Battle of Plassey | পলাশীর যুদ্ধ
Siraj Ud Daulla |
পলাশীর যুদ্ধের পটভূমি
পলাশীর যুদ্ধের পটভূমি আলোচনা করতে গেলে প্রধানত দুটি দিকে গুরুত্ত দিতে হবে। প্রথম হল নবাব সিরাজের সঙ্গে ইংরেজদের বিরোধ ও দ্বিতীয়টি নবাবের বিরুদ্ধে তাঁর দরবারের মানুষজনের চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র।
প্রথম কারণটি জন্য তৎকালীন বৃটিশ ঐতিহাসিকেরা সিরাজকে প্রধানত দায়ী করেছেন। ঐতিহাসিকদের মধ্যে অন্যতম এস সি হিল ও ডড ওয়েল । আধুনিককালের ঐতিহাসিক পিটার মার্শাল ও ক্রিস বেইলি ও এই ধরনের মত প্রকাশ করেছেন। ডডওয়েল মনে করেন দাক্ষিণাত্যে ইঙ্গ-ফরাসি দ্বন্দ্বের ঘটনায় সিরাজ উদ্বিগ্ন ছিলেন। কলকাতায় ইংরেজদের দুর্গ নির্মাণকে তিনি ভাল চোখে দেখেননি।সিরাজ চেয়েছিলেন' আগেই আক্রমণ করে ইংরেজদের বাংলা থেকে উৎখাত করতে। তবে সত্যিই সিরাজ দাক্ষিণাত্যের ঘটনায় উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন কিনা তা সঠিকভাবে বলা যায়না। এস সি হিল সিরাজের সঙ্গে ইংরেজদের বিরোধের প্রথমেই অষ্টাদশ শতকের পেক্ষাপটে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের ঘটনাকে তুলে ধরেছেন। তার মতে এই সময় হিন্দুরা উচ্চাকাঙ্ক্ষী হয়ে উঠেছিল ও ইংরেজদের সহায়তায় মুসলিমদের ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত করতে চেয়েছিল। হিল আরো বলেছেন ইংরেজরা তাদের ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কোনো রকম সরকারি নিয়ন্ত্রণ মেনে নিতে রাজি ছিল না, কিন্তু প্রাচ্যদেশীয় শাসকদের স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাব তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যে অসুবিধা সৃষ্টি করেছিল। এইভাবে নবাবের সঙ্গে ইংরেজদের বিরোধের পটভূমি তৈরি হয়েছিল। যদিও হিলের এই সমস্ত বক্তব্য গুলি নিরপেক্ষ নয়।
ইংরেজ ঐতিহাসিকরা সিরাজকে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে সংঘর্ষের জন্য দায়ী করলেও ঐতিহাসিক ব্রিজন গুপ্ত ইংরেজ ঐতিহাসিক দের মত খণ্ডন করে প্রমাণ করতে চেয়েছেন সিরাজ নয় বরং ইংরেজরাই এই সংঘর্ষের জন্য দায়ী ছিল। দাক্ষিণাত্যে ইংরেজদের সাফল্য তাদের সাম্রাজ্যবাদী উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে বাড়িয়ে দেয়, যার ফলে তারা বাংলাতে তাদের সাম্রাজ্যর বিস্তারে সচেষ্ট হয়। আর সিরাজ সিংহাসনে বসলে তার আত্মীয়-স্বজন তার বিরোধিতা শুরু করলে, ইংরেজরা নিজেদের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করতে তৎপর হয়।
নবাবের অনুমতি ছাড়া কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ সংস্কার ছাড়াও আরেকটি বড় কারণ ছিল নবাবের বারংবার অনুরোধ ও নিষেধাজ্ঞা সত্তেও কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যাক্তিগত বাণিজ্যে বেআইনি ভাবে দস্তকের, যার ফলে একদিকে নবাবের শুল্ক বাবদ আয় কমে যাচ্ছিল এবং দেশীয় বনিকরা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছিল। ফলে নবাবের সঙ্গে কোম্পানির সম্পর্ক চুড়ান্তভাবে খারাপ হতে থাকে। সর্বোপরি কলকাতায় ইংরেজ কর্তৃপক্ষ নবাবের সার্বভৌম ক্ষমতার স্বীকার না করে কার্যত স্বাধীনভাবে জমিদারি পরিচালনা করত। অতএব বলা চলে সিরাজ এর সঙ্গে ইংরেজদের সংঘর্ষের মূল কারণ হলো নবাবের সার্বভৌম ক্ষমতার ওপর ইংরেজদের নগ্ন আক্রমণ।
অপর যে ঘটনাটি পলাশীর যুদ্ধের প্রেক্ষাপট এর সাথে যুক্ত ছিল তা হল পলাশীর ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত। অনেকেই মীরজাফরকে এই চক্রান্তের নায়ক মনে করলেও, অধ্যাপক রজতকান্ত রায়ের মতে পলাশীর যুদ্ধের পেছনে ছিল মুর্শিদাবাদের রাজপুরুষদের ষড়যন্ত্র। একদিকে ঘষেটি বেগম, শওকত জঙ্গ, রাজবল্লভ ও তার পুত্র কৃষ্ণবল্লভ এবং অন্যদিকে জগত শেঠ, রায়দুর্লভ, খোজা উজিদ, উমিচাঁদ প্রমুখ ব্যাঙ্কার ও ব্যবসায়ীরা ছিলেন অন্যতম ষড়যন্ত্রকারী। পিটার মার্শাল মনে করেন দরবারের অন্তর্দ্বন্দ্বের ফলে ইংরেজরা বাংলা রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের সুযোগ পেয়েছিল। আবার অনেকে মনে করেন সিরাজের মতন বেপরোয়া তরুণ নবাব হওয়ায় কুচক্রী দল তাদের কায়েমি স্বার্থ ক্ষুন্ন হওয়ার ভয়ে ভীত হয়ে উঠেছিল এবং এই কায়েমী স্বার্থের উপর আক্রমণের আশঙ্কা সবাইকে একই পতাকাতলে টেনে এনেছিল।
পলাশীর যুদ্ধের গুরুত্ব
পলাশীর যুদ্ধের ফলে মীরজাফর বাংলা নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে সিংহাসনচ্যুত করে নিজে মসনদে বসে ছিলেন। পলাশীর যুদ্ধে জয়লাভ করলেও ইংরেজরা সরাসরি বাংলার প্রশাসনিক দায়িত্ব গ্রহণ করেনি। মীরজাফর ছিলেন বাংলার নবাব ও আইনত তিনি ছিলেন বাংলার সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। বাংলার শাসনব্যবস্থাতেও কোনো মৌলিক পরিবর্তন পলাশীর যুদ্ধের ফলে ঘটেনি। সুতরাং আইনের দৃষ্টিতে চুলচেরা বিচার করলেও বলা যায়না পলাশীর যুদ্ধের ফলে বাংলার স্বাধীনতা হারিয়েছিল।
তবে এ কথা ঠিক মীরজাফর কেবল ক্লাইভের সাহায্য নিয়ে ক্ষমতাই দখল করেন নি, তিনি ইংরেজ এর কাছে পুরোপুরি বিকিয়ে গিয়ে পরিণত হয়েছিলেন ক্লাইভের হাতের পুতুলে। তাই পলাশীর যুদ্ধে আইনত বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত না হলেও এই সময় থেকেই ইংরেজরা বাংলা সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠেছিল। তারা বাংলার কিংমেকারে পরিণত হয়েছিল। তাই ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য স্থাপনের ইতিহাসে এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল পলাশীর যুদ্ধ।
সামরিক দিক থেকে দেখলে আপাতদৃষ্টিতে পলাশির যুদ্ধ কোনো যুদ্ধই না। কারন ষড়যন্ত্রকারীদের অন্যতম বিশ্বাসঘাতক সিরাজের প্রধান সেনাপতি মিরজাফর ও তার বাহিনী যুদ্ধে অংশগ্রহন করেনি। কিন্তু অন্য দুই সেনাপতি মীরমদন ও মোহনলাল এর বাহীনীর সামনে ইংরেজ বাহীনিকে বেগ পেতে হয়েছিল। যদিও এই দুই সেনাপতি যুদ্ধক্ষেত্রে শহীদ হন। তাই পলাশির যুদ্ধ সামরিক দিক থেকে একেবারে গুরুত্ত্বহীন নয়।
পলাশীর যুদ্ধের ফলে বাংলায় ব্রিটিশ প্রাধান্য ও বাণিজ্য দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। দস্তকের ব্যাপক অপব্যবহারের ফলে কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যবসা দ্রুত বাড়তে শুরু করেছিল। এছাড়াও মীরজাফর এর কাছ থেকে প্রচুর অর্থ আদায় করে কোম্পানি বিপুল অর্থের অধিকারী হয়। সেই অর্থ ভারতের অন্যত্র যুদ্ধবিগ্রহের ব্যয় করতে থাকে কোম্পানি। বাংলাকে শক্ত ঘাঁটিতে পরিণত করায় ইংরেজরা ফরাসিদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালাতে, বিশেষত তৃতীয় কর্ণাটকের যুদ্ধে তারা বিশেষ সুবিধা পেয়েছিল। পলাশীর যুদ্ধের ফলে একদিকে যেমন কোম্পানি ও তার কর্মচারীদের অর্থভাণ্ডার ফুলে-ফেঁপে উঠতে থাকে অন্যদিকে তেমনি বাংলার মানুষের দুঃখ-দুর্দশা চরম সীমায় পৌঁছায়। বাংলার বুকে যে লুন্ঠনের পর্ব শুরু হয় তা পলাশীর লুণ্ঠন নামে পরিচিত। সুতরাং বাংলার পক্ষে পলাশীর যুদ্ধ দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ছাড়া আর কিছুই নয়।
স্যার যদুনাথ সরকার পলাশীর যুদ্ধ কে একটু অন্যভাবে দেখার চেষ্টা করেছেন তার মতে পলাশীর যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ শাসনের সংস্পর্শে এসে বাঙালি পাশ্চাত্য শিক্ষা আদর্শ ও দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়। বাংলা তথা ভারতের বুকে আধুনিক যুগের সূচনা হয়। তবে একথা ঠিক যে পলাশীর যুদ্ধ নিয়ে সমকালীন সাধারণ মানুষ কোন মাথা ঘামাইনি। আর পলাশীর চক্রান্ত বা ষড়যন্ত্রের সঙ্গে সাধারণ মানুষের কোন যোগ ছিল না।
পরিশেষে, একথা বলাই যায় পলাশীর যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বাংলার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল। তাই একথা বলাই যুক্তিসংগত হবে পলাশীর যুদ্ধের তাৎক্ষণিক ফলাফলের থেকেও সুদুরপ্রসারি ফলাফল ছিল অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
পলাশীর যুদ্ধের জন্য অন্ধকূপ হত্যা (Black hole tragedy)কতটা দায়ী?
উত্তরমুছুনরাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় ও তাঁর পুত্র শিবচন্দ্র রায় পলাশীর ষড়যন্ত্রকারী ও মদতদাতা- এটার সত্যতা কতদূর?
উত্তরমুছুনস্যার, ঐতিহাসিক ডড ওয়েল না উড ওয়েল হবে?
উত্তরমুছুনhttps://en.wikipedia.org/wiki/H._H._Dodwell
মুছুনThank you sir.
উত্তরমুছুন