সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

মুঘল জমিদার ও তার প্রকারভেদ

Abdul Mojaffar Mondal
Assistant Professor, Sonarpur Mahavidyalaya

মুঘল জমিদার ও তার প্রকারভেদ 



মুঘল যুগে ভুমি ছিল প্রধান প্রাকৃতিক সম্পদ এবং কৃষিই ছিল রাষ্ট্রের আয়ের প্রধান উৎস। সাম্রাজ্যের জমি ছিল প্রধানত তিন প্রকারের—খালিসা জমি, জায়গীর জমি ও জমিদারের অধীনে জমি। ‘জমিন’ একটি ফার্সি শব্দ। এর অর্থ দেশ। ফার্সি ঐতিহাসিকদের লেখায় জমিদার বলতে কোন একটি এলাকার প্রধানকে বোঝানো হয়েছে। আকবরের সময় থেকেই মুঘল লেখালিখিতে জমিদার শব্দটির সচারাচার প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়। তখন এই শব্দটি এমন এক লোককে বোঝাত যে উত্তরাধিকার সুত্রে অধিকার পেয়েছে কৃষকের কাছ থেকে খাজনা সংগ্রহ করে কোষাগারে জমা দেবার। আবুল ফজল ‘জমিদার’ ও ‘বুমি’ শব্দ দুটি সমার্থক শব্দ হিসাবে ব্যাবহার করেছেন। ‘বুম’ কথার অর্থ জমি। দোয়াব অঞ্চলে এদেরকে খট, খোটি, মুকদ্দম ইত্যাদি পুরানো নামেই অভিহিত করা হচ্ছে। রাজস্তানে এদের ভোমি এবং গুজরাটে এদের বন্থ বলা হচ্ছে। ভিন্ন ভিন্ন নামের আড়ালে ভিন্ন ভিন্ন অধিকার বোঝাত। তবে মুঘলরা সর্বদাই চেষ্টা করত বিভিন্ন ধরনের অধিকারগুলিকে একই ছাঁচে ফেলার।

উদ্ভবঃ 


প্রাচীন কালে গুপ্ত ও গুপ্ত-পরবর্তী যুগে অগ্রাহার ব্যবস্থার ব্যাপক প্রচলনের ফলে সমাজে যে মধ্যস্বত্বভোগের ব্যবস্থার প্রচলন হয়েছিল তাকে অনেক ঐতিহাসিক সামন্ততন্ত্র হিসাবে অভিহিত না করে জমিদারী ব্যবস্থা হিসাবেই দেখতে পছন্দ করেন। তুর্কিদের আগমনের পরেও মধ্যস্বত্বভোগীদের অস্তিত্ত্বকে অস্বীকার করা যায় নি। প্রাক মুঘল যুগে খুত, মুকদ্দম, চৌধুরী প্রভৃতি মধ্যস্বত্বভোগীরা নানা স্তরে গ্রামীণ কর্তৃত্ব করত। সুতরাং মুঘল যুগে জমিদার কোন নতুন উপাদান নয়। প্রকৃতপক্ষে শোষকদের পুরাতন নাম ও অভিধাগুলি ক্রমশ অচল হয়ে পড়ে এবং এই স্থলে উদ্ভূত হয় একটি একক উপাধি ‘জমিদার’ বা ‘বুমি’।


জায়গীরদার ও জমিদারদের মধ্যে পার্থক্যঃ 


জায়গীর কথার অর্থ জমি। তবে জাগীরদার হল সরকারের অফিসার। জমিতে তার কোন মালিকানা বা অধিকার নেই। তাকে চাইলে সম্রাট বদলি করতে পারেন। কিন্তু জমিদারের জমির উপর স্থায়ী, বংশানুক্রমিক ও হস্তান্তরযোগ্য অধিকার থাকে। কোন অপরাধ না করলে বা চুক্তিভঙ্গ না করলে তার বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা নেওয়া যায় না।

ক্ষমতা ও দায়িত্বঃ


সাধারণ জমিদার নিজে চাষাবাদের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না, কিন্তু উৎপন্ন ফসলের একাংশের উপর তার দাবী ছিল।একে নানকর বলা হয়। এই দাবী বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন। ইরফান হাবিবের মতে এটি উৎপন্ন ফসলের ১/১০ অংশ। গুজরাটে এটি ছিল ১/৪ অংশ। জমিদারদের অধিকৃত নিস্কর জমি বনঠ নামে পরিচিত ছিল। এছাড়াও তারা অন্যান্য বহু উপকর ও দস্তুরী আদায় করতেন। জমিদারীস্বত্বের উপর তাদের বংশানুক্রমিক ও হস্তান্তরযোগ্য অধিকার ছিল। মুঘলদের রাজস্ব সংক্রান্ত দলিলপত্রে জমিদার শব্দের সঙ্গে মালেক শব্দের উল্লেখ লক্ষ্য করা যায়। ‘মালেক’ কথার অর্থ সম্পত্তির অধিকারী। ইরফান হাবিবের মতে জমির উপর জমিদারদের ‘মিল্কিয়াত’ বা ব্যক্তিমালিকানা ছিল না, ছিল জমির উৎপাদনের উপর। জমিদারের নিজ এলাকায় শান্তিরক্ষা করার ও চাষাবাদ দেখাশোনা করার দায়িত্ব নিতে হত। তাই তাদের সামরিক বাহিনী গড়ার অধিকার ছিল। আইন-ই-আকবরীতে এবিষয়ে বিবরণ আছে। জমিদার বিদ্রোহী হলে বা চুক্তিভঙ্গ করলে সম্রাট তাকে উৎখাত করতে পারতেন।

শ্রেনিবিভাজনঃ


আবুল ফজল আকবরের সময়কার জমিদারদের দুই ভাগে ভাগ করেছেন। একটি হচ্ছে এলাকাভিত্তিক জমিদার যেখানে বিভিন্ন জাতের বাস; যেমন জম্মুর জমিদার বা রাজা। অন্যটি হচ্ছে উপজাতির নায়ক; যেমন বালুচ জমিদার। কিন্তু জাতিগত হিসাবে জমিদার হলেও এর সুনির্দিষ্ট এলাকা আছে। আবুল ফজল এদের উলুস বা আলুস বলেছেন।

অধ্যাপক নুরুল হাসান মুঘল যুগে তিন ধরনের জমিদারের কথা বলেছেন। প্রথমে ছিল সবথেকে উচ্চ শ্রেনীর জমিদারণ-ই-উমদা। এরা বড় জমিদার বা সামন্ত রাজা। এরা স্থানীয়ভাবে স্বাধীন ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। এই শ্রেণীটিকে মনসবদারী ব্যবস্থার অধীনে নিয়ে এসে মুঘল রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা প্রথম থেকেই ছিল। এদের জমিদারী ওয়াতন জাগীরের মর্যাদা পেত। এই জমিদাররা আলাদা করে তনখা জাগির পেতেন। মানসিংহ এরকমই এক জমিদার-মনসবদার। এই সমস্ত রাজাদের অধিকাংশ ছিলেন পেশকাসি জমিদার। এরা কেবল সামরিক সাহায্য দিতেন এবং আনুগত্যের নিদর্শনস্বরূপ উপঢৌকন পাঠাতেন; যেমন জম্মু ও কাংড়ার রাজা। এদের ক্ষেত্রে জমি জরিপ করে রাজস্ব নির্ধারণ করা হত না। তবে কিসের ভিত্তিতে পেশকাস পাঠানো হত তা তার বিশদ বিবরণ পাওয়া যায় না। খুব সম্ভবত ‘জমা’র ভিত্তিতে নির্ধারিত হত। মুঘল প্রশাসন এদের জমিদারী অঞ্চলের খোঁজখবর রাখতেন এবং সর্বদাই চেষ্টা করতেন মালগুজারি জমিদারীতে পরিণত করার।

মধ্যবর্তী জমিদাররাই ছিল মুঘল প্রশাসনের স্তম্ভ। এরা একদিকে ছোট জমিদারে কাছ থেকে খাজনা আদায় করে কোষাগারে জমা দিত অন্যদিকে এরা গ্রামাঞ্চলে শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখত। এই কাজ করত বলে এদের মুঘল দলিলে খিদমৎগুজারী বলা হয়েছে। মুখিয়া, মুকদ্দম,খট,চৌধুরী—এরা সকলে এই স্তরের মধ্যে পড়ে। উপরে বর্ণিত নানকর, এবং ‘রসুমত-ই-মুকদ্দমী’নামে একপ্রকার করছাড় পেত।
জমিদারদের একেবারে নিচের স্তরে ছিল মালগুজারি জমিদার। নুরুল হাসান এদের মূখ্য জমিদার বলে উল্লেখ করেছেন। এরা একদিকে নিজের অথবা অন্যের সাহায্যে চাষবাস করতেন, আবার অন্যদিকে গ্রামের ওপর মালিকানার অধিকারও তাদের ছিল। এদের মাধ্যমেই প্রায়ক্ষেত্রে কৃষকদের কাছ থেকে ভূমিরাজস্ব আদায় করা হত। পরিবর্তে পারিশ্রমিক হিসাবে পেত নানকর ও বনঠ।

কথান্তঃ 


মুঘল রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে জমিদার শ্রেণী ছিল একদিক থেকে যেমন সমস্যাস্বরূপ অন্যদিকে আবার এই স্থানীয় প্রভাবশালী অভিজাত শ্রেনির লোকেদের সহযোগীতা ও আনুগত্যের উপর সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব নির্ভর করত। স্থানীয় কৃষকদের সাথে জাতি ও গোষ্ঠীগত যোগাযোগ এবং সশস্ত্র সৈন্যবাহিনীর জোরে স্থানীয় হলেও ব্যাপক ক্ষমতার অধিকারী ছিল, যা সবসময় কেন্দ্রীয় শাসন সুদৃঢ় হওয়ার পথে অন্তরায় ছিল। তাই কেন্দ্রের সাথে যতদিন সমঝোতা থাকত ততদিন এরা রাষ্ট্রের পক্ষে ছিল। ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর ক্রমশ সেই সমঝোতা নষ্ট হয় এবং বিদ্রোহের পথ উন্মুক্ত হয়।

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য Please visit our Homepage and subscribe us. Suggested Topics || Ghajnavid Invasion || গজনী আক্রমণ || || মামুদের সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন || Somnath Temple Plunder || || তরাইনের যুদ্ধ ও তার গুরুত্ত্ব || মহম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমন ও তার চরিত্র || সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আ...

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগ...

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হ...