সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

|| ভারতীয় রাজনীতিতে গান্ধীর উত্থান || Rise of Gandhi

ভারতীয় রাজনীতিতে গান্ধীর উত্থান


ভারতীয় রাজনীতিতে গান্ধীর আগমন এক বৈপ্লবিক ঘটনা। ১৯১৫ খিস্টাব্দে গান্ধীর দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ভারতে ফেরত আসার আগের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে জুথিড  ব্রাউন 'উদ্দেশ্য মূলক সীমাবদ্ধতার রাজনীতি' বলে উল্লেখ করেছেন, যার মোদ্দা কথা এই যে, সীমিত সংখ্যক পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত লোকজন রাজনীতিতে অংশ নিতেন এবং এরা ব্রিটিশ রাজ যে সমস্ত সুযোগ সুবিধা এদেশীয়দের দিত সেগুলির পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে চাইতেন। ভারতবর্ষের সুদূরপ্রসারী সামাজিক বা অর্থনৈতিক পরিবর্তন ঘটানোর ব্যাপারে এরা ছিলেন উদাসীন। এই সীমিত রাজনীতির ব্যর্থতার পেক্ষাপটে সুরাট বিচ্ছেদের মত ঘটনা ঘটে। যদিও সাধারণ মানুষের চোখে এই চরমপন্থী ও নরমপন্থী দের মধ্যে কোন পার্থক্য ছিল না। চরমপন্থীরা তাদের আঁতুড়ঘর বাংলা, মহারাষ্ট্রে ও পাঞ্জাবে, বিপ্লবী সন্ত্রাসী কার্যকলাপের ফলে সরকার যে ব্যাপক দমননীতি শুরু করে, তাতে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। নরমপন্থীদের নিষ্ক্রিয় কার্যকলাপ তার গুরুত্ব পরিদর্শনে ব্যর্থ হয়। ভারতীয় রাজনীতিতে এই অচলাবস্থার প্রেক্ষাপটে গান্ধীর উত্থান ঘটে। প্রকৃতপক্ষে গান্ধীর যখন উত্থান ঘটে তখন তার প্রতিযোগী কেউ ছিলেননা।


গান্ধীজীর দর্শন ও রাজনৈতিক কর্মসূচি যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল, তার কারণ বুঝতে হলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ভারতবর্ষের সামাজিক অর্থনৈতিক পরিবেশের দিকে নজর দেওয়া দরকার। যুদ্ধের ফলে সামরিক খাতে যে ব্যাপক খরচ বেড়েছিল তা যুদ্ধ পরবর্তীকালে না কমিয়ে আরো বাড়িয়ে দেওয়া হয়, এর ফলে যুদ্ধ বাবদ ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। যা মেটানোর জন্য বাণিজ্য ও শিল্পের উপর অতিরিক্ত কর বৃদ্ধি করা হয়। এর ফলে পণ্যদ্রব্যের দাম প্রচুর বেড়ে যায়, যার সরাসরি প্রভাব পরে সাধারণ মানুষের হেঁশেলের উপর। তাছাড়া যুদ্ধরত সৈনিকদের খাদ্য পাঠানোর ফলে দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এর সাথে যুক্ত হয় ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারীর প্রকট। এরকম এক কঠিন সময়ে সেনাবাহিনীতে বলপূর্বক নিয়োগ অব্যাহত থাকে। ফলে গ্রামীণ সমাজের সকল স্তরের মানুষের মধ্যে অসন্তোষ জমতে থাকে। দ্বিতীয়তঃ যুদ্ধচলাকালীন পাট শিল্প এবং বস্ত্র শিল্পে ব্যাপক অগ্রগতি ঘটে। বৃহৎ শিল্পপতিরা ব্রিটিশদের প্রতি অনুগত থেকে, সরকারি সাহায্যের উপর নির্ভর করে ভালো পয়সা করে ফেলেছেন। শিল্পায়নের ফলে শ্রমিকশ্রেণীর বিস্তার ঘটেছিল। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি  অথচ মজুরী বৃদ্ধি না হওয়ার পেক্ষিতে শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে অসন্তোষ ধুমায়িত থাকে। যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি ছিল একের পর এক ধর্মঘট সুতরাং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরিণতিতে সমাজের গণঅভ্যুত্থানের পথ প্রশস্ত হয়েছিল এবং পাশ্চাত্যের কুৎসিত রূপ মানুষের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।


উপরোক্ত পেক্ষাপটে গান্ধী ভারতীয় রাজনীতিতে যে নতুন ধারা আমদানি করেছিলেন, তা ছিল পাশ্চাত্যের বিকল্প ধারা, যার ভিত্তি ছিল প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্য। তিনি মার্কসীয় শ্রেণী দ্বন্দ্বের তত্ত্বকে ভারতের প্রেক্ষাপটে অস্বীকার করে। তিনি উপলব্ধি করেন যে জনমানসে ধর্মের প্রভাব সবচেয়ে শক্তিশালী। এজন্য তিনি ধর্মের সনাতনী বক্তব্য গুলিকে সাফল্যের সাথে ব্যবহার করে "জনসাধারণ" কে আন্দোলনে শামিল করতে পেরেছিল। তবে তিনি চরমপন্থীদের পুনর্জাগরনবাদের পথে হাঁটেননি, ধর্মের নৈতিকতার কথা বলেছেন, যা সাধারণত অধরাই থেকে যায়।


গান্ধীর দর্শনের উৎস ভারতীয় বৈষ্ণব ও জৈন ধর্মদর্শন এবং ইউরোপীয় চিন্তাবিদ ডেবিড থরো, জন রাসকিন, এমারসন বা লিও টলস্টয় এর রচনাবলী। তিনি সরাসরি পাশ্চাত্যের আধুনিক সভ্যতার সমালোচনা করলেন। গান্ধীর দর্শন এর প্রামাণ্য দলিল হিসেবে যে গ্রন্থের কথা বলা যায় সেটি হল হিন্দ স্বরাজ। এখানেই তিনি জোরের সাথে বলেছেন, সুপ্রাচীন কাল থেকেই ভারতীয়রা 'জাতি' বা 'প্রজা' হিসেবে গঠিত। যেহেতু বিদেশীদের আত্মীয় রূপে বরণ করার অসীম ক্ষমতা ছিল। সেই সভ্যতা"মূলত যথার্থ"। যে সভ্যতা প্রাচীনকাল থেকেই নৈতিকতাকে তুলে ধরে আসছে, সেই সভ্যতার পশ্চিমের আধুনিক শিল্পসর্বস্ব ঈশ্বরহীন সভ্যতার কাছ থেকে শেখার কিছু নেই। কারণ এই আধুনিক সভ্যতা শুধুই অনৈতিকতার প্রচার করে। যেহেতু এই সভ্যতার অর্থনৈতিক কাজকর্মে নৈতিকতার কোনো স্থান নেই, তাই সহজেই এরা সাম্রাজ্যবাদের পথে হাঁটে।

গান্ধী ভারতবর্ষের পরাধীনতার জন্য ইংরেজদের কে নয়, ভারতীয়দের দায়ী করেছেন । কারণ ভারতীয়রা নিজেরাই ধণতন্ত্র কে আঁকড়ে ধরেছে  এবং তার রাজনৈতিক ও আইনি কাঠামো কে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়েছে। তিনি বিশ্বাস করেন রেলপথ, আইনজীবী ও ডাক্তারই দেশটাকে নিঃস্ব করে ফেলে।


ভারতীয় জাতির এই নিদারুণ কষ্টদায়ক পরিস্থিতির হাত থেকে রেহাই পাওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি যে বিধান দেন তা ছিল নৈতিক ও কাল্পনিক। তার মতে লোভ ও ভোগের আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করে প্রাচীনকালের সেই গ্রামীণ স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনীতিতে ফিরে যেতে হবে। সংসদীয় গণতন্ত্র জনগণের ইচ্ছাকে প্রকাশ করে না। সেখানে দলগুলির স্বার্থেই প্রতিফলিত হয়। কাজেই স্বাধীনতা অর্জন এবং "সাহেবদের বাদ দিয়ে সাহেবি শাসন" বজায় রাখার কোন মানে হয় না । পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক কাঠামোর বিকল্প হিসেবে তিনি 'গন সার্বভৌমত্বে'র কথা বলেন, যেখানেই প্রত্যেক ব্যক্তি নিজেই নিজেকে শাসন করবে অথবা সংযত করে চলবে। তিনি 'স্বরাজ' অর্জনের কথা বলেন। প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে এই 'স্বরাজ' কে বুঝবে। এই স্বরাজ অর্জন কঠিন হলেও অসম্ভব নয়, কারণ তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস, "ইতিহাসে যা ঘটেনি আদৌ তা ঘটবে না এই জাতীয় বিশ্বাস পোষণ করার অর্থ হল মানুষের মর্যাদা কে অবিশ্বাস করা"। তার মতে এই স্বরাজ অর্জন করতে হবে সত্যের শক্তি বা আত্মার শক্তি দিয়ে। একেই তিনি 'সত্যাগ্রহ' বলে অভিহিত করেছেন। বাস্তবে এটি আইন অমান্য হলেও সত্যাগ্রহের ভিত্তি ছিল প্রতিবাদীর সর্বোচ্চ নৈতিক শক্তি, যার দ্বারা সে নিপীড়নকারীর অন্তরের পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হবে।


প্রকৃতপক্ষে গান্ধীর রাজনৈতিক দর্শন কোনো পক্ষকেই রুদ্ধ করেনি। গান্ধীর ধর্মকে গুরুত্ব দেওয়া, সকলের উপদেয় রামরাজ্যের ধারণা, প্রচারের সময় হিন্দি ভাষার ব্যবহার এবং অতি অল্প পোশাকে জীবনযাপন, একেবারে সমাজের নিম্ন স্তরের মানুষের হৃদয়কে ছুঁয়ে গেছিল। তাছাড়া স্বরাজের অস্পষ্ট ব্যাখ্যা নরমপন্থী ও চরমপন্থী কাউকেই দূরে সরিয়ে দেয়নি। একদিকে স্বরাজের প্রসঙ্গ চরমপন্থীদের আকৃষ্ট করে, অন্যদিকে অহিংসার ধারণা নরমপন্থী ও সম্পদশালী লোকেদের ভীতি দূর করে। খিলাফৎ সমস্যাকে সমর্থন করে তিনি মুসলমানদের ধর্মগোঁড়া অংশকেও কাছে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। এখানেই তার সাফল্য।

************************** 
Thanks for reading.


মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য Please visit our Homepage and subscribe us. Suggested Topics || Ghajnavid Invasion || গজনী আক্রমণ || || মামুদের সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন || Somnath Temple Plunder || || তরাইনের যুদ্ধ ও তার গুরুত্ত্ব || মহম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমন ও তার চরিত্র || সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আ...

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগ...

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হ...