সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

গুপ্তযুগে কি স্বর্ণযুগ

Please visit our Homepage and Subscribe us.

330 খ্রিস্টাব্দ থেকে 550 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময় কালে ভারতের বৃহৎ অঞ্চলে গুপ্ত বংশীয় শাসকেরা রাজত্ব করেছিলেন। গুপ্তদের  রাজত্বকালে ভাষা, সাহিত্য, বিজ্ঞান, স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও চিত্রকলায় অভূতপূর্ব বিকাশ ঘটেছিল। এই সমস্ত উৎকর্ষতার দিকে তাকিয়ে পণ্ডিতরা এই যুগকে নানা অভিধায় ভূষিত করেছেন। সর্বোপরি গুপ্ত যুগকে 'সুবর্ণ যুগ'  বলে অভিহিত করার রেওয়াজ দীর্ঘদিন ধরেই আছে। আমরা এখানে আলোচনা করার চেষ্টা করব গুপ্ত যুগকে 'সুবর্ণ যুগ' বলা যুক্তিসঙ্গত কিনা।
শিল্পকলা সাহিত্য ধর্মীয় ধ্যান-ধারণার ক্ষেত্রে গুপ্তযুগে অসামান্য উৎকর্ষতা লাভ করেছিল। শিল্পের ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছে ভাস্কর্যের অতুলনীয় নিদর্শনগুলি। বিভিন্ন দেব দেবীর প্রতিমা, তা ব্রাহ্মণ্য বা বৌদ্ধ, যাইহোক না কেন। ভাস্কর্যের মাধ্যম হিসেবে কেবলমাত্র পাথর নয়, পোড়ামাটির ব্যবহারও ছিল প্রচুর। এই সময়ের শিল্পকলার নিদর্শন মেলে চিত্র শিল্পে। অজন্তার গুহাচিত্র গুলি তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এই সময় স্থাপত্য শিল্পে স্তূপ ও চৈত্য নির্মাণ অব্যাহত ছিল। স্তূপের অন্যতম নিদর্শন সারনাথের ধামেক স্তূপ। গুপ্ত যুগেই মন্দির স্থাপত্য রীতির সূচনা হয়েছিল।

গুপ্ত যুগের সংস্কৃতিক সৃজনশীলতার অসামান্য সাক্ষ্য বহন করে এই পর্বের বহুবিধ সাহিত্য কীর্তি। এই যুগে প্রধানত সংস্কৃত ভাষাকে কেন্দ্র করে সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে। সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য ছিলেন কালিদাস। তাঁর উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি হল রঘুবংশম্, অভিজ্ঞান শকুন্তলম্, মেঘদূতম্, কুমারসম্ভব, ঋতুসংহার প্রভৃতি। এছাড়াও শূদ্রকের মৃচ্ছকটিকম্ ও বিশাখদত্তের মুদ্রারাক্ষস উল্লেখযোগ্য। এই যুগে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চারও প্রভূত উন্নতি হয়েছিল ভারতীয় গাণিতিক চিন্তাধারার ক্ষেত্রে আর্যভট্ট ও ব্রহ্মগুপ্তের নাম উল্লেখযোগ্য। জ্যোতিষশাস্ত্রের ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখে বরাহমিহিরের পঞ্চসিদ্ধান্তিকা গ্রন্থটি। গুপ্ত যুগে সাংস্কৃতিক ও জ্ঞান বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এই অসামান্য তার দিকে লক্ষ্য রেখে অনেকেই যুগকে সুবর্ণ যুগ বলে অভিহিত করেন।

একথা ঠিক যে, সাহিত্য ও শিল্পকলার ক্ষেত্রে বিশেষ উন্নতি ঘটেছিল। তবে সুবর্ণ যুগ বলতে এমন এক যুগকে বোঝানো উচিত, যে যুগের সমাজ ব্যবস্থায় কোনও ভেদাভেদ থাকবে না। গুপ্ত যুগের সাহিত্যে বর্ণবৈষম্য কে তুলে ধরা হয়েছে, যেখানে উচ্চ-নীচ এই বিভাজন স্পষ্ট। এছাড়া স্মৃতি গ্রন্থ গুলি থেকেও জানা যায় যে, এ যুগে বর্ণবৈষম্য কতটা প্রকট হয়েছিল। এ যুগের সমাজ ব্যবস্থায় অস্পৃশ্যতা পূর্ববর্তী যুগের তুলনায় প্রকট আকার ধারণ করেছিল। গুপ্ত যুগে নারীদের অবস্থাও খুব একটা উন্নত ছিল না। বাল্যবিবাহ ও সতীদাহ প্রথা প্রচলিত ছিল। ছেলেদের মত মেয়েদের প্রথাগত শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল না।

গুপ্ত যুগকে সুবর্ণ যুগ বলার বিরুদ্ধে যে সমস্ত পন্ডিত আপত্তি তুলেছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন রামশরণ শর্মা, ডি.ডি কোশাম্বী প্রমুখ। তাঁরা দেখিয়েছেন এই যুগে অগ্রহার ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের নিষ্কর ভূমি দানের মাধ্যমে এক ভূম্যাধিকারী শ্রেণীর উত্থান ঘটেছিল ও স্বাধীন কৃষকদের অবস্থা নিচে নেমে গিয়েছিল। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে তাদের অবস্থা প্রায় দাসত্বের পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। অর্থনৈতিক দিক থেকেও যে গুপ্ত যুগ খুব বেশি সমৃদ্ধশালি ছিল তা বলা যায় না। পূর্ববর্তী কুষাণ যুগের তুলনায় এই যুগের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বেশি ছিল না।এই যুগে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সাথে বাণিজ্য সচল থাকলেও তা রোম ভারত বাণিজ্যের মত সমৃদ্ধশালী ছিলনা। মুদ্রা ব্যবস্থার দিক থেকেও এই যুগকে সুবর্ণ যুগ বলা চলে না এই যুগে স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রার প্রচলন ছিল, তবে তা কুমারগুপ্তের সময় পর্যন্তই ঠিকঠাক ছিল। এরপর স্বর্ণমুদ্রায় খাদের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। গুপ্ত যুগের সাহিত্য আলোচনা করলে দেখা যাবে এগুলো সাধারণত রচিত হয়েছিল সংস্কৃত ভাষায়, যা ছিল উচ্চ শ্রেণীর মানুষের ভাষা। তবে একথা ঠিক যে এযুগে কাব্য নাটকের মান খুবই উন্নত ছিল। আবার অজন্তার গুহাচিত্রকলা বা মথুরা সারনাথ পাটলিপুত্রের ভাস্কর্য নিখুঁত ভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে এগুলি সবই উচ্চবিত্ত মানুষের রুচিবোধ এর দিকে তাকিয়ে তৈরি হয়েছিল। সর্বোপরি গুপ্ত যুগের সাহিত্য, শিল্প, অর্থনীতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে যে উন্নতি ঘটেছিল, তা সবই একটি নির্দিষ্ট শ্রেণীর মানুষের জন্য। তাই ডি.এন. ঝা বলেছেন ভারতবর্ষের ইতিহাসে অতীতে কখনোই সুবর্ণ যুগ ছিল না। সমাজে একটা শ্রেণীর সুবর্ণ যুগ তো সমস্ত কাল ও যুগে বিরাজমান থাকে। সমগ্র শ্রেণীর মানুষের জন্য সত্যিকারে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের পরিবেশ গুপ্ত যুগ কেন, কোনও যুগেই ছিল না।

Thanks for reading.

Pravat Bhushan Bondyopadhaya
Lecturer, Sonarpur Mahavidyalaya.

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য Please visit our Homepage and subscribe us. Suggested Topics || Ghajnavid Invasion || গজনী আক্রমণ || || মামুদের সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন || Somnath Temple Plunder || || তরাইনের যুদ্ধ ও তার গুরুত্ত্ব || মহম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমন ও তার চরিত্র || সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আ...

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগ...

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হ...