ভারতের ইতিহাসে স্বর্ণযুগ বিতর্ক
পঞ্চদশ শতকীয় ইউরোপে রেনেসাঁর যুগে নবজাগরণের পণ্ডিতগন ইউরোপে স্বর্ণযুগের সন্ধানে রত হয়েছিলেন। মধ্যযুগের উত্তরাধিকারের কথা প্রায় বিস্মৃত হয়ে তারা প্রাচীন গ্রীক ও রোমান সংস্কৃতির মধ্যে নিজেকে আবিষ্কার করার চেষ্টা করেছিলেন। মধ্যবর্তী শতকগুলি অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগের আখ্যা লাভ করেছিল। জ্ঞান চর্চা ও জীবনচর্চায় ধ্রুপদী সংস্কৃতিকে অনুসরণ করা হয়েছিল। ১৮ শতকে ভারততত্ত্ব আলোচনা করতে গিয়ে প্রথম যুগের প্রাচ্যবিদ্যা-বিশারদগণ প্রাচীন ভারতের এমন এক সংস্কৃতির সন্ধান লাভ করেছিলেন, যার মাহাত্ম্য ইউরোপীয় ধ্রুপদী ঐতিহ্যের সঙ্গে তুলনীয়। এই সংস্কৃতি হল গুপ্ত যুগীয় সংস্কৃতি। গুপ্ত যুগকে ‘স্বর্ণযুগ’ বলে অভিহিত করা হল।
330 খ্রিস্টাব্দ থেকে 550 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময় কালে ভারতের বৃহৎ অঞ্চলে গুপ্ত বংশীয় শাসকেরা রাজত্ব করেছিলেন। গুপ্তদের রাজত্বকালে ভাষা, সাহিত্য, বিজ্ঞান, স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও চিত্রকলায় অভূতপূর্ব বিকাশ ঘটেছিল। এই সমস্ত উৎকর্ষতার দিকে তাকিয়ে পণ্ডিতরা এই যুগকে স্বর্ণযুগের আখ্যা দিয়েছেন। ভিন্সেন্ট স্মিথ, সমুদ্রগুপ্তকে ভারতের নেপোলিয়ন বলেছিলেন,-- গুপ্তযুগকে ইংল্যন্ডের ইতিহাসে এলিজাবেথীয় এবং স্টুয়ারট যুগের সাথে তুলনা করেছেন। বারনেট গুপ্তযুগকে গ্রীসের পেরিক্লিসের যুগের সাথে তুলনা করেছেন।
শিল্পকলা, সাহিত্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে গুপ্তযুগ অসামান্য উৎকর্ষতা লাভ করেছিল। শিল্পের ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছে ভাস্কর্যের অতুলনীয় নিদর্শনগুলি। বিভিন্ন দেব দেবীর প্রতিমা, তা ব্রাহ্মণ্য বা বৌদ্ধ, যাইহোক না কেন– এক কথায় অসামান্য। সাঁচী, সারনাথ ও মথুরায় প্রাপ্ত বুদ্ধমূর্তি গুলি এযুগের ভাস্কর্যের অন্যতম নিদর্শন। ভাস্কর্যের মাধ্যম হিসেবে কেবলমাত্র পাথর নয়, পোড়ামাটির ব্যবহারও ছিল প্রচুর। এই সময়ের শিল্পকলার নিদর্শন মেলে চিত্র শিল্পে। অজন্তার গুহাচিত্র গুলি তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এই সময় স্থাপত্য শিল্পে স্তূপ ও চৈত্য নির্মাণ অব্যাহত ছিল। স্তূপের অন্যতম নিদর্শন সারনাথের ধামেক স্তূপ। গুহামন্দির নির্মাণে শিল্পীরা যে অসাধারণ নৈপুণ্যের পরিচয় দিয়েছেন তার সাক্ষ্য বহন করছে অজন্তা, ইলোরা প্রভৃতি গুহামন্দিরগুলি। গুপ্ত যুগেই ইট-পাথর দিয়ে মন্দির নির্মাণের সূচনা হয়েছিল। মনিনাগের মন্দির ও দেওঘরের দশাবতার মন্দির এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
গুপ্ত যুগের সংস্কৃতিক সৃজনশীলতার অসামান্য সাক্ষ্য বহন করে এই পর্বের বহুবিধ সাহিত্য কীর্তি। এই যুগে প্রধানত সংস্কৃত ভাষাকে কেন্দ্র করে সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে। সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য ছিলেন কালিদাস। তাঁর উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি হল রঘুবংশম্, অভিজ্ঞান শকুন্তলম্, মেঘদূতম্, কুমারসম্ভব, ঋতুসংহার প্রভৃতি। এছাড়াও শূদ্রকের মৃচ্ছকটিকম্ ও বিশাখদত্তের মুদ্রারাক্ষস উল্লেখযোগ্য। গুপ্ত সম্রাটরা কেবল সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন না, তাঁদের অনেকেই ছিলেন কবি ও পণ্ডিত। সমুদ্রগুপ্ত ‘কবিরাজ’ উপাধি ধারন করেছিলেন। এই সময় সংস্কৃত গদ্য সাহিত্যের রূপকার ছিলেন বিষ্ণুশর্মা ও দণ্ডি।
এই যুগে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চারও প্রভূত উন্নতি হয়েছিল। ভারতীয় গাণিতিক চিন্তাধারার ক্ষেত্রে আর্যভট্ট ও ব্রহ্মগুপ্তের নাম উল্লেখযোগ্য। আরযভট্ট রচিত বিখ্যাত গ্রন্থ সূর্যসিদ্ধান্ত। তিনি পৃথিবীর পরিক্রমণ এবং চন্দ্রগ্রহণ ও সূর্যগ্রহণের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেন। জ্যোতিষশাস্ত্রের ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখে বরাহমিহিরের পঞ্চসিদ্ধান্তিকা গ্রন্থটি। দশমিকের ব্যবহার এই যুগেই শুরু হয়। সুশ্রুত ছিলেন একালের অসাধারণ শল্য চিকিৎসক। অনেকেরই ধারণা ধন্বন্তরী এই যুগেরই ছিলেন। ধাতুশিল্পেরও এই পর্বে ব্যপক অগ্রগতি ঘটে। এই যুগে নির্মিত দিল্লির লৌহস্তম্ভটিতে আজও মরচে ধরে নি।
একথা ঠিক যে, সাহিত্য ও শিল্পকলার ক্ষেত্রে বিশেষ উন্নতি ঘটেছিল। তবে সুবর্ণ যুগ বলতে এমন এক যুগকে বোঝানো উচিত, যে যুগের সমাজ ব্যবস্থায় কোনও ভেদাভেদ থাকবে না। গুপ্ত যুগের সাহিত্যে বর্ণবৈষম্য কে তুলে ধরা হয়েছে, যেখানে উচ্চ-নীচ এই বিভাজন স্পষ্ট। এছাড়া স্মৃতি গ্রন্থ গুলি থেকেও জানা যায় যে, এ যুগে বর্ণবৈষম্য কতটা প্রকট হয়েছিল। এ যুগের সমাজ ব্যবস্থায় অস্পৃশ্যতা পূর্ববর্তী যুগের তুলনায় প্রকট আকার ধারণ করেছিল। গুপ্ত যুগে নারীদের অবস্থাও খুব একটা উন্নত ছিল না। বাল্যবিবাহ ও সতীদাহ প্রথা প্রচলিত ছিল। ছেলেদের মত মেয়েদের প্রথাগত শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল না।
গুপ্ত যুগকে সুবর্ণ যুগ বলার বিরুদ্ধে যে সমস্ত পন্ডিত আপত্তি তুলেছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন দিজেন্দ্র নারায়ণ ঝাঁ, রামশরণ শর্মা, ডি.ডি কোশাম্বী প্রমুখ। তাঁরা দেখিয়েছেন এই যুগে অগ্রহার ব্যবস্থার মাধ্যমে ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের নিষ্কর ভূমি দানের মাধ্যমে এক ভূম্যাধিকারী শ্রেণীর উত্থান ঘটেছিল এব স্বাধীন কৃষকদের অবস্থা নিচে নেমে গিয়েছিল। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে তাদের অবস্থা প্রায় দাসত্বের পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। অর্থনৈতিক দিক থেকেও যে গুপ্ত যুগ খুব বেশি সমৃদ্ধশালি ছিল তা বলা যায় না। পূর্ববর্তী কুষাণ যুগের তুলনায় এই যুগের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বেশি ছিল না। এই যুগে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সাথে বাণিজ্য সচল থাকলেও তা রোম ভারত বাণিজ্যের মত সমৃদ্ধশালী ছিলনা। মুদ্রা ব্যবস্থার দিক থেকেও এই যুগকে সুবর্ণ যুগ বলা চলে না। এই যুগে স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রার প্রচলন ছিল, তবে তা কুমারগুপ্তের সময় পর্যন্তই ঠিকঠাক ছিল। এরপর স্বর্ণমুদ্রায় খাদের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। গুপ্ত যুগের সাহিত্য আলোচনা করলে দেখা যাবে এগুলো সাধারণত রচিত হয়েছিল সংস্কৃত ভাষায়, যা ছিল উচ্চ শ্রেণীর মানুষের ভাষা। তবে একথা ঠিক যে এযুগে কাব্য নাটকের মান খুবই উন্নত ছিল। আবার অজন্তার গুহাচিত্রকলা বা মথুরা সারনাথ পাটলিপুত্রের ভাস্কর্য নিখুঁত ভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে এগুলি সবই উচ্চবিত্ত মানুষের রুচিবোধ এর দিকে তাকিয়ে তৈরি হয়েছিল। সর্বোপরি গুপ্ত যুগের সাহিত্য, শিল্প, অর্থনীতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে যে উন্নতি ঘটেছিল, তা সবই একটি নির্দিষ্ট শ্রেণীর মানুষের জন্য। তাই ডি.এন. ঝা বলেছেন ভারতবর্ষের ইতিহাসে অতীতে কখনোই সুবর্ণ যুগ ছিল না। সমাজে একটা শ্রেণীর সুবর্ণ যুগ তো সমস্ত কাল ও যুগে বিরাজমান থাকে। সমগ্র শ্রেণীর মানুষের জন্য সত্যিকারে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের পরিবেশ গুপ্ত যুগ কেন, কোনও যুগেই ছিল না।
উপরের সমালোচনাগুলি অবশ্যই গ্রহনযোগ্য। তবে ইতিহাসের কোনো পর্বকে যখন আমরা স্বর্ণযুগ আখ্যায় ভূষিত করি তখন তার কতকগুলি অতি উজ্জ্বল বৈশিষ্ট্যের প্রতি নির্দেশ করা হয়। গুপ্তযুগের শিল্প সাহিত্য সেই মর্যাদাই বহন করে। যা প্রকৃতই শ্রদ্ধেয় তার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে কেবলমাত্র নেতিবাচক দিকগুলি যদি আমরা তুলে ধরি তবে বিচারের ভারসাম্য বজায় থাকে না। পৃথিবী থেকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য এখনো দূর হয়নি। গুপ্ত যুগে এরূপ ভেদ থাকবে না এমন আশা করা যায় না। এই সময়ে যে সামন্ততন্ত্রের বিস্তারের কথা বলা হয়েছে তা এখনো পর্যন্ত বিতর্কিত। বাণিজ্যিক অবনতি, নাগরিক অবনতি এবং মুদ্রা ব্যবস্থার অবনতির ব্যাপারটিও সর্বজনগ্রাহ্য নয়। তাছাড়া অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি কেবল একটি শ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল এমন ভাবলে ভুল হতে পারে; কারণ গুপ্ত যুগে বহু তামা ও লোহার বস্তু ব্যবহারে নিদর্শন পাওয়া গেছে, যা সাধারণ মানুষেরই ব্যবহারের দ্রব্য।
সুতরাং সমাজের সামগ্রিক স্বর্ণযুগের সন্ধান যদি করা যায় তাহলে গুপ্ত যুগকে হয়তো স্বর্ণযুগ বলা যাবে না। তবে সৃজনশীলতার দিক থেকে অবশ্যই এই যুগ সবচেয়ে অগ্রগামী যুগ হিসাবে নিজেকে তুলে ধরতে পেরেছিল।
The Golden Age Debate in Indian History
During the Renaissance in 15th-century Europe, scholars were deeply engrossed in the search for a "Golden Age" in European history. Overlooking the medieval legacy, they sought to rediscover themselves in the classical cultures of ancient Greece and Rome. The intervening centuries came to be labeled as the "Dark Ages," while classical traditions were celebrated in the realms of knowledge and life. Similarly, in the 18th century, while exploring Indian studies, early Orientalists identified a culture in ancient India that was deemed comparable in magnificence to Europe’s classical heritage. This culture was that of the Gupta period, which came to be known as India’s "Golden Age."
Between 330 CE and 550 CE, the Gupta dynasty ruled over vast territories of India. During their reign, there were unparalleled advancements in language, literature, science, architecture, sculpture, and painting. Observing these achievements, scholars termed this period the "Golden Age." Vincent Smith likened Samudragupta to Napoleon of India and compared the Gupta period to the Elizabethan and Stuart eras of England. Barnett compared the Gupta era to the Periclean age of Greece.
The Gupta period witnessed remarkable achievements in art, literature, and science. The era’s sculptures, featuring extraordinary depictions of various deities—whether Brahmanical or Buddhist—stand out. Notable examples include the Buddha statues from Sanchi, Sarnath, and Mathura. Terracotta was also extensively used in addition to stone as a medium for sculpture. In painting, the cave murals of Ajanta serve as a prime example of Gupta artistry. Architecture thrived with the construction of stupas and chaityas, such as the Dhamek Stupa in Sarnath. Cave temples in Ajanta and Ellora reflect the exceptional craftsmanship of the era’s artists. The Gupta period also marked the beginning of brick and stone temple construction, as seen in the Dasavatar Temple in Deogarh and the temple at Bhitargaon.
The literary works of this era also testify to the Gupta period's cultural creativity. Sanskrit became the dominant medium of literary expression, with Kalidasa emerging as a leading figure. His notable creations include Raghuvamsa, Abhijnanasakuntalam, Meghaduta, Kumarasambhava, and Ritusamhara. Other significant works include Sudraka’s Mrichchhakatika and Vishakhadatta’s Mudrarakshasa. Many Gupta rulers were not only patrons of literature but also poets and scholars themselves. Samudragupta earned the title "Kaviraja" (King of Poets). This period also saw contributions to Sanskrit prose literature by authors such as Vishnusharma and Dandi.
Scientific pursuits flourished during the Gupta period. In mathematics, Aryabhata and Brahmagupta made significant contributions. Aryabhata’s celebrated work, the Surya Siddhanta, explained the earth’s rotation and provided scientific explanations for solar and lunar eclipses. Varahamihira’s Panchasiddhantika made notable contributions to astronomy. Decimal notation began during this era. In medicine, Sushruta emerged as an exceptional surgeon, and many believe Dhanvantari also belonged to this period. Metallurgy saw considerable progress, as exemplified by the iron pillar in Delhi, which remains rust-free to this day.
While it is true that the Gupta period excelled in arts and literature, the claim of it being a "Golden Age" for the entire society is debatable. Literature from this era reflects stark caste divisions, emphasizing societal inequalities. Texts from the period highlight the prevalence of untouchability and reinforce the caste hierarchy. The status of women was far from progressive, with practices like child marriage and sati being common. Educational opportunities for women were limited compared to men.
Prominent scholars like D.N. Jha, R.S. Sharma, and D.D. Kosambi has criticized the notion of the Gupta period as a Golden Age. They point out that during this time, land grants to Brahmin priests led to the rise of a landed aristocracy, while the status of independent farmers declined, at times reaching near servitude. Economically, the Gupta period was not markedly more prosperous than the preceding Kushana era. While trade with Southeast Asia continued, it was not as lucrative as the Indo-Roman trade. The decline in coinage quality after Kumaragupta's reign also indicates economic challenges. Furthermore, the literature and art of the Gupta period were predominantly produced for and appreciated by the elite class, with limited impact on the broader population.
Although these criticisms are valid, when we designate a historical period as a "Golden Age," we typically focus on its outstanding achievements. The Gupta era's contributions to art and literature justify such recognition. Dwelling solely on its shortcomings would skew the balance of historical judgment. Social and economic inequalities persist even today, making it unreasonable to expect their absence in the Gupta period. While claims about feudal expansion, trade decline, and currency devaluation remain contentious, the evidence of copper and iron artifacts from the era suggests that economic benefits were not confined to the elite.
In conclusion, while the Gupta period may not represent a "Golden Age" for all societal strata, it undeniably stands out as an era of remarkable cultural and intellectual creativity.
OK. Sir
উত্তরমুছুনভালো তবে খুব সংক্ষিপ্ত
উত্তরমুছুন