সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

তেলেঙ্গানা আন্দোলন | Telengana Movement

Samoresh Mondal,
UG Student, Sonarpur Mahavidyalaya

তেলেঙ্গানা আন্দোলন

নিজাম শাসিত দেশীয় রাজ্য হায়দ্রাবাদের তেলেঙ্গানা কৃষক অভ্যুত্থান নানা দিক দিয়ে সমকালীন গণ-আন্দোলন গুলিকে ছাপিয়ে গিয়েছিল । কৃষক গেরিলা  যুদ্ধের উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত এই তেলেঙ্গানা কৃষক বিদ্রোহ,  আন্দোলনের অন্যতম নেতা পি সুন্দরাইয়া লিখেছেন 3000 গ্রামে 30 লক্ষ মানুষ প্রায় 16 হাজার বর্গমাইল এলাকা জুড়ে তেলেঙ্গানা সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিল। 

নিজাম শাসিত হায়দ্রাবাদ ছিল সামন্ততান্ত্রিক,  স্বৈরশাসনের অধীনে । সেখানে কোন আইনের শাসন ছিল না, কোন নাগরিক অধিকারও ছিলনা ।  ভূস্বামীরা কৃষকদের কাছ থেকে বেগার আদায় করত।  নির্যাতন চালিয়ে ইচ্ছামত কর আদায় করত । কমিউনিস্ট পার্টি উক্ত বিষয়গুলিকে কেন্দ্র করে কৃষকদের সংগঠিত করে। কমিউনিস্টদের গণসংগঠনের নাম ছিল অন্ধ্র মহাসভা । তেলেঙ্গানা আন্দোলন কমিউনিস্টদের উদ্যোগে জমি ও ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে পরিণত হয়।  নিজামের গুন্ডাবাহিনী আন্দোলনকারীদের উপর অত্যাচার শুরু করলে গ্রামবাসীরা হাতে অস্ত্র তুলে নেয়, এবং পাল্টা আক্রমণের পরিকল্পনা করে। সশস্ত্র গ্রামবাসীরা  ভূস্বামী দের ক্ষেতের শস্য লুট করে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিলি করে দেয়। প্রথমে তেলেঙ্গানার জেলা স্তরে তারপর তালুক  স্তরে সশস্ত্র গেরিলা বাহিনী গড়ে ওঠে । সূর্যপেট , লাল হোন্ডা,  হুজুর নগর প্রভৃতি তালুক গুলিতে এ ধরনের সশস্ত্র বাহিনী গড়ে ওঠে।   কিছুদিনের মধ্যে তেলেঙ্গানার গ্রাম অঞ্চলে নিজামের অস্তিত্ব লোপ পায়।  বিদ্রোহীরা গ্রাম সমাজ গড়ে তোলে,  কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এই সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রামের বিষয়ে যথেষ্ট সন্দিহান ছিলেন। কমিউনিস্ট পার্টির বিখ্যাত নেতা বি. টি রনদিভে অভিযোগ করেছিলেন যে পার্টির সাধারণ সম্পাদক পি সি যোশী সশস্ত্র কৃষি বিদ্রোহের বিরুদ্ধে ছিলেন । 

তেলেঙ্গানা আন্দোলনের তীব্রতা নিজাম সরকারকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিল।  তখন নিজাম ভারতের নেহেরু সরকারের সঙ্গে একটি চুক্তি করেন। 1লা  নভেম্বর  1947 এ  সেখানে সিদ্ধান্ত হয় এক বছর পর হায়দ্রাবাদ ভারতের অন্তর্ভুক্ত হবে। এরপর বিদ্রোহীদের আক্রমণ চলতে থাকে, এবং শেষ পর্যন্ত নিজামের সরকারি বাহিনী সরকার  আশ্রিত গুন্ডা রাজ বাহিনী এবং ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী, যৌথভাবে আক্রমণ চালিয়ে তেলেঙ্গানা অভ্যুত্থান দখল করে।  1951 সালে অক্টোবর মাসে কমিউনিস্ট পার্টি  কার্যত বিদ্রোহীদের  ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেয়।  তেলেঙ্গানা আন্দোলনে প্রায় 4000 বিপ্লবীর মৃত্যু হয় দশ হাজার জনকে গ্রেপ্তার করা হয় । 

আন্দোলনের ব্যর্থতার পিছনে কমিউনিস্ট পার্টির যথেষ্ট দায় ছিল।  কমিউনিস্টরা তেলেঙ্গানা সমর্থনে কোন সংহতিসূচক ধর্মঘট করতে পারেনি।  নতুন নতুন এলাকায় সংগ্রামকে ছড়িয়ে দিতে  পারেনি। ফলে সেনাবাহিনীর কাজ সহজ হয়ে যায় । তাছাড়া শহরের দরিদ্র মানুষকে তারা আন্দোলনে যুক্ত করতে পারেনি।  তবে তেলেঙ্গানা আন্দোলন ব্যর্থ হলেও ভারতের গণসংগ্রামকে এক ধাপ এগিয়ে দিয়েছিল।  সরকার আন্দোলনের মূল বক্তব্যকে একেবারে অবহেলা করতে পারেনি । নেহেরু ও অন্ধ্র প্রাদেশিক সরকারের উদ্যোগে কৃষি সমস্যা  সামাধানের তাগিদে জায়গিরদারী উচ্ছেদ আইন,  হায়দ্রাবাদ প্রজাস্বত্ব আইন নামে  দুটি আইন প্রণয়ন করে।  কমিউনিস্ট নেতা পি সুন্দরাইয়া এই দুটি আইনকে Radical ও Progressive বলে উল্লেখ করেছেন।  যদিও  আর এক কমিউনিস্ট নেতা রাজেশ্বর রাও আইন দুটির প্রকৃত স্বরূপ তুলে ধরেছেন।  তার মতে জায়গীরদাররা খুব একটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, কারণ তারা যে পরিমাণ ক্ষতিপূরণ পেয়েছিল তা দিয়ে তারা বিশাল পরিমাণ ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিক হতে পেরেছিল। 

-----------------------
সমরেশ মন্ডল

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগ...

আরবদের সিন্ধু অভিযানঃ প্রত্যক্ষ কারণ ও তাৎপর্য | Arab Conquest of Sindh: Immediate Causes and Significance

আরবদের সিন্ধু অভিযানঃ প্রত্যক্ষ কারণ ও তাৎপর্য সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আগেও বহুবার ভারতের বিভিন্ন জায়গায় অভিযান পাঠানো হয়েছিল। তবে এই(712 খৃ:) অভিযানের একটি প্রত্যক্ষ কারণ ছিল। জানা যায় যে সিংহলের রাজা ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ কে কয়েকটি জাহাজে করে উপঢৌকন পাঠাচ্ছিলেন কিন্তু পথে সিন্ধু দেশের জলদস্যুরা দেবল বন্দরে এ...

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হ...