সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

সম্পত্তির উত্তরাধিকারঃ 300 BC-- 300 CE | Inheritance of Property: 300 BCE - 300 CE


সম্পত্তির উত্তরাধিকারঃ 300 BC-- 300 CE

কৃষিনির্ভর জটিল আর্থসামাজিক ব্যবস্থার উদ্ভবের ফলে ব্যক্তিগত সম্পত্তির আবির্ভাব ঘটে। ফলে খুব স্বাভাবিক ভাবেই সম্পত্তির উত্তরাধিকারের প্রশ্ন চলে আসে। সমকালীন ধর্মশাস্ত্র গুলিতে আমরা সম্পত্তির উত্তরাধিকার সংক্রান্ত নিয়মাবলী উল্লেখ পাই। এক্ষেত্রে গুপ্তযুগের মনুস্মৃতি, যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতি, নারদস্মৃতি, বৃহস্পতি স্মৃতি এবং কাত্যায়ন এর স্মৃতি গ্রন্থ বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

সম্পত্তির উত্তরাধিকার এবং বিভাজনের সুনির্দিষ্ট নিয়মাবলীর সর্বপ্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় মনুস্মৃতিতে। মনুর মতে জীবিত অবস্থায় পিতা চাইলে ইচ্ছামত নিজের সম্পত্তির বাটোয়ারা করতে পারেন। তার মৃত্যুর পর তার রেখে যাওয়া সম্পত্তি পুত্রদের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। মনু জ্যেষ্ঠ পুত্রের অগ্রাধিকারের কথা বলেছেন। তার মতে যদি জ্যেষ্ঠ পুত্রের অধীনে অন্যান্য পুত্ররা থেকে যায় তাহলে পিতার রেখে যাওয়া সম্পত্তির দেখভাল এর দায়িত্ব জ্যেষ্ঠপুত্র পাবে। আর যদি রাজি না হয় তাহলে সম্পত্তির যে বিভাজন হবে তার সিংহভাগ জ্যেষ্ঠই পাবে এবং বাকি অংশ সকল ভ্রাতার মধ্যে সমান ভাগে বন্টিত হবে। অবিবাহিতা কন্যারা ভ্রাতাদের অংশের এক-চতুর্থাংশ পাবে। মনুর ভাষ্যকার মেধাতিথি এ প্রসঙ্গে বলেছেন যে, ভ্রাতা তিন-চতুর্থাংশ এবং ভগিনী এক-চতুর্থাংশ পাবে এবং যদি একাধিক অবিবাহিত ভগিনী থাকে তাহলে ভাইয়েরা পৈতৃক সম্পত্তির যে অংশ পায় তার চার ভাগের এক ভাগ ভগিনীরা পাবে।

যাজ্ঞবল্ক্য মনুর বিধানের কিছু পরিবর্তন করেছেন। তার মতে পূর্বপুরুষের সম্পত্তির ক্ষেত্রে পিতা ও পুত্র উভয়েরই অংশ আছে। তাঁর এই তত্ত্ব জন্মস্বত্ববাদ নামে পরিচিত। অর্থাৎ জন্মানো মাত্রই পূর্বপুরুষের সম্পত্তির উপর অধিকার স্বাভাবিকভাবেই তৈরি হয়ে যাওয়া। পরবর্তীকালে মিতাক্ষরা যাজ্ঞবল্ক্য এর এই 'জন্মস্বত্ববাদ'কে গ্রহণ করেছিলেন। বৃহস্পতি স্মৃতিতে অবশ্য বলা হয়েছে পিতার অর্জিত সম্পত্তির ভাগ তার সম্মতি ছাড়া পুত্ররা দাবি করতে পারে না। যাজ্ঞবল্ক্য এর সম্পত্তি বিভাজন মনুর থেকে অনেকখানি সরল। তিনি বলেন যে, সম্পত্তির বিভাজন পিতার জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর পরে ঘটতে পারে। পিতা যদি জীবদ্দশায় সম্পত্তি পুত্রদের মধ্যে ভাগ করে দেন তাহলে সর্বোৎকৃষ্ট অংশটি জ্যেষ্ঠ পুত্র কে দেবেন। অবশ্য তিনি চাইলে প্রত্যেককে সমান ভাগ দিতে পারেন। পিতার মৃত্যুর পর সম্পত্তির ভাগ বাটোয়ারা যখন হবে তখন পুত্রদের পিতার দায়ও সমান ভাবে গ্রহণ করতে হবে। মাতাও সমভাগের এক ভাগ পাবেন এবং ভগিনী রা ভ্রাতাদের চার ভাগের এক ভাগ পাবেন। কোন ব্যক্তি অপুত্রক অবস্থায় মারা গেলে তার কন্যা কে যদি 'পুত্রিকা' হিসেবে বিবেচিত করে যান তাহলে তিনি পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী হবেন। অন্যথায় সেই ব্যক্তির সম্পত্তির উপর তার পিতামাতা, ভ্রাতা, ভাতুষ্পুত্র, গোত্রজ, এমনকি বন্ধু ও শিষ্যদেরও অধিকার থাকে।

শাস্ত্রকার নারদ মনুকে অনুসরণ করলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিজস্ব মত ব্যক্ত করেছেন। যেমন: পিতা যদি তার জীবনকাল সম্পত্তির বিলিব্যবস্থা করেন তাহলে তিনি নিজের জন্য দুই ভাগ অগ্রিম রেখে দিয়ে বাকিটা সমান অথবা অসমান ভাবে ভাগ করতে পারেন। তিনি আরো বলেছেন যে পিতার কোন বৈধ সন্তান পিতার প্রতি বিরূপ মনোভাবাপন্ন হলে অথবা জাতিচ্যুত হলে সে উত্তরাধিকার পাবে না। নারদ মনুর "জ্যেষ্ঠ অধিকার তত্ত্ব" নাকচ করেছেন এবং বলেছেন যে ব্যক্তি যোগ্য সে কণিষ্ঠ হলেও পরিবারের কর্তা হতে পারে। পুত্রের অবর্তমানে কন্যারা সম্পত্তির উত্তরাধিকার হবে। স্বাভাবিকভাবে প্রত্যেক ভ্রাতা তাদের ভগিনীদের নিজেদের ভাগের এক-চতুর্থাংশ করে দেবে। কিন্তু যদি ভাই একাধিক হয় এবং ভগ্নি একটি হয় তাহলে একজন ভাইয়ের ভাগের এক-চতুর্থাংশ ভগ্নিকে দিলেই হবে।

অপুত্রক বিধবা নারীর অধিকার সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে মনু এক্ষেত্রে যথেষ্ট ঔদাসীন্য দেখিয়েছেন। শঙ্খ বলেছেন যে, অপুত্রক ব্যক্তির মৃত্যুর পর তার সম্পত্তি তার ভাইদের মধ্যে বর্তাবে। যদি তারা না থাকে তবেই বিধবার উত্তরাধিকারের কথা আসবে। পক্ষান্তরে যাজ্ঞবল্ক্য অনুসরণে বৃহস্পতি ও কাত্যায়ন অপুত্রক ব্যক্তির বিধবা স্ত্রীকে প্রত্যক্ষভাবেই মৃত স্বামীর উত্তরাধিকারিণী নির্দিষ্ট করেছেন। পরবর্তী পর্যায়ে ক্রমিক উত্তরাধিকারীরা হচ্ছে কন্যাগণ, মৃত ব্যক্তির পিতা, মাতা, ভ্রাতা ও ভ্রাতুস্পুত্র।

Inheritance of Property: 300 BCE - 300 CE

The rise of a complex agrarian-based socio-economic system led to the emergence of personal property. Naturally, the question of inheritance of property arose. In contemporary religious texts, there are rules regarding the inheritance of property. The Manusmriti of the Gupta period, the Yajnavalkya Smriti, the Naradasmriti, the Brihaspati Smriti, and the Katyayana Smriti are particularly significant in this regard.

The earliest mention of specific rules regarding the inheritance and division of property is found in the Manusmriti. According to Manu, during his lifetime, a father could divide his property as he wished. After his death, his property was divided among his sons. Manu speaks of the priority of the eldest son. According to him, if other sons remain under the care of the eldest son, he is responsible for managing the father's property. If the eldest son refuses, the eldest will receive the lion's share of the property, and the remaining portion will be divided equally among all the brothers. Unmarried daughters would receive one-fourth of the share allotted to their brothers. The commentator Medhatithi explains this by stating that the brothers receive three-fourths and the sister one-fourth, and if there are multiple unmarried sisters, they will share one-fourth of the father's property, which is one-fourth of the portion received by the brothers.

Yajnavalkya made some changes to Manu's rules. He stated that both the father and the son have a share in the ancestral property. His theory, known as the birthright theory, holds that a person, by virtue of birth, automatically has a right to the ancestral property. Later, Mitakshara accepted Yajnavalkya's birthright theory. In the Brihaspati Smriti, it is stated that the sons cannot claim their father's earned property without his consent. Yajnavalkya’s method of dividing property is simpler than Manu's. He says that property can be divided either during the father's lifetime or after his death. If the father divides the property while he is alive, the eldest son should receive the best portion, although the father may choose to divide it equally among all sons. After the father's death, the sons are expected to share the father’s responsibilities equally. The mother will receive one share of the property, and the daughters will receive one-fourth of the share allotted to the brothers. If a man dies without sons and his daughter is recognized as a putrika (adopted son), she will inherit her father’s property. Otherwise, the property will be inherited by the father’s parents, brothers, nephews, clan, and even friends and disciples.

The Nārada Smriti follows Manu's rules but also expresses some differences. For instance, if the father distributes his property during his lifetime, he may reserve two parts for himself and divide the rest equally or unequally among his heirs. Nārada also states that a legitimate child who is hostile toward his father or has been excommunicated will not inherit. Nārada rejects Manu's concept of eldest son preference and says that any capable son, even the youngest, can become the head of the family. In the absence of sons, daughters will inherit the property. Normally, brothers would give one-fourth of their share to their sisters, but if there is more than one brother and only one sister, one-fourth of one brother’s share should go to her.

There are different views on the inheritance rights of a childless widow. Manu showed some indifference in this matter. Shankha said that the property of a childless person would be inherited by his brothers after his death. If the brothers are not alive, then the widow would inherit the property. On the other hand, following Yajnavalkya, Brihaspati and Katyayana explicitly designated the widow of a childless man as the legal heir to her deceased husband’s property. The subsequent line of inheritance would be the daughter, the deceased person's father, mother, brothers, and nephews.

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযানঃ প্রত্যক্ষ কারণ ও তাৎপর্য | Arab Conquest of Sindh: Immediate Causes and Significance

আরবদের সিন্ধু অভিযানঃ প্রত্যক্ষ কারণ ও তাৎপর্য সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আগেও বহুবার ভারতের বিভিন্ন জায়গায় অভিযান পাঠানো হয়েছিল। তবে এই(712 খৃ:) অভিযানের একটি প্রত্যক্ষ কারণ ছিল। জানা যায় যে সিংহলের রাজা ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ কে কয়েকটি জাহাজে করে উপঢৌকন পাঠাচ্ছিলেন কিন্তু পথে সিন্ধু দেশের জলদস্যুরা দেবল বন্দরে এ...

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগ...

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হ...