Abdul Mojaffar Mondal
Assistant Professor, Sonarpur Mahavidyalaya
মুঘল জমিদার ও তার প্রকারভেদ
উদ্ভবঃ
প্রাচীন কালে গুপ্ত ও গুপ্ত-পরবর্তী যুগে অগ্রাহার ব্যবস্থার ব্যাপক প্রচলনের ফলে সমাজে যে মধ্যস্বত্বভোগের ব্যবস্থার প্রচলন হয়েছিল তাকে অনেক ঐতিহাসিক সামন্ততন্ত্র হিসাবে অভিহিত না করে জমিদারী ব্যবস্থা হিসাবেই দেখতে পছন্দ করেন। তুর্কিদের আগমনের পরেও মধ্যস্বত্বভোগীদের অস্তিত্ত্বকে অস্বীকার করা যায় নি। প্রাক মুঘল যুগে খুত, মুকদ্দম, চৌধুরী প্রভৃতি মধ্যস্বত্বভোগীরা নানা স্তরে গ্রামীণ কর্তৃত্ব করত। সুতরাং মুঘল যুগে জমিদার কোন নতুন উপাদান নয়। প্রকৃতপক্ষে শোষকদের পুরাতন নাম ও অভিধাগুলি ক্রমশ অচল হয়ে পড়ে এবং এই স্থলে উদ্ভূত হয় একটি একক উপাধি ‘জমিদার’ বা ‘বুমি’।
জায়গীরদার ও জমিদারদের মধ্যে পার্থক্যঃ
জায়গীর কথার অর্থ জমি। তবে জাগীরদার হল সরকারের অফিসার। জমিতে তার কোন মালিকানা বা অধিকার নেই। তাকে চাইলে সম্রাট বদলি করতে পারেন। কিন্তু জমিদারের জমির উপর স্থায়ী, বংশানুক্রমিক ও হস্তান্তরযোগ্য অধিকার থাকে। কোন অপরাধ না করলে বা চুক্তিভঙ্গ না করলে তার বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা নেওয়া যায় না।
ক্ষমতা ও দায়িত্বঃ
সাধারণ জমিদার নিজে চাষাবাদের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না, কিন্তু উৎপন্ন ফসলের একাংশের উপর তার দাবী ছিল।একে নানকর বলা হয়। এই দাবী বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন। ইরফান হাবিবের মতে এটি উৎপন্ন ফসলের ১/১০ অংশ। গুজরাটে এটি ছিল ১/৪ অংশ। জমিদারদের অধিকৃত নিস্কর জমি বনঠ নামে পরিচিত ছিল। এছাড়াও তারা অন্যান্য বহু উপকর ও দস্তুরী আদায় করতেন। জমিদারীস্বত্বের উপর তাদের বংশানুক্রমিক ও হস্তান্তরযোগ্য অধিকার ছিল। মুঘলদের রাজস্ব সংক্রান্ত দলিলপত্রে জমিদার শব্দের সঙ্গে মালেক শব্দের উল্লেখ লক্ষ্য করা যায়। ‘মালেক’ কথার অর্থ সম্পত্তির অধিকারী। ইরফান হাবিবের মতে জমির উপর জমিদারদের ‘মিল্কিয়াত’ বা ব্যক্তিমালিকানা ছিল না, ছিল জমির উৎপাদনের উপর। জমিদারের নিজ এলাকায় শান্তিরক্ষা করার ও চাষাবাদ দেখাশোনা করার দায়িত্ব নিতে হত। তাই তাদের সামরিক বাহিনী গড়ার অধিকার ছিল। আইন-ই-আকবরীতে এবিষয়ে বিবরণ আছে। জমিদার বিদ্রোহী হলে বা চুক্তিভঙ্গ করলে সম্রাট তাকে উৎখাত করতে পারতেন।
শ্রেনিবিভাজনঃ
আবুল ফজল আকবরের সময়কার জমিদারদের দুই ভাগে ভাগ করেছেন। একটি হচ্ছে এলাকাভিত্তিক জমিদার যেখানে বিভিন্ন জাতের বাস; যেমন জম্মুর জমিদার বা রাজা। অন্যটি হচ্ছে উপজাতির নায়ক; যেমন বালুচ জমিদার। কিন্তু জাতিগত হিসাবে জমিদার হলেও এর সুনির্দিষ্ট এলাকা আছে। আবুল ফজল এদের উলুস বা আলুস বলেছেন।
অধ্যাপক নুরুল হাসান মুঘল যুগে তিন ধরনের জমিদারের কথা বলেছেন। প্রথমে ছিল সবথেকে উচ্চ শ্রেনীর জমিদারণ-ই-উমদা। এরা বড় জমিদার বা সামন্ত রাজা। এরা স্থানীয়ভাবে স্বাধীন ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। এই শ্রেণীটিকে মনসবদারী ব্যবস্থার অধীনে নিয়ে এসে মুঘল রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা প্রথম থেকেই ছিল। এদের জমিদারী ওয়াতন জাগীরের মর্যাদা পেত। এই জমিদাররা আলাদা করে তনখা জাগির পেতেন। মানসিংহ এরকমই এক জমিদার-মনসবদার। এই সমস্ত রাজাদের অধিকাংশ ছিলেন পেশকাসি জমিদার। এরা কেবল সামরিক সাহায্য দিতেন এবং আনুগত্যের নিদর্শনস্বরূপ উপঢৌকন পাঠাতেন; যেমন জম্মু ও কাংড়ার রাজা। এদের ক্ষেত্রে জমি জরিপ করে রাজস্ব নির্ধারণ করা হত না। তবে কিসের ভিত্তিতে পেশকাস পাঠানো হত তা তার বিশদ বিবরণ পাওয়া যায় না। খুব সম্ভবত ‘জমা’র ভিত্তিতে নির্ধারিত হত। মুঘল প্রশাসন এদের জমিদারী অঞ্চলের খোঁজখবর রাখতেন এবং সর্বদাই চেষ্টা করতেন মালগুজারি জমিদারীতে পরিণত করার।
মধ্যবর্তী জমিদাররাই ছিল মুঘল প্রশাসনের স্তম্ভ। এরা একদিকে ছোট জমিদারে কাছ থেকে খাজনা আদায় করে কোষাগারে জমা দিত অন্যদিকে এরা গ্রামাঞ্চলে শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখত। এই কাজ করত বলে এদের মুঘল দলিলে খিদমৎগুজারী বলা হয়েছে। মুখিয়া, মুকদ্দম,খট,চৌধুরী—এরা সকলে এই স্তরের মধ্যে পড়ে। উপরে বর্ণিত নানকর, এবং ‘রসুমত-ই-মুকদ্দমী’নামে একপ্রকার করছাড় পেত।
জমিদারদের একেবারে নিচের স্তরে ছিল মালগুজারি জমিদার। নুরুল হাসান এদের মূখ্য জমিদার বলে উল্লেখ করেছেন। এরা একদিকে নিজের অথবা অন্যের সাহায্যে চাষবাস করতেন, আবার অন্যদিকে গ্রামের ওপর মালিকানার অধিকারও তাদের ছিল। এদের মাধ্যমেই প্রায়ক্ষেত্রে কৃষকদের কাছ থেকে ভূমিরাজস্ব আদায় করা হত। পরিবর্তে পারিশ্রমিক হিসাবে পেত নানকর ও বনঠ।
জমিদারদের একেবারে নিচের স্তরে ছিল মালগুজারি জমিদার। নুরুল হাসান এদের মূখ্য জমিদার বলে উল্লেখ করেছেন। এরা একদিকে নিজের অথবা অন্যের সাহায্যে চাষবাস করতেন, আবার অন্যদিকে গ্রামের ওপর মালিকানার অধিকারও তাদের ছিল। এদের মাধ্যমেই প্রায়ক্ষেত্রে কৃষকদের কাছ থেকে ভূমিরাজস্ব আদায় করা হত। পরিবর্তে পারিশ্রমিক হিসাবে পেত নানকর ও বনঠ।
কথান্তঃ
মুঘল রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে জমিদার শ্রেণী ছিল একদিক থেকে যেমন সমস্যাস্বরূপ অন্যদিকে আবার এই স্থানীয় প্রভাবশালী অভিজাত শ্রেনির লোকেদের সহযোগীতা ও আনুগত্যের উপর সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব নির্ভর করত। স্থানীয় কৃষকদের সাথে জাতি ও গোষ্ঠীগত যোগাযোগ এবং সশস্ত্র সৈন্যবাহিনীর জোরে স্থানীয় হলেও ব্যাপক ক্ষমতার অধিকারী ছিল, যা সবসময় কেন্দ্রীয় শাসন সুদৃঢ় হওয়ার পথে অন্তরায় ছিল। তাই কেন্দ্রের সাথে যতদিন সমঝোতা থাকত ততদিন এরা রাষ্ট্রের পক্ষে ছিল। ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর ক্রমশ সেই সমঝোতা নষ্ট হয় এবং বিদ্রোহের পথ উন্মুক্ত হয়।
Thank you🙏 sir.
উত্তরমুছুন