সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

রাজকীয় ভূমিদান বা অগ্রাহার | Royal Land Grant

রাজকীয় ভূমিদান বা অগ্রাহার

খ্রিষ্টীয় চতুর্থ থেকে সপ্তম শতক এবং তার পরবর্তীকালে সমগ্র আদিমধ্য যুগ জুড়ে ভারতীয় অর্থনীতি, সমাজ ও রাজনীতির মূল চালিকাশক্তি ছিল অগ্রাহার তথা রাজকীয় ভুমিদান ব্যবস্থা। মন্দির, দেবালয় বা বৌদ্ধ মঠ এর উদ্দেশ্যে এবং ব্রাহ্মণ পুরোহিতের উদ্দেশ্যে নিষ্কর সম্পত্তি দানের ব্যবস্থা অগ্রাহার নামে পরিচিত। সংখ্যায় কম হলেও ধর্মনিরপেক্ষ ভুমিদানও ছিল। অবশ্য ব্রাহ্মনকে ভুমিদান করার নজির সবচেয়ে বেশি। ভূমিদান  দুই প্রকার: কখনো  সরাসরি  রাজকীয় দান হিসেবে ভূমি হস্তান্তরিত হত।  কখনও ব্যক্তিবিশেষ পূণ্য অর্জনের জন্য রাজার থেকে জমি ক্রয় করে দান করতেন। সাধারণত রাজকীয় 'শাসন' হিসেবে ভূসম্পদ হস্তান্তরের ঘটনা উৎকীর্ণ করা হত। ব্রাহ্মণ এর উদ্দেশ্যে দান করা হলে তাকে ব্রহ্মদেও এবং মন্দিরে উদ্দেশ্যে দান করা হলে তাকে দেবদান বলা হত।






রাজকীয় জমি দানের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে। মহাভারতে দানধর্ম পর্বে তিন প্রকার দানের কথা বলা হয়েছেঃ হিরণ্যদান, গোদান, এবং পৃথিবীদান অর্থাৎ ভূমিদান। তবে ভূমিদানকেই সবচেয়ে উৎকৃষ্ট বলা হয়েছে। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে রাজকীয় নির্দেশে ভূমিদান এর উল্লেখ রয়েছে। বৃহস্পতি স্মৃতিতে বলা হয়েছে যে, রাজা ব্রাহ্মণকে যে জমি দান করবে তা অবশ্যই নিষ্কর সম্পত্তি হবে।


ভিটারি লেখ

খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতক থেকে ভূমিদানের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। স্কন্দ গুপ্তের ভিতারি স্তম্ভ লেখ থেকে জানা যায়, বিষ্ণু মন্দির এর উদ্দেশ্যে রাজা স্কন্দগুপ্ত একটি গ্রাম দান করেছিলেন। আরো দু'খানি লেখ: গয়া এবং নালন্দা তাম্রশাসনে গ্রামদানের কথা উল্লিখিত হয়েছে, যার সময়কাল নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। গয়া তাম্রশাসনে গোপস্বামীন নামে এক ব্রাহ্মণের উদ্দেশ্যে এবং নালন্দা তাম্রশাসনে জয়ভট্টস্বামীন নামে এক ব্রাহ্মণের উদ্দেশ্যে গ্রামদানের কথা বলা হয়েছে। গুপ্তদের সমসাময়িক দক্ষিণ ভারতের বাকাটকরা 35 টি গ্রাম অগ্রহার এ পরিণত করেছিল যার মধ্যে 20টি রাজা প্রবরসেনের সময় প্রদত্ত হয়েছিল। বাকাটক রা অন্তত 13 টি ভূখন্ড দানের দৃষ্টান্ত রেখেছিলেন আয়তন 20 বিবর্তন থেকে 8000 নিবর্তন পর্যন্ত ছিল। কর্ণাটক এলাকার পল্লবরাও পিছিয়ে ছিলেন না। বাংলায় বৈন্যগুপ্তের শাসনকালে কুমিল্লা জেলায় একটি বৌদ্ধ বিহারকে 11 পাটক অনাবাদি জমি দান করা হয়েছিল


ব্যাপক হারে রাজকীয় ভূমিদানের ফলে ব্রাহ্মণ/ পুরোহিত সম্প্রদায় এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গুলির হাতে বিস্তর অর্থনৈতিক সুবিধা জমা হয়েছিল। দানগ্রহীতা গ্রাম বা ভূখন্ডের উপর কেবল রাজস্ব আদায়ের অধিকার লাভ করেননি। লেখমালায় 'চাটভাটঅপ্রবেশ' শব্দের ব্যবহার থেকে অনুমান করা হয় যে সেখানে নিয়মিত এবং অনিয়মিত রক্ষীবাহিনী প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। অর্থাৎ রামশরণ শর্মার মতে, দানগ্রহীতা রাজস্ব আদায়ের অধিকার এর পাশাপাশি গ্রামীণ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার অধিকারও পেয়ে গেছিল। দানগ্রহীতা ক্রমশ ভূস্বামীতে পরিণত হয়েছিল এবং ভূমি ব্যবস্থায় ত্রিস্তরীয় কাঠামো গড়ে উঠেছিল। স্মৃতিশাস্ত্রের উল্লিখিত এই তিনটি স্তর হল: মহীপতি বা রাজা, স্বামী বা জমির মালিক এবং কৃষক। শর্মার মতে, ভূম্যধিকারী অন্তর্বর্তী শ্রেণীর উত্থান প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রের প্রশাসনিক ও বিচার বিভাগীয় অধিকারকে সংকুচিত করেছিল। শর্মার সমালোচকরা  দেখিয়েছেন: চম্মক তাম্রশাসনে রাজা প্রবরসেন দানগ্রহীতাকে হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন যে, রাজদ্রোহের অপরাধ করলে রাজা দানগ্রহীতা ব্রাহ্মণের জমি কেড়ে নিতে পারেন। ব্রাহ্মণরা ভূস্বামীতে পরিণত হলে রাজদ্রোহের ঘটনা যে ঘটতে পারত তার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত এই  রাজকীয় নির্দেশে রয়েছে।


শর্মার অনুগামী  রমেন্দ্রনাথ নন্দী  ও কৃষ্ণমোহন  শ্রিমালী  দেখিয়েছেন যে,  অগ্রহার ব্যবস্থার  ফলে  রাজার  রাজস্বে ঘাটতি হয়েছিল। তবে একথা অনস্বীকার্য যে বহু অগ্রহার জমি ছিল পতিত ও অনাবাদী, বিশেষ করে পূর্বভারতে। দানগ্রহীতা সেইসব জমি কে চাষের আওতায় এনেছিল বলে আবাদি জমির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং এর ফলে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ারই কথা। তাছাড়া অগ্রাহার দানে ক্ষতির সম্মুখীন হলে রাজা কেন স্বেচ্ছায় জমিদান করতেন? অতএব অগ্রাহার নীতিতে অন্তর্বর্তী ভূম্যধিকারীর উত্থান মেনে নিলেও তার দ্বারা রাষ্ট্রের আর্থিক ও সার্বভৌম অধিকার সংকুচিত বা  বিপন্ন হত  কি না, বলা কঠিন। তবে জমিতে ব্যক্তি মালিকানার প্রসার ঘটেছিল একথা অনস্বীকার্য।

Royal Land Grant


Throughout the early medieval period, from the 4th to the 7th century AD and beyond, the agrarian land grant system, known as agrāhāra, was the main driving force behind India's economy, society, and politics. The practice of donating tax-exempt land to temples, shrines, Buddhist monasteries, and Brahmin priests was known as agrāhāra. Although secular land grants existed, they were fewer in number, with the majority of grants awarded to Brahmins. There were two types of land grants: some were directly transferred as royal gifts, while others were purchased by individuals from the king for religious merit and then donated. Typically, these transfers were recorded as royal “grants.” If the land was granted to a Brahmin, it was termed brahmadeya; if for a temple, it was known as devadāna.

The earliest mention of royal land grants appears in later Vedic literature. In the Mahabharata’s “Danadharma” section, three types of donations are mentioned: hiranyadāna (gold donation), godāna (cattle donation), and prithvidāna (land donation), with land donation considered the most superior. The Arthashastra by Kautilya also references land grants by royal decree. Brihaspati Smriti states that any land donated by a king to a Brahmin must be tax-exempt.


From the 4th century AD, the number of land grants increased significantly. The Vītari pillar inscription of Skandagupta reveals that he donated a village for a Vishnu temple. Two other records, the Gaya and Nalanda copperplate inscriptions, mention village donations, although there is some uncertainty about their dating. In the Gaya inscription, a village was granted to a Brahmin named Gopswami, while in the Nalanda inscription, a grant was made to a Brahmin named Jayabhattaswami. In southern India, the Vakatakas, contemporaries of the Guptas, transformed 35 villages into agrāhāras, with 20 villages granted during the reign of King Pravarasena. The Vakatakas left evidence of at least 13 land grants, with tracts ranging in size from 20 nivartanas to 8000 nivartanas. The Pallavas in Karnataka also actively participated in the land grant system. In Bengal, under the rule of Vainya Gupta, an 11-pataka plot of fallow land in the Comilla district was granted to a Buddhist monastery.

Due to the extensive practice of royal land grants, Brahmin priests and religious institutions accumulated significant economic power. The land grant recipients did not only receive tax rights over the lands but, as suggested by the term "chāṭavāta-apravésha" in the inscriptions, even had the right to restrict the entry of regular and irregular military forces. According to R.S. Sharma, this indicates that grant recipients held rights not only over tax collection but also over maintaining local law and order. Grant recipients increasingly became landowners, leading to the development of a three-tiered land structure. According to the Smriti Shastras, these three tiers were mahīpati (king), swāmi (landowner), and kārshaka (cultivator). Sharma suggests that the rise of intermediate land rights holders effectively narrowed the state’s administrative and judicial control. Critics of Sharma point out that, in the Chammak copperplate inscription, King Pravarasena warns grant recipients that if they commit acts of treason, the king can seize their lands. This royal edict subtly implies the possibility of rebellion from Brahmin landowners.

Followers of Sharma, including Ramendra Nath Nandi and Krishna Mohan Shrimali, have shown that the agrāhāra system led to revenue deficits for the king. However, it is undeniable that many agrāhāra lands, especially in eastern India, were fallow and uncultivated. Grant recipients brought these lands under cultivation, increasing the area of arable land, which likely led to increased agricultural output. Furthermore, if agrāhāra donations were causing harm to royal finances, why would the king voluntarily grant lands? Therefore, while the agrāhāra policy contributed to the rise of intermediate land rights holders, it is challenging to conclude definitively that it diminished the state's financial and sovereign authority. However, it is indisputable that private ownership of land had expanded significantly.

Thanks for reading.

মন্তব্যসমূহ

  1. শৈলেন্দ্র রাজা বালপুত্র দেব দেবপালের কাছে বিহারের পাঁচটি গ্রাম প্রার্থনা করেছিলেন বৌদ্ধ বিহার প্রতিষ্ঠা জন্য যা দেবপাল মঞ্জুর করেছিলেন। এটাও তো এক প্রকার দেবদান বলা যেতে পারে। অগ্রহার ব্যবস্থা তো তখনও বেশ সক্রিয় ছিল আদি মধ্যযুগের সময় ঘটনাটা ঘটেছিল।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য Please visit our Homepage and subscribe us. Suggested Topics || Ghajnavid Invasion || গজনী আক্রমণ || || মামুদের সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন || Somnath Temple Plunder || || তরাইনের যুদ্ধ ও তার গুরুত্ত্ব || মহম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমন ও তার চরিত্র || সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আ...

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগ...

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হ...