সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

গুপ্তযুগের কৃষিঅর্থনীতি

Please visit our Homepage and Subscribe us.

গুপ্ত রাজাদের শাসনকাল 319-20 খ্রিস্টাব্দে থেকে 550 বা 570 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বিরাজমান ছিল। গুপ্তদের সময়ে দক্ষিণ ভারতে বাকাটক ও কদম্ব রাজারা রাজত্ব করত। তাই গুপ্ত যুগ বলতে আমরা চতুর্থ শতকের সূচনা থেকে ষষ্ঠ শতকের সমাপ্তি পর্যন্ত ধরে নেই। গুপ্ত যুগে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে যে অভাবনীয় অগ্রগতি ঘটেছিল সেদিকে নজর রেখে অনেক ঐতিহাসিক গুপ্ত যুগকে স্বর্ণযুগ বলে অভিহিত করেছেন গুপ্ত যুগের সাংস্কৃতিক অগ্রগতির অন্যতম কারণ ছিল সুস্থিত অর্থনীতি।

গুপ্ত অর্থনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো অগ্রহার ব্যবস্থা। অগ্রহার হল ধর্মস্থান বা পুরোহিত সম্প্রদায়ের উদ্দেশ্যে ভূমিদান প্রথা। এই ভূমিদান গুপ্তদের আগে থেকে চালু ছিল। কিন্তু আলোচ্য পর্বে তা ব্যাপক আকার ধারণ করে। দান করার ক্ষেত্রে গুপ্তদের তুলনায় বাকাটকরা অনেকটাই এগিয়ে ছিল। অগ্রহার ব্যবস্থার ব্যাপক প্রচলনের ফলে জমিতে ব্যক্তিমালিকানার প্রসার ঘটেছিল এবং গোষ্ঠী মালিকানা ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছিল। একইসাথে এই ব্যবস্থায় ব্রাহ্মণ ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলি লাভবান হয়েছিল। একটি ধর্মীয় ভূস্বামী গোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটেছিল। রামশরণ শর্মা ও তার অনুগামীরা মনে করেন, অগ্রহার ব্যবস্থা ফলে সমাজে ত্রিস্তরীয় (রাজা, ভূস্বামী ও কৃষক) ভূমিব্যবস্থা  তথা সামন্ততন্ত্রের সূচনা হয়েছিল। কৃষক কার্যত ভুমিদাসে পরিণত হয়েছিল। এর ফলে কারিগরি উৎপাদন, বাণিজ্য, মুদ্রা অর্থনীতি ও নগরায়ন বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিল। যদিও তার থিসিস নানাভাবে সমালোচিত হয়েছে।

আলোচ্য পর্বে কি কি ফসলের উৎপাদন হতো তার পরিচয় আমরা সমকালীন রচনাবলী থেকে পাই। উৎপাদিত শস্যের মধ্যে ধান ছিল সর্বপ্রধান কালিদাস বঙ্গের ধানের খ্যাতির কথা  লিখেছেন। হিউ এন সাং লিখেছেন মগধের সুগন্ধি ধান সম্ভ্রান্তদের পছন্দের তালিকায় ছিল। হরিয়ানার আবহাওয়া উৎপাদনের পক্ষে অনুকূল ছিল। কালিদাসের লেখায় আখ এবং 'অমরকোষে' তুলো, তিল, সর্ষে, নীল এবং দক্ষিণ ভরতে গোলমরিচ এলাচ ও সুপুরি উৎপাদনের কথা জানা যায়। বরাহমিহিরের লেখায় কাশ্মীরে জাফরান চাষের কথা রয়েছে।

জমির ধারণ এবং চাষের জন্য তা কতটা উপযোগী সে সম্পর্কে আলোচ্য পড়বে স্পষ্ট ধারণা ছিল। অমরকোষে অন্তত 12 রকম জমির কথা বলা হয়েছে। লেখমালায় অবশ্য ছয় প্রকার জমির কথা বলা হয়েছে-- ১) ক্ষেত্র বা চাষযোগ্য জমি, ২) অপ্রহত বা অনাবাদী জমি, ৩) খিলক্ষেত্র বা পতিত জমি ৪) অপ্রদ বা অবন্টিত জমি ৫) অপ্রতিকর বা রাজস্ব আদায়ের অযোগ্য জমি এবং  ৬) অরণ্য।

জমি যেহেতু হস্তান্তরিত হত তাই জমি মাপার নির্দিষ্ট পদ্ধতি তাদের জানা ছিল। জমির আয়তন বোঝাতে তাম্রশাসনগুলিতে আঢ়বাপ, দ্রোণবাপ, কুল্যবাপ ও পাটক একক ব্যবহৃত হত। বাকাটক এলাকায় জমি মাপের একক ছিল নিবর্তন এবং মৈত্রক এলাকায় পাদাবর্ত। বাংলার তাম্রশাসনে জমি মাপার সময় দুইপ্রকার নল ব্যবহারের প্রমান আছে। ক্রয়বিক্রয় বা দানজনিত সমস্ত জমি হস্তান্তরের ঘটনা তাম্রশাসনে জারি করা হত।

কৃষি অর্থনীতি আলোচনা প্রসঙ্গে সেচ ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করতেই হয়। সমকালীন তাম্রশাসনে তড়াগ বা পুকুরের উল্লেখ হামেশাই পাওয়া যায়। ছোটখাটো সেচ প্রকল্প ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত উদ্যোগে গড়ে উঠত। কিন্তু বৃহৎ প্রকল্পে রাজকীয় উদ্যোগ বিরল নয়। বাকাটক রাজা দ্বিতীয় পৃথ্বীষেন পৃথ্বীসমুদ্র নামে এক বিরাট জলাশয় খনন করে দেন।  অনুরূপ উদ্যোগ নিয়েছিলেন কদম্ব শাসক কুকুস্থবর্মন। মৌর্য আমলে নির্মিত সুদর্শন হৃদ সংস্কারের কাজ করেছিলেন স্কন্দগুপ্ত। বাকাটক রাজাদের এক পদস্থ আধিকারিক মহারাষ্ট্রে একটি সেচ প্রকল্প নির্মাণ করেছিলেন, যেটিরও নাম সুদর্শন হৃদ।

সুতরাং গুপ্তযুগে কৃষির অগ্রগতি সম্পর্কে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু কৃষকের অবস্থার উন্নতির কোনো প্রমাণ নেই। বরং জমিতে ব্যক্তিমালিকানার প্রসার এবং বর্ণব্যবস্থার কঠোরতা হেতু ধরে নেওয়া যায় যে, কৃষকরা ভুমিদাসে পরিণত না হলেও তাদের অবস্থা শোচনীয় হয়েছিল।

 Thanks for reading.

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য Please visit our Homepage and subscribe us. Suggested Topics || Ghajnavid Invasion || গজনী আক্রমণ || || মামুদের সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন || Somnath Temple Plunder || || তরাইনের যুদ্ধ ও তার গুরুত্ত্ব || মহম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমন ও তার চরিত্র || সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আ...

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগ...

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হ...