সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

বিজ্ঞান বিপ্লব ও আধুনিক শরীর বিজ্ঞান | The Scientific Revolution and Modern Physiology

বিজ্ঞান বিপ্লব ও আধুনিক শরীর বিজ্ঞান

বিজ্ঞান বিপ্লবের সময় বিজ্ঞানীদের দৃষ্টি শুধু দূর আকাশেই নিবদ্ধ ছিল না, তা মানবদেহের প্রতিও অভিনিবিষ্ট করেছিল। মানুষ নিজেই ছিল এক ক্ষুদ্র বিশ্ব-- এক অনুবিশ্ব। এহেন মানব দেহ কিভাবে কাজ করে তার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছিলেন একের পর এক গ্রিক ডাক্তার যাদের কূলচূড়ামণি হিসাবে অবশেষে আবির্ভূত হন গ্যালেন। গ্যালেন এর তত্ত্ব টলেমির মহাকাশ বর্ণনার মতোই আপ্ত-মর্যাদা লাভ করেছিল। কিন্তু আধুনিক বৈজ্ঞানিক গবেষণায় গ্যালেন তত্ত্বের বহু ভুল সামনে এলো এবং শরীর বিজ্ঞানে অভূতপূর্ব পরিবর্তন ঘটে গেল।

কোপার্নিকাস যখন সৌরকেন্দ্রিক ব্রম্ভান্ডের চিত্র আঁকছিলেন তখন পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আন্দ্রিয়াস ভেসালিয়াস (1514-64) শব ব্যবচ্ছেদ করে মানব শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সম্পর্কে বিশদ বিবরণ দিলেন (De Humani Corporis Fabrica-- 1543)। ফলে গ্যালেনের শরীরতত্ত্ব এর বহু ভ্রান্তি দূর হল।

আন্দ্রেয়াস ভেসলিয়াসের
 রেখাচিত্র
ইংরেজ বিজ্ঞানী উইলিয়াম হার্ভে (1587-1657) শরীরে রক্ত চলাচলের একটি বলবিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। গ্যালেনের মত অনুযায়ী সকলেই বিশ্বাস করত যে, শিরার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত রক্তের রং নীল আর ধমনীতে রক্তের রং লাল। তাই শিরা ও ধমনীর রক্ত চলাচলের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই। ধমনীর রক্ত শরীরকে সবসময় উজ্জীবিত করে আর শিরার রক্ত যকৃতের মধ্য দিয়ে শরীরে পুষ্টি যোগায়। 1628 সালে প্রকাশিত তার Exercitatio Anatomica de Motu Cordis et Sanguinis in Animalibus গ্রন্থটির এক নতুন ধরনের anatomy ও phisiology র দলিল। নিছক দেহ  ব্যবচ্ছেদ ও তার বিবরণ নয়, হাইড্রোলিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর ফলিত পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে পরিচালিত গবেষণার ফসল হল এই গ্রন্থটি। হার্ভে দেখালেন কিভাবে হৃদপিণ্ড পাম্প করে শিরা ও ধমনীতে রক্ত পাঠায় এবং সেই রক্ত পরিশুদ্ধ হতে আবার ফিরে আসে হৃদপিণ্ডে। গ্যালিলিও যেভাবে চাক্ষুষ প্রমাণ দেখাতে পেরেছিলেন হারভের পক্ষে তা সম্ভব ছিল না। কারণ শরীরের মধ্যে রক্ত যে চলাচল করে সেটা যুক্তি দিয়ে বোঝানো সম্ভব ছিল; কিন্তু সেটার চাক্ষুষ করা তখন তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। চুলের মতো সূক্ষ্ম যেসব কৌশিক রক্তবাহ বা capillary vessels বেয়ে রক্ত প্রবাহিত হয়, পরে 1624 সালে মাইক্রোস্কোপের সাহায্যে সেগুলি দেখান ইতালীয় বিজ্ঞানী মালপিগি। কোপার্নিকাসের বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের গঠন বিন্যাসের সঙ্গে শরীরের গঠন বিন্যাসের সাদৃশ্য তিনি বিশ্বাস করতেন। তাই বলেছিলেন, হৃদপিণ্ড হল এই শরীর নামক অনুবিশ্বের সূর্য বা কেন্দ্র। তারই স্পন্দনে শরীরে রক্ত সচল থাকে, শুদ্ধ থাকে, জীবনময় থাকে, নষ্ট হয়ে বা শুকিয়ে যায় না।

চিকিৎসা ক্ষেত্রে হার্ভের এই আবিষ্কার তেমন কোন তাৎক্ষণিক প্রভাব ফেলেনি। চিকিৎসকেরা প্রধানত গ্যালেনের ওপরই নির্ভর করত। রক্ত বেরিয়ে গেলে যে মানুষের মৃত্যু ঘটে তা রোধ করার উদ্দেশ্যে পারে (Pare)  প্রমূখ শল্যবিদ যেসব পদ্ধতি ইতিমধ্যে প্রয়োগ করেছিলেন, তাকে অবশ্য হারভের আবিষ্কার যুক্তিসঙ্গত বলে প্রমাণ করল। কিন্তু এই তত্ত্বের আসল গুরুত্ব এই যে, যুক্তিশাসিত সত্যিকারের একটা শক্তপোক্ত বনেদ তৈরি হয়ে গেল। সপ্রাণ জীব সম্পর্কে যে ছবিটা ধীরে ধীরে গড়ে উঠল সেটা এরকম-- 'জলসেচিত ক্ষেত্রের' মত একগুচ্ছ অঙ্গের মধ্য দিয়ে রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে আর তারই ফলে রাসায়নিক উপায়ে প্রতিটি অঙ্গ পুষ্টি লাভ করছে এবং বাকি অঙ্গসমূহের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে।

The Scientific Revolution and Modern Physiology  


During the Scientific Revolution, scientists did not focus solely on the distant skies—they also turned their attention to the human body. The human being was itself a microcosm, a miniature universe. Detailed explanations of how the human body functioned were provided by a succession of Greek physicians, culminating in Galen, who stood as the pinnacle of medical knowledge. Galen’s theories gained the same authoritative status as Ptolemy’s celestial descriptions. However, modern scientific research exposed many errors in Galen’s theories, leading to unprecedented changes in physiology.  

While Copernicus was sketching his heliocentric model of the universe, Andreas Vesalius (1514–64), a professor at the University of Padua, conducted human dissections and provided detailed descriptions of the body’s organs (De Humani Corporis Fabrica, 1543). This corrected many of Galen’s anatomical misconceptions.  

The English scientist William Harvey (1587–1657) sought to provide a mechanical explanation for blood circulation in the body. According to Galen’s teachings, it was widely believed that blood in the veins was blue, while arterial blood was red, and that the two circulatory systems had no connection. Arterial blood was thought to constantly invigorate the body, while venous blood carried nutrients from the liver. In his 1628 work, *Exercitatio Anatomica de Motu Cordis et Sanguinis in Animalibus*, Harvey presented a new kind of anatomical and physiological documentation. This was not merely a record of dissections but the result of applied hydraulic engineering experiments. Harvey demonstrated how the heart pumps blood through veins and arteries, and how this blood, after being purified, returns to the heart. Unlike Galileo, who could provide visual proof of his discoveries, Harvey could not directly observe blood circulation inside the body—it had to be logically deduced. The existence of capillary vessels, through which blood flows in hair-thin channels, was later confirmed by the Italian scientist Malpighi in 1624 using a microscope.  

Harvey believed in the analogy between the structure of the universe, as described by Copernicus, and the structure of the human body. He declared that the heart was the sun or center of this microcosm called the body. Its pulsation kept the blood in motion, purified it, sustained life, and prevented decay or stagnation.  

Harvey’s discovery did not have an immediate impact on medical practice. Physicians still primarily relied on Galen. However, his theory logically justified surgical methods already in use, such as those employed by Ambroise Paré to prevent death from blood loss. The true significance of Harvey’s theory lay in establishing a rational, evidence-based foundation for physiology. The emerging understanding of living organisms was this: blood flows through a network of organs like water through an irrigated field, chemically nourishing each organ and maintaining communication among them.


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযানঃ প্রত্যক্ষ কারণ ও তাৎপর্য | Arab Conquest of Sindh: Immediate Causes and Significance

আরবদের সিন্ধু অভিযানঃ প্রত্যক্ষ কারণ ও তাৎপর্য সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আগেও বহুবার ভারতের বিভিন্ন জায়গায় অভিযান পাঠানো হয়েছিল। তবে এই(712 খৃ:) অভিযানের একটি প্রত্যক্ষ কারণ ছিল। জানা যায় যে সিংহলের রাজা ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ কে কয়েকটি জাহাজে করে উপঢৌকন পাঠাচ্ছিলেন কিন্তু পথে সিন্ধু দেশের জলদস্যুরা দেবল বন্দরে এ...

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগ...

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হ...