ভারতের ইতিহাসে অষ্টাদশ শতকীয় বিতর্ক
ভারতের ইতিহাসে অষ্টাদশ শতক এক যুগসন্ধিক্ষণ হিসাবে চিহ্নিত। এই শতাব্দীতে একদিকে যেমন প্রবল প্রতাপশালী মুঘল সাম্রাজ্যের অবক্ষয়ের সূচনা হয়, অন্যদিকে তেমনই বাংলা, হায়দ্রাবাদ, অযোধ্যার মত একাধিক আঞ্চলিক শক্তির উত্থান ঘটতে থাকে। আর এর সাথে যুক্ত হয় ব্রিটিশ, ফরাসি প্রভৃতি ইউরোপীয় বণিক গোষ্ঠীর ভারতের উপকূলগুলিতে ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং ক্ষমতার দ্বন্দ্বে শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশদের জয়লাভ। ব্রিটিশরা ভারতের ভাগ্যনিয়ন্তায় পরিনত হয়।
1707 খ্রিস্টাব্দে ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর সাথে সাথে মুঘল শক্তির অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা গুলি প্রকট হয়ে উঠতে থাকে, আর এই দুর্বলতা সর্বসমক্ষে চলে আসে 1739 সালের নাদির শাহের ভারত আক্রমণ ও লুন্ঠনের মাধ্যমে। মুঘল সাম্রাজ্যের দুর্বলতার কারণ গুলি ঐতিহাসিকরা নানান দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। যেমন, স্যার যদুনাথ সরকার সম্রাট আওরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতি ও ধর্মনীতিকেই মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের জন্য দায়ী করেছেন। ঈশ্বরী প্রসাদ বা শ্রীরাম শর্মাও মুঘল সাম্রাজ্যের দুর্বলতার জন্য ওরঙ্গজেবকেই দায়ী করেছেন। তবে মার্কসবাদী ঐতিহাসিক সতীশচন্দ্র অর্থনীতি ও সাম্রাজ্যের কাঠামোর উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন। ইরফান হাবিব অর্থনৈতিক সমস্যা কেই বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। আর এই অর্থনৈতিক সমস্যার কারণেই সৃষ্টি হয়েছিল কৃষক অসন্তোষ। মুঘল সাম্রাজ্যের শেষের দিকে একাধিক কৃষক বিদ্রোহ ঘটেছিল।
শুধুমাত্র মোগল সাম্রাজ্যের পতনই নয়, অষ্টাদশ শতকের ভারত একাধিক পরিবর্তনের সাক্ষী হয়ে আছে। এই শতকেই পেশোয়াদের নেতৃত্বে মুঘল সাম্রাজ্যের বিকল্প হিসেবে মারাঠাদের উত্থান ঘটতে থাকে। কিন্তু 1761 সালের পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার সাথে সাথে, মারাঠাদের সর্বভারতীয় সাম্রাজ্যঃ স্থাপনের পরিকল্পনা ব্যাপকভাবে ধাক্কা খায়। অপরদিকে 1757 সালে পলাশীর যুদ্ধে জয়লাভের মাধ্যমে বাণিজ্যিক শক্তি থেকে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রক এ পরিণত হওয়া ব্রিটিশ শক্তি যে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে তাদের শক্তি প্রতিষ্ঠা করবে তা অনেকাংশে নিশ্চিত হতে থাকে। কারণ মারাঠা ছাড়া হায়দরাবাদ, পাঞ্জাব, মহীশূর বা অযোধ্যা কোন আঞ্চলিক শক্তির পক্ষেই সর্বভারতীয় সাম্রাজ্য গড়ে তোলা সম্ভবপর ছিল না। 1764 সালের বক্সারের যুদ্ধ ব্রিটিশ শক্তির স্থায়িত্বের ভাবনাকে সীলমোহর দিয়ে দেয়।
আবার আঞ্চলিক শক্তি গুলি কোন কোন ক্ষেত্রে ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুললেও, বহু ক্ষেত্রে রাজ্যগুলির শাসকেরা ইংরেজদের সহায়তা করেছিল একথা বলা বাহুল্য হবে না। এই সময় কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যের কারণে যে অর্থনৈতিক রাজনৈতিক ক্ষমতাবান বৃত্তির উত্থান ঘটেছিল তা ডক্টর আসীন দাশগুপ্ত ও স্টুয়ার্ড গর্ডন তাঁদের আলোচনায় দেখিয়েছেন। তবে একথাও ঠিক অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধ থেকেই আঞ্চলিক বাণিজ্যের বেশিরভাগই চলে যেতে শুরু করেছিল বিদেশিদের হাতে, বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতাকে কেন্দ্র করে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মত শক্তি গুলি নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বেও লিপ্ত হয়েছিল।
অষ্টাদশ শতকের বিতর্কের মূল দিক হল, মুঘলদের মত সুবৃহৎ কেন্দ্রীয় শক্তির পতনের ফলে কি, ভারতের সর্বক্ষেত্রে দুর্যোগ ঘনিয়ে এসেছিল? নাকি আঞ্চলিক শক্তি গুলি নিজ নিজ অঞ্চলকে কেন্দ্র করে স্থায়ী শক্তি গড়ে তুলেছিল। ড. পি. জে. মার্শাল অষ্টাদশ শতকে স্থায়িত্ব ও সংহতি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আঞ্চলিক শক্তিকে গুরুত্ব দিলেও ইরফান হাবিব এই শতাব্দীকে নগ্ন লুণ্ঠন, অরাজকতা ও বিদেশিদের রাজ্য জয়ের শতাব্দি বলে চিহ্নিত করেছেন। তবে সি এ বেইলি ইরফান হাবিব এর মত অস্বীকার করে বলেছেন, মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের মধ্য দিয়ে অসংখ্য আঞ্চলিক রাজ্য গড়ে উঠেছিল যারা ছিল আঞ্চলিক আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিচ্ছবি।
তবে অষ্টাদশ শতকে ভারতীয় কাঠামোর অবক্ষয়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল সাংস্কৃতিক অবক্ষয়। হায়দার আলী, টিপু সুলতান বা মহাদাজী সিন্ধিয়ার মত সেনাপতির কিয়দংশ সেই গুরুত্ব অনুভব করলেও কারিগরি শিল্প থেকে শুরু করে যুদ্ধবিদ্যা এবং শিক্ষায় ভারতীয়রা ইউরোপের দ্বারা প্রভাবিত হতে পারেনি। 1817 সালে জেমস মিল History of British India গ্রন্থে লিখেছিলেন ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর থেকে অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত যে অরাজকতা চলেছিল তারই অবসান ঘটলো ইংরেজদের শাসন এর ফলে।
সমস্ত বিতর্কের শেষে এ কথা বলা যায় মুঘল শক্তির পতন ঘটার সাথে সাথে ভারত পৃথিবীর মানচিত্র তার পূর্বের অবস্থা হারিয়ে ফেলেছিল এ কথা বলা ঠিক নয়। কারণ মুঘলদের পতন ঘটলেও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে শুরু করে পারস্য উপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে ভারতীয় কারিগরি পণ্যের বাজার তখনো ব্যাপক ছিল। তাই এ বিষয়ে বার্টন স্টেইন আলিগড়পন্থী ঐতিহাসিকদের অষ্টাদশ শতকে ও বিপর্যয় তত্ত্বকে অস্বীকার করেছেন।
Thanks for reading.
Pravat Bhushan Bondyopadhaya,
Lecturer, Sonarpur Mahavidyalaya.
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন