হাতে অর্পণ করলে উৎফুল্ল বাদশাহ কোম্পানিকে বছরে ২৬ লক্ষ টাকার বিনিময়ে বাংলা, বিহার ও উড়িশার দেওয়ানির অধিকার অর্পণ করল। ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ানি লাভ বাংলা তথা ভারতের রাজনীতিতে গভীর তাৎপর্য কারি।

দেওয়ানি লাভের ফলে বাংলায় দ্বৈত শাসন চালু হয়। নবাব পায় ক্ষমতাহীন দায়িত্ব আর ইংরেজ কোম্পানী পায় দায়িত্বহীন ক্ষমতা। কোম্পানি তার অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের সুবাদে বাংলার প্রশাসনিক ব্যাপারে সহজেই নাক গলাত। বণিকের মানদণ্ড রাজদণ্ডে পরিণত হল। এদিকে নবাবের হাতে অর্থনৈতিক ক্ষমতা না থাকায় ওর রাজনৈতিক অস্তিত্ব অর্থহীন হয়ে গেল। তাঁকে কোম্পানির ওপর নির্ভর করে থাকতে হতো।

অর্থনৈতিক দিক থেকে দেওয়ানি লাভের ঘটনা ছিল বাংলার পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর। পলাশীর যুদ্ধের পর থেকে বাংলার বুকে যে আর্থিক নিস্ক্রমনের সূচনা হয়েছিল তা আরও তীব্রতর হল। কোম্পানি রাজস্ব আদায় নিয়ে একটার পর একটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালায়, যার রাজস্বের বোঝার ছিল অনেক বেশি। কোম্পানির কর্মচারীরা এতদিন দস্তকের অপব্যবহার করত চুরি করে। নবাবকে কাঠপুতুল করে এবার প্রকাশ্যে এই কাজ করতে লাগল। বাংলায় রাজস্বের টাকায় কেনা পণ্য নিজেদের দেশে চালান করতে থাকল। ঐতিহাসিকগণ মনে করেন, বাংলা থেকে চালান করা টাকাতেই ইংল্যান্ড-এর শিল্প বিপ্লব সম্ভব হয়েছিল। আর্থিক নিঃক্রমণের ফলে বাংলায় এল চরম দরিদ্র, বিধ্বংসী মন্বন্তর। আইন শৃঙ্খলার অবনতির ফলে জনজীবন বিপর্যস্ত হল। অপরপক্ষে কোম্পানির আর্থিক অভাব আর কোন দিন হল না। বাংলার রাজস্বের টাকায় কোম্পানী সামরিক বাহিনীকে আরো মজবুত করতে পারল।

শাহ আলমের কোম্পানিকে দেওয়ানী অধিকার প্রদান মুঘল ঐতিহ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। আকবরের সময় থেকে প্রতিটি সুবার দেওয়ানী ও নিজামত দুটি দায়িত্ব আলাদা লোককে দেওয়া হতো। এভাবে কেন্দ্র প্রদেশের ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখত। ঔরঙ্গজেব পর্যন্ত এই রীতি কঠোরভাবে মানা হয়েছিল। কিন্তু ঔরঙ্গজেবের পর কেন্দ্রীয় শক্তি ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়লে বিভিন্ন ক্ষেত্রে রীতিবিভ্রম ঘটেছিল। তাই আপাতভাবে মনে হবে যে দ্বিতীয় শাহ আলম কোন বেআইনি কাজ করেননি। একটু গভীরে গেলে দেখা যায় শাহ আলম যাকে বাংলা সুবার দেওয়ানী করলেন তা আসলে একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, কোন ব্যক্তি নয়। তার ওপর প্রতিষ্ঠানটি আবার বিদেশি মূলধনী সংস্থা (মার্কেনস্টাইল সংস্থা)। এই দুই দিক থেকেই ঘটনাটি মুঘল ঐতিহ্যবিরোধী। আসলে কোম্পানির হাতে পরাজিত মুঘল সম্রাটের কাছে এছাড়া আর অন্য রাস্তা ছিল না।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য Please visit our Homepage and subscribe us. Suggested Topics || Ghajnavid Invasion || গজনী আক্রমণ || || মামুদের সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন || Somnath Temple Plunder || || তরাইনের যুদ্ধ ও তার গুরুত্ত্ব || মহম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমন ও তার চরিত্র || সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আ...

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগ...

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হ...