Please visit our Homepage and Subscribe us.
প্রথম আফিমের যুদ্ধ | First Opium War
চীনের উপনিবেশীকরণের ইতিহাসে ইঙ্গ চীন যুদ্ধ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। পরপর দুটি ইঙ্গ চীন যুদ্ধ (১৮৩৯-৪২ এবং ১৮৫৬-৫৮) সংঘটিত হয় এবং দুটিতেই চীনের পরাজয় ঘটে। আফিমের চোরাচালানকে কেন্দ্র করে এই যুদ্ধদ্বয় সংঘটিত হয়েছিল বলে আফিমের যুদ্ধ নামেও পরিচিত।
Opium War 1 |
প্রথম আফিম যুদ্ধের কারণ
ব্রিটেন আমেরিকাসহ পশ্চিমা বণিকরা চীনের সঙ্গে সমপর্যায়ে দাঁড়িয়ে দ্বিমুখী বাণিজ্য করার জন্য দীর্ঘদিন ধরে চাপ দিয়ে আসছিল। কনফুসীয় আদর্শে প্রভাবিত চীন তাং যুগ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল। তারা বিশ্বাস করতো যে, চিন হল স্বর্গের নিচে অবস্থিত মধ্যরাজ্য। চীনের বাইরে বসবাসকারী সমস্ত মানুষই বর্বর। তাই বর্বর পশ্চিমীদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক রাখার কোনো প্রয়োজন নেই। যদি কেউ চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক রাখতে চায় তাহলে তাদেরকে করদ রাজ্য হিসেবেই বিবেচনা করা হবে এবং মাঞ্চু সরকারের মর্জি মতই বাণিজ্য করতে হবে। পশ্চিমী বণিকদের তাই চিনা দরবারে নিয়মিত নজরানা পাঠাতে হত এবং সম্রাটের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় 'কাউটাউ' প্রথায় আনুগত্য প্রদর্শন করতে হত, যা ছিল পশ্চিমাদের কাছে অত্যন্ত অস্বস্তিকর ও অপমানজনক। বিভিন্ন কারণে মাঞ্চু সরকার কেবল ক্যান্টন বন্দর ব্যতীত সকল বন্দর গুলি বিদেশীদের জন্য নিষিদ্ধ করেছিল। ক্যান্টন বাণিজ্য ছিল একমুখী অর্থাৎ এই বাণিজ্যে চীনারা পশ্চিমাদের কাছে কিছু ক্রয় করত না। তাই চিনা রেশম চা এবং চিনামাটির দ্রব্য প্রভৃতি ক্রয় করতে ইউরোপীয় বণিকদের প্রচুর বুলিয়ন খরচ করতে হত। পশ্চিমা শক্তিগুলি ক্যান্টন বাণিজ্য-এ ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করার জন্য বারংবার চিনা দরবারে দুত পাঠিয়েছিল। কিন্তু সমস্ত প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছিল।
Opium War 1 |
ইতিমধ্যে এতদিন ধরে ইউরোপীয় রাজনীতিতে যে নেপোলিয়নীয় সংকট চলছিল তার অবসান ঘটে। 1815 খ্রিস্টাব্দে ওয়াটারলুর যুদ্ধে নেপোলিয়ানের চূড়ান্ত পরাজয় ঘটে। ভিয়েনা চুক্তিতে ইউরোপে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর ব্রিটেন চীনের দিকে নজর দেওয়ার অবসর পায়। আমেরিকাকে সঙ্গে নিয়ে ব্রিটেন চীনে আফিমের চোরাচালান শুরু করে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য আফিমের সবচেয়ে বড় যোগানদার ছিল বাংলা। এছাড়াও তুরস্ক ও ইরান থেকে আফিম নিয়ে আসা হত। আফিম চিনে নতুন না। সপ্তম অষ্টম শতকে তুর্কি ও আরব বণিকদের মাধ্যমে চীনে আফিমের ব্যবহার শুরু হয়। তবে সেই ব্যবহার ঔষধি ব্যবহারেই সীমাবদ্ধ ছিল। চীনে এবার থেকে নেশার বস্তু হিসেবে আফিমের ব্যবহার শুরু হয়।
দিনে দিনে আফিমের চোরাচালান ক্রমশ বাড়তে থাকে। 1800 খ্রি: 2000 পেটি আফিম আমদানি হয়েছিল। 1820 তে হয় 10000 পেটি, 1838 গিয়ে তা দাঁড়ায় 40,000 পেটি। ফলে চীন আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং চীনাদেরকে নৈতিক অধঃপতন গ্রাস করে ফেলে। 1832-35 খ্রি: এর মধ্যে 20 মিলিয়ন আউন্স রুপো দেশ থেকে বেরিয়ে যায়। 1837 এ আমদানিকৃত পণ্যের 57% ছিল আফিম। 1838 সালে ব্রিটিশ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী প্রায় তিন কোটি টাকা কেবল আফিম ব্যবসা থেকে লাভ করে। ব্রিটিশ সরকারেও এই বেআইনি ব্যবসার জন্যে পরক্ষে মোটা টাকা আয় হত। চিন থেকে ক্রয় করা চায়ের দাম মেটানো হত ভারত থেকে পাঠানো আফিম চালান করে এবং ব্রিটিশ সরকার ক্যান্টন থেকে রপ্তানি করা চায়ের উপর মোটা টাকা শুল্ক আদায় করত। এই বাবদ 1833 এ ব্রিটেনের আয় হয়েছিল 33 লক্ষ পাউন্ড। এই পরিস্থিতিতে মাঞ্চু সরকার কঠোর পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়।
আফিম চালান বন্ধ করতে মাঞ্চু সরকার প্রাথমিক ভাবে কতকগুলি পদক্ষেপ নেইয়ঃ 1) বিদেশি যুদ্ধজাহাজ চিনে অনুপ্রবেশ নিষিদ্ধ করে, 2) বিদেশি ফ্যাক্টরি গুলিতে অস্ত্রশস্ত্র রাখা নিষিদ্ধ করে, 3) ফ্যাক্টরির কর্মী সংখ্যা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয় এবং 4) বিদেশিদের যাবতীয় নৌকা ও জাহাজ চীনা সরকারের কাছে রেজিস্ট্রি করার নির্দেশ দেওয়া হয়। এর পরেও যখন চোরাচালান বন্ধ করা গেল না তখন এক বিখ্যাত রাজকর্মচারী লিন সে সু কে ক্যান্টনের কমিশনার নিযুক্ত করে আফিম চোরাচালান বন্ধের দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়।
লিনের প্রাথমিক প্রচেষ্টাগুলি গ্রেপ্তার, বাজেয়াপ্তকরণ বা মহারানীর কাছে পত্র প্রেরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু 1839 খ্রি: 24 মার্চ লিন এক কঠোর পদক্ষেপ নিলেন। বিদেশি কুঠি ও ফ্যাক্টরিগুলি অবরোধ করা হল। প্রায় 21,000 পেটি বেআইনি আফিম উদ্ধার করে সেগুলিকে প্রকাশ্যে জ্বালিয়ে দিলেন।
Opium War 1 |
1839 খ্রিস্টাব্দে 12 ই জুলাই ক্যান্টন এর ম্যাকাও এ একজন চিনা গ্রামবাসীকে এক ব্রিটিশ নাবিক হত্যা করে বসে। এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় কমিশনার লিন অপরাধীদের আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। কিন্তু ব্রিটিশ প্রতিনিধি দাবি করেন যে, ব্রিটিশ প্রজাদের বিচার চিনা আদালত নয়, ব্রিটিশরাই করবে। এলিয়ট এর বিচারে অভিযুক্তরা খুবই লঘু শাস্তি পায়। ক্ষুব্ধ লিন পর্তুগীজদের দিয়ে ব্রিটিশদের ম্যাকাও থেকে বিতাড়িত করে। আগষ্ট মাসে ব্রিটিশরা হংকং এ পালিয়ে যায়। এদিকে বনিকদের চাপে পড়ে ব্রিটিশ মন্ত্রীসভা চিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়। পরের বছর জুন মাসে অ্যাডমিরাল এলিয়েটের নেতৃত্বে ইংরেজরা আক্রমনাত্মক অভিযান চালায়। এভাবে প্রথম ইঙ্গ চীন যুদ্ধের সূচনা হয়।
এ কথা অনস্বীকার্য যে, প্রথম ইঙ্গ চিন যুদ্ধের প্রত্যক্ষ কারণ ছিল আফিম ব্যবসা। কিন্তু প্রকৃত কারণও কি এই আফিম ব্যবসা? একপক্ষ মনে করেঃ 'হ্যাঁ'। তাদের মতে, আফিম ব্যবসা থেকে ব্রিটেনের ব্যপক লাভ হত। যতদিন আফিম ব্যবসা ছিল না ততদিন কোন সমস্যা ছিল না। চিন সরকার বেআইনি আফিম ব্যবসা বন্ধ করার উদ্যোগ নিলে পরে যুদ্ধ শুরু হয়। সুতরাং আফিমই প্রধান কারণ।
আর এক দল পন্ডিত মনে করেন আফিম প্রকৃত কারণ নয়। আফিম ছিল কেবল উপলক্ষ মাত্র। আসল কারণ ছিল চিন ও ইউরোপীয় শক্তি গুলির বিপরীত ধর্মী সমাজব্যবস্থা। চীন ছিল সামন্ততান্ত্রিক রুদ্ধদ্বার। বহির্জগতের অভূতপূর্ব অগ্রগতি সম্পর্কে অনঅবহিত। অন্যদিকে ইউরোপীয় শক্তিগুলি মার্কেনটাইল পুঁজি নির্ভর সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। তারা, বিশেষত ইংল্যান্ড, শিল্প বিপ্লবের ফলে দ্রুত শক্তি সঞ্চয় করেছিল। বিশ্বকে পদানত করতে তারা উদগ্রীব ছিল। চিনের নজরানা প্রথা, কাউটাউ প্রথা এবং ক্যান্টনের অসম একমুখী বাণিজ্য সম্পর্কে তাদের দীর্ঘদিনের অভিযোগ ছিল। তারা যেকোন প্রকারে বাণিজ্যিক স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে চিনের এই রুদ্ধতাকে ভেঙে দিতে চাইছিল। সুতরাং বলা যায় যে আফিম নয় ইউরোপীয় শক্তি গুলির উপনিবেশবাদী লালসাই ছিল প্রথম ইঙ্গ চীন যুদ্ধের প্রকৃত কারণ।
প্রথম আফিম যুদ্ধের ফলাফল
প্রথম আফিম যুদ্ধে চীনের পরাজয় ঘটে। পাশ্চাত্য শক্তিবর্গের সাথে চিন একাধিক অসম চুক্তি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়। বৃটেনের সাথে নানকিং এর সন্ধি (1842) ও হুমেন এর সন্ধি (1843), আমেরিকার সাথে ওয়াংশিয়া (1844) এবং ফ্রান্সের সাথে হোয়্যাম্পয়ার সন্ধি (1844) স্বাক্ষরিত হয়। চীনের ইতিহাসে এই ব্যবস্থা 'চুক্তি ব্যবস্থা' নামে পরিচিত। রুদ্ধদ্বার চীন মুক্তদ্বার চীনে পরিণত হয। ক্যান্টন, অ্যাময়, ফুচাও, নিংপো প্রভৃতি বন্দর পশ্চিমীদের কাছে উন্মুক্ত হয়ে। হংকং বিদেশীদের হাতে চলে যায়। চিন পশ্চিমী দেশগুলিকে সমপর্যায়ে মেনে নিতে বাধ্য হয়। এভাবে চীন 'আধা-সামন্ততান্ত্রিক আধা-ঔপনিবেশিক' রাষ্ট্রে পরিণত হয়। শুধু তাই নয় চীন পশ্চিমী শক্তিবর্গ কে 'অতিরাষ্ট্রিক অধিকার' দানে সম্মত হয় এবং তাদের 'most favoured country'-র মর্যাদা দিতে বাধ্য হয়, যা ছিল নিঃসন্দেহে চীনের সার্বভৌমত্বের পরিপন্থী।
অফিম কে কেন্দ্র করে যুদ্ধ বাধলে কোনও চুক্তিতে আফিম সংক্রান্ত কোনো শর্ত ছিল না। বরং যুদ্ধ শেষে আফিমের চোরাচালান আরো বৃদ্ধি পায়। বাৎসরিক আফিম আমদানি 1840 খ্রি: যা ছিল 37000 পেটি 1850 এ তা হয়ে দাঁড়ায় 70000 পেটি। হংকং আফিম চালানের কেন্দ্রে পরিণত হয়। ফলে চীনের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। একইসাথে চিন বিদেশী পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপের অধিকার হারায়। এর ফলে চিনা হস্তশিল্প ধ্বংস হতে থাকে। চিন তার অর্থনৈতিক স্বাধীনতা হারায়। একইসাথে চীনের মুক্ত বন্দর গুলিতে পশ্চিমী ব্যবসায়ীদের লেজুড়বৃত্তি করার জন্য সাম্রাজ্যবাদের দালাল কম্প্রেডর শ্রেণীর আবির্ভাব ঘটে।
Thanks for reading.
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন