সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশন ও পাকিস্তান

Abdul Mojaffar Mondal
Assistant Professor, Sonarpur Mahavidyalaya

মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশন ও পাকিস্তান

পনিবেশিক ভারতে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি এবং পৃথক মুসলমান রাষ্ট্র পাকিস্তান গঠনের ইতিহাসে 1940 সালের 23 মার্চ আয়োজিত মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনের গুরুত্ব অপরিসীম। অংশত ব্রিটিশদের বিভেদ ও শাসননীতি, জাতীয়তাবাদী রাজনীতির হিন্দুকেন্দ্রীকতার ফলে ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বীজ বপন হয়েছিল। 1906 সালে মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার জন্য নতুন দল হিসাবে মুসলিম লীগ আত্মপ্রকাশ করেছিল এবং ধীরে ধীরে মুসলমানদের জন্য একটি পৃথক ব্যবস্থার দাবি উঠতে শুরু করেছিল।

ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র চৌধুরী রহমত আলী 1933 ও 1935 লেখা দুটি পুস্তিকায় মুসলমানদের এক নতুন সত্তার জন্য আলাদা জাতীয় মর্যাদা দাবি করেন। তিনি তার নাম চয়ন করেন 'পাকিস্তান' (পাঞ্জাব, আফগান প্রদেশ, কাশ্মীর, সিন্ধু ও বালুচিস্তান মিলিয়ে এই নামকরণ)। সেই সময়ে কেউই ব্যাপারটাকে খুব একটা গুরুত্ব দেননি। ছাত্রের অলস স্বপ্ন বলেই তার ধারণাটি কে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে 1938-39 এর সময় থেকে মুসলমানদের জন্য যে পৃথক ব্যবস্থার দাবি জোরদার হয়েছিল সেখানেও পৃথক রাষ্ট্রের কথা একবারও উঠে আসেনি। বরং আলগা ভারতীয় রাষ্ট্রের মধ্যেই চাওয়া হয়েছিল স্বায়ত্তশাসিত কয়েকটি মুসলিম ব্লক।

লাহোর অধিবেশনের বিখ্যাত প্রস্তাবটির মুসবিদা করেন সিকান্দার হায়াত খান। সেটি (বেশকিছু অদল-বদল করে) উত্থাপন করেন ফজলুল হক আর সমর্থন করেন খালিকুজ্জামান। ওই প্রস্তাবে দাবি করা হয় যে, ভৌগোলিকভাবে সন্নিহিত এলাকা গুলির সীমানা নির্দিষ্ট করে এবং সেই সঙ্গে প্রয়োজনীয় স্থানগত পূনর্বিন্যাস করে এমনভাবে অঞ্চল গঠন করতে হবে যাতে মুসলমানরা যেসব এলাকায় সংখ্যাগুরু সেগুলোকে একত্র করে ''কয়েকটি স্বাধীন রাষ্ট্র" গঠন করা যায়, যাদের অন্তর্ভুক্ত একক গুলি হবে স্বায়ত্তশাসিত ও সার্বভৌম।

উল্লেখযোগ্য বিষয় এটাই যে, উপরিউক্ত প্রস্তাবে কোথাও খোলাখুলি ভাবে 'পাকিস্তান' বা 'দেশভাগ' এর কথা উল্লেখ করা হয়নি। "স্থানগত পুনর্বিন্যাসে''র কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয় নি। "কয়েকটি স্বাধীন রাষ্ট্র" উদ্ধৃতির মধ্যে বিচ্ছন্নতার প্রসঙ্গ নিহিত থাকলেও এর অর্থ পৃথক রাষ্ট্র নাও হতে পারে, হতেও পারে একটি আলগা যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পূর্ন স্বায়ত্তশাসনের বেশী কিছু না।

বহুবচনের ব্যবহার এবং একক গুলির সার্বভৌমত্বের ওপর গুরুত্বটা দেশভাগের পরে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। পাঞ্জাবি আধিপত্যসহ এক কেন্দ্রীয় পাকিস্তানের ধারণার বিরুদ্ধে ফজলুল হকের সহযোগিতায় আওয়ামী লীগের যে আন্দোলন শুরু হয়, এ-ই ছিল তার তাত্ত্বিক ভিত্তি। 1941 সালে 11 ই মার্চ পাঞ্জাবের বিধানসভার হায়াত খান তাঁর বিখ্যাত বক্তৃতায় ঘোষণা করেছিলেন যে, তিনি এমন কোনো পাকিস্তানের পক্ষে নন, যেখানে নিখাদ মুসলমানের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা পাবে। এমনকি জিন্নার জিন্নার কাছেও এই প্রস্তাব ছিল দরকষাকষির একটি জায়গামাত্র। প্রকৃতপক্ষে লাহোর প্রস্তাবের এই অস্পষ্টতা ও নমনীয়তা ক্রমেই "পাকিস্তান"কে করে তুলেছে মুসলমান জনতার পক্ষে সুবিধাজনক নারা, যাকে কেন্দ্র করে কয়েক বছরের মধ্যেই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, যেখানে বলে দেওয়া হয় স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্রই হল যাবতীয় সমস্যার সেরা দাওয়াই।

মন্তব্যসমূহ

  1. 1906 সালে ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহ মুসলিম লীগ গঠন করেন।
    1939 সালে সুভাষচন্দ্র বসু ফরওয়ার্ড ব্লক গঠন করেন।
    1941 সালের 17 ই জানুয়ারি সুভাষচন্দ্র বসুর সেই বিখ্যাত মহানিষ্ক্রমণ ঘটেছিল।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযানঃ প্রত্যক্ষ কারণ ও তাৎপর্য | Arab Conquest of Sindh: Immediate Causes and Significance

আরবদের সিন্ধু অভিযানঃ প্রত্যক্ষ কারণ ও তাৎপর্য সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আগেও বহুবার ভারতের বিভিন্ন জায়গায় অভিযান পাঠানো হয়েছিল। তবে এই(712 খৃ:) অভিযানের একটি প্রত্যক্ষ কারণ ছিল। জানা যায় যে সিংহলের রাজা ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ কে কয়েকটি জাহাজে করে উপঢৌকন পাঠাচ্ছিলেন কিন্তু পথে সিন্ধু দেশের জলদস্যুরা দেবল বন্দরে এ...

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগ...

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হ...