Abdul Mojaffar Mondal
Assistant Professor, Sonarpur Mahavidyalaya
Assistant Professor, Sonarpur Mahavidyalaya
গ্লাসনস্ত ও পেরেস্ত্রৈকা এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন
1985 সালের মার্চ মাসে সংস্কারকামী বামপন্থী নেতা মিখাইল গর্বাচেভ সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক তথা সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহন করেন। তিনি লক্ষ্য করেন যে, সমগ্র সোভিয়েত ব্যবস্থার মধ্যে অন্তর্গত দুর্বলতা ও ব্যর্থতা পুরোদস্তুর অনাবৃত হয়ে গেছে এবং বিশেষ করে আর্থিকভাবে সোভিয়েত রাশিয়া দেউলিয়ার পর্যায়ে নেমে এসেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে নিত্যনতুন সমরাস্ত্র নির্মাণ ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করতে হয়েছে। ফলে অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছে, ভোগ্য পণ্যের উৎপাদন প্রায় স্তব্ধ হয়ে গেছে। জনগণের জীবনযাত্রার মান নিম্নমুখী হয়েছে। এই জটিল পরিস্থিতিতে সোভিয়েত ব্যবস্থাকে বাঁচিয়ে রাখতে, তিনি সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। তার গ্লাসনস্ত ও পেরেস্ত্রইকা নীতি ঘোষণার কিছুদিনের মধ্যেই বিভিন্ন ঘটনা পরম্পরায় সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটে।
গ্লাসনস্ত কথার অর্থ হল মুক্ততা (openness)। দীর্ঘদিনের একদলীয় এবং বদ্ধ শাসনে জনগণের মনে যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছিল তা দূর করার উদ্দেশ্যেই গ্লাসনস্ত নীতি গৃহীত হয়। এই প্রথম সোভিয়েত ইউনিয়নে গণমাধ্যমগুলিকে স্বাধীনতা দেওয়া হয়। একদলীয় শাসনের সমালোচনাকে গণতান্ত্রিক অধিকারের মর্যাদা দেওয়া হয়। 'প্রভদা'র মত কমিউনিস্ট মুখপত্রেও 'ব্রেজনেভ নীতি'র সমালোচনামূলক নিবন্ধ প্রকাশিত হতে থাকে। বিদেশের টেলিভিশন সম্প্রচার সোভিয়েত ইউনিয়নে অনুমোদিত হয়। ব্যাপকহারে স্যাটেলাইট টিভি সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রবেশ করে। ১৯তম সোভিয়েত পার্টি কংগ্রেসের কাজকর্ম সরাসরি টেলিভিশনে সম্প্রচারের উদ্যোগ গৃহীত হল, যা আগে ছিল কল্পনার অতীত। বহু কারারুদ্ধ ও নির্বাসিত-- যারা সোভিয়েত রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরোধিতা করেছিলেন-- তাদের মুক্তিও দেওয়া হয়।
পেরেস্ত্রৈকার অর্থ হলো অর্থনৈতিক পুনর্গঠন (Reconstruction) যাকে গর্বাচেভ Humanisation of Social Structure বলে অভিহিত করেছেন। এই নীতির মূল বক্তব্য ছিল সমাজতন্ত্রের আধারে এমন এক ব্যবস্থা গড়ে তোলা, যেখানে থাকবে একটি দক্ষ অর্থনীতি এবং সর্বোপরি একটি উন্নত বিজ্ঞান প্রযুক্তি নির্ভর ও গণতান্ত্রিক সমাজ কাঠামো। ঠান্ডা যুদ্ধের প্রয়োজনে সোভিয়েত ইউনিয়ন মূলত ভারী শিল্প বিশেষত সামরিক শিল্পের ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছিল। ফলে তথ্যপ্রযুক্তি, ইলেকট্রনিক বা এই ধরনের বিলাস দ্রব্যের উৎপাদন পরিকাঠামো গড়ে ওঠেনি। একই সাথে বিশ্ববাণিজ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন পিছিয়ে পড়েছিল। বাণিজ্য কেবল পূর্ব ইউরোপ এবং সমাজতান্ত্রিক শিবিরের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলির সঙ্গেই সীমাবদ্ধ ছিল। এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটানোর উদ্দেশ্যে অর্থনৈতিক উদারীকরণ এর নীতি গৃহীত হয়। সোভিয়েত বাজার বিভিন্ন বহুজাতিক সংস্থার কাছে উন্মুক্ত হয়। সোভিয়েত অর্থনীতিও বিদেশে বিনিয়োগের অনুমোদন পায়। পশ্চিম ইউরোপ ও মার্কিন এর সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন ক্রমশঃ Command Economy থেকে Market Economy র দিকে অগ্রসর হয়।
গর্বাচেভের সংস্কার কর্মসূচি ঘোষিত হওয়ার পর থেকে একের পর এক সমস্যা উদ্ভূত হয়। পার্টির অভ্যন্তরে তীব্র গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। বরিস ইয়েলৎসিন এর নেতৃত্বে ইয়াকোভোলেভ ও শেভারনাদজে প্রমূখ পার্টি নেতৃত্ব পূর্ণমাত্রায় বাজার অর্থনীতিসহ উদারীকরণ এবং রুশ কমিউনিস্ট পার্টিকে সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টিতে রূপান্তরের দাবি জানাতে থাকেন। গরবাচেভের সাথে মতপার্থক্যের জেরে মস্কোর পার্টি প্রধানের পদ থেকে বরিশ ইয়েলৎসিন কে বহিষ্কার করা হয়। অন্যদিকে সংস্কারবিরোধীরা ইগর লিগাচেভ ও ভি আই ভোরেটনিকভ এর নেতৃত্বে জোট বাধে। পার্টির সর্বত্র নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে পড়ার জন্য গর্বাচেভকেই তারা দায়ী করেন।
পার্টির মধ্যে প্রবল অন্তর্দ্বন্দ্বের সুযোগে বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য গুলিতে বিচ্ছিন্নতাবাদী উগ্র জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু হয় এমনকি মূল রুশ ভূখণ্ডে বরিশ ইয়েলৎসিনের উস্কানিতে রুশ প্রজাতন্ত্রের বিচ্ছিন্নতার দাবি বেশ জনপ্রিয় হয়। জর্জিয়া, লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া, এস্তোনিয়া প্রভৃতি প্রজাতন্ত্রগুলি বিচ্ছিন্নতার দাবি নিয়ে হাজির হয়। মুসলিম অধ্যুষিত আজারবাইজান-এ খ্রিস্টান জনগণ বিচ্ছিন্নতার দাবি তোলে এবং কিছুদিন পরেই সেখানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলে মস্কোর কোন নিয়ন্ত্রণ ছিল না।
এদিকে গর্বাচেভ বিরোধী প্রচার চালিয়ে ইয়েলৎসিন বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেন। কারণ গর্বাচেভ প্রবর্তিত সংস্কারগুলি বিশেষ সফল হয়নি। এই অবস্থায় গর্বাচেভ গণভোটের মাধ্যমে নয়টি প্রজাতন্ত্র কে আরও অধিকার দেওয়ার প্রস্তাব দিলেন (ইউনিয়ন চুক্তি 1991)। যদিও মোলডাভিয়া, জর্জিয়া, এস্তোনিয়া, লটভিয়া, লিথুয়ানিয়া ও কিরঘিজস্তান এই গণভোটে অংশ নেয়নি। নতুন ব্যবস্থায়, গর্বাচেভের হাতে থাকল কেবল অর্থ, প্রতিরক্ষা ও বিদেশ দপ্তর। আগস্টে ইউনিয়ন চুক্তি কার্যকর হল। এদিকে জুন মাসে ইয়েলৎসিন বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে রাশিয়ান ফেডারেশনের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলেন। তিনি রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির সমস্ত শাখা বন্ধ করে দিলেন।
অন্যদিকে কট্টরপন্থীদের একটি পদক্ষেপ সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন কে আরও ত্বরান্বিত করল। সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা (KGB) সম্মিলিতভাবে এক সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করে। তখন গর্বাচেভ ক্রিমিয়ায়। এই ঘটনায় কমিউনিস্ট পার্টি আরও কোণঠাসা হয়ে পড়ে এবং প্রজাতন্ত্রগুলির সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি আনুগত্য কার্যত বিলুপ্ত হয়। মর্মাহত গর্বাচেভ কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে ইস্তফা দেন।
ইয়েলৎসিন রাশিয়াকে কেন্দ্র করে পূর্বতন প্রজাতন্ত্র গুলিকে নিয়ে একটি রাষ্ট্র সমবায় গড়ে তুলতে উদ্যোগী হন। 18 ই ডিসেম্বর সুপ্রিম সোভিয়েতের কার্যভার রাশিয়ার পার্লামেন্টের উপর অর্পিত হওয়ার মধ্য দিয়ে সোভিয়েত রাষ্ট্রকাঠামোর ধ্বংস সম্পূর্ণ হল। এর সাথে আত্মপ্রকাশ করল স্বাধীন ও পূর্বতন অঙ্গরাজ্য গুলির রাষ্ট্র সমবায় Commonwealth of Independent States বা CIS (আলমা আটা চুক্তি )। 25 শে ডিসেম্বর, 1991 গর্বাচেভ সোভিয়েত রাষ্ট্র প্রধানের পদ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ইস্তফা দেন। এইভাবে দীর্ঘ 74 বছরের গৌরবময় সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটে।
পার্টির মধ্যে প্রবল অন্তর্দ্বন্দ্বের সুযোগে বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য গুলিতে বিচ্ছিন্নতাবাদী উগ্র জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু হয় এমনকি মূল রুশ ভূখণ্ডে বরিশ ইয়েলৎসিনের উস্কানিতে রুশ প্রজাতন্ত্রের বিচ্ছিন্নতার দাবি বেশ জনপ্রিয় হয়। জর্জিয়া, লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া, এস্তোনিয়া প্রভৃতি প্রজাতন্ত্রগুলি বিচ্ছিন্নতার দাবি নিয়ে হাজির হয়। মুসলিম অধ্যুষিত আজারবাইজান-এ খ্রিস্টান জনগণ বিচ্ছিন্নতার দাবি তোলে এবং কিছুদিন পরেই সেখানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলে মস্কোর কোন নিয়ন্ত্রণ ছিল না।
এদিকে গর্বাচেভ বিরোধী প্রচার চালিয়ে ইয়েলৎসিন বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেন। কারণ গর্বাচেভ প্রবর্তিত সংস্কারগুলি বিশেষ সফল হয়নি। এই অবস্থায় গর্বাচেভ গণভোটের মাধ্যমে নয়টি প্রজাতন্ত্র কে আরও অধিকার দেওয়ার প্রস্তাব দিলেন (ইউনিয়ন চুক্তি 1991)। যদিও মোলডাভিয়া, জর্জিয়া, এস্তোনিয়া, লটভিয়া, লিথুয়ানিয়া ও কিরঘিজস্তান এই গণভোটে অংশ নেয়নি। নতুন ব্যবস্থায়, গর্বাচেভের হাতে থাকল কেবল অর্থ, প্রতিরক্ষা ও বিদেশ দপ্তর। আগস্টে ইউনিয়ন চুক্তি কার্যকর হল। এদিকে জুন মাসে ইয়েলৎসিন বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে রাশিয়ান ফেডারেশনের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলেন। তিনি রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির সমস্ত শাখা বন্ধ করে দিলেন।
অন্যদিকে কট্টরপন্থীদের একটি পদক্ষেপ সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন কে আরও ত্বরান্বিত করল। সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা (KGB) সম্মিলিতভাবে এক সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করে। তখন গর্বাচেভ ক্রিমিয়ায়। এই ঘটনায় কমিউনিস্ট পার্টি আরও কোণঠাসা হয়ে পড়ে এবং প্রজাতন্ত্রগুলির সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি আনুগত্য কার্যত বিলুপ্ত হয়। মর্মাহত গর্বাচেভ কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে ইস্তফা দেন।
ইয়েলৎসিন রাশিয়াকে কেন্দ্র করে পূর্বতন প্রজাতন্ত্র গুলিকে নিয়ে একটি রাষ্ট্র সমবায় গড়ে তুলতে উদ্যোগী হন। 18 ই ডিসেম্বর সুপ্রিম সোভিয়েতের কার্যভার রাশিয়ার পার্লামেন্টের উপর অর্পিত হওয়ার মধ্য দিয়ে সোভিয়েত রাষ্ট্রকাঠামোর ধ্বংস সম্পূর্ণ হল। এর সাথে আত্মপ্রকাশ করল স্বাধীন ও পূর্বতন অঙ্গরাজ্য গুলির রাষ্ট্র সমবায় Commonwealth of Independent States বা CIS (আলমা আটা চুক্তি )। 25 শে ডিসেম্বর, 1991 গর্বাচেভ সোভিয়েত রাষ্ট্র প্রধানের পদ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ইস্তফা দেন। এইভাবে দীর্ঘ 74 বছরের গৌরবময় সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন