সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

মহাবিদ্রোহের কারণ

Friends, if you like this post please comment and share it.

মহাবিদ্রোহের কারণ

১৮৫৭ সালে উত্তর ও মধ্য ভারতের বেশ কিছু অঞ্চলে সশস্ত্র বিদ্রোহ দেখা দেয়। এর ফলে সেসব অঞ্চলে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে বসন্তকাল পর্যন্ত ব্রিটিশ শাসন ভেঙে পড়ে। সাম্রাজ্যের সেনাবাহিনীর সাহায্যে যদিও আবার শৃঙ্খলা আবার ফিরিয়ে আনা হয়। এবং কোম্পানি ও বিদ্রোহী উভয় তরফ থেকে ব্যাপক হিংসার আশ্রয় নেওয়া হয়। যেহেতু বেঙ্গল আর্মির সেনারাই এই বিদ্রোহ শুরু করে তাই অনেক দিন ধরেই একে সিপাহিদের বিদ্রোহ বলা হত। কিন্তু বিদ্রোহে উত্তর ভারতের দুর্দশাগ্রস্ত কৃষকদের যোগদান প্রচলিত ধারণাকে বদলে দিয়েছে। তাই এই বিদ্রোহের কারণ শুধু সিপাহী অসন্তোষের মধ্যে নয়, বহুদিন ধরে ঘটমান  আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন প্রক্রিয়ার মধ্যে খুঁজতে হবে।
মহাবিদ্রোহের কারণ হিসেবে সেনা অসন্তোষ এর বিষয়টি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ১৮২০ দশক থেকে সার্বজনীন সামরিক সংস্কৃতি চালু করার উদ্দেশ্যে সেনা প্রশাসনের ওপর অধিকতর নিয়ন্ত্রণ চাপানো হয়। ফলে সেনাবাহিনীর ভারতীয় সৈন্যরা পূর্বে যেসব জাতিগত সুযোগ সুবিধা পেত তা থেকে বঞ্চিত হয়। এর ফলে প্রতিরোধও শুরু হয়ে যায়। ১৮৫৭ জানুয়ারিতে প্রথম বিদ্রোহের সংকেত পাওয়া যায়। দমদমে বিদ্রোহীদের মধ্যে গুজব ছড়িয়ে যায় যে পুরনো ব্রাউন বেস গাদা বন্দুকের পরিবর্তে নতুন অস্ত্র এনফিল্ড রাইফেলের টোটাগুলি গরু ও শুকরের চর্বি দিয়ে তৈরি, টোটা দাঁত দিয়ে কেটে বন্ধুকে ভরতে হয়। সিপাহীরা নিশ্চিত হয় যে এটা তাদের ধর্মনাশ করার চক্রান্ত। তাই হিন্দু ও মুসলিম উভয় এই টোটা ব্যবহারে অসম্মত হয়। যদিও এই টোটার উৎপাদন বন্ধ করে দেওয়া হয়, কিন্তু সিপাহিদের ভাঙ্গা বিশ্বাস আর জোড়া যায়নি।

ভারতীয় সিপাহিদের বেশিরভাগ সেনা বেঙ্গল আর্মির। বহুদিন ধরে তাদের অনেক অভিযোগ ছিল। তারা বেতন, পদোন্নতি ও অবসরকালীন সুযোগ সুবিধার ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হতো। তাছাড়া ১৮৫৬ এর চাকুরি আইনে তাদের ভারতের বাইরে যুদ্ধে যেতে বাধ্য করা হয়, যা ছিল তাদের সংস্কার বিরোধী। ধর্ম নাশের ভয় সিপাহিদের সঙ্ঘবদ্ধ করেছিল। তারা মনে করত ব্রিটিশরা তাদের জোর করে খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত করবে, সেনা ক্যাম্পে খৃষ্ট ধর্মপ্রচারকদের উপস্থিতি, ময়দায় গরু ও শুকরের হাড়ের গুঁড়ো মেশান বিষয়ক গুজব, এনফিল্ড রাইফেল সংক্রান্ত গুজব-- এসব একটি ষড়যন্ত্র তত্ত্ব খাড়া করে।

১৮৫৬ তে ব্রিটিশ কর্তৃক অযোধ্যা অধিকার বেঙ্গল আর্মি সেনাদের উপর বিরুপ প্রভাব ফেলেছিল। বেঙ্গল আর্মির ৭৫০০০সেনা ছিল অযোধ্যা থেকে। অযোধ্যার অন্তর্ভুক্তি ব্রিটিশদের  অবিশ্বাসযোগ্যতার চূড়ান্ত প্রমাণ হিসেবে তারা ভেবেছিল। তাছাড়া নতুন রাজস্ব ব্যবস্থা চালু হওয়ায় অযোধ্যার কৃষকদের চূড়ান্ত দুরবস্থা এইসব অযোধ্যার''উর্দিপরা কৃষকদের'' মধ্যে ব্রিটিশবিরোধী ক্ষোভ সঞ্চারিত করেছিল , সিপাহীদের তরফ থেকে প্রায় ১৪০০০ আবেদন এসেছিল, এ বিষয়ে ব্রিটিশদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য।

সিপাহীদের বিদ্রোহের সঙ্গে যে বেসামরিক বিদ্রোহ ঘটেছিল তার মধ্যে পড়ে স্থানীয় সামন্ত প্রভু ও জমিদারদের বিদ্রোহ এবং কৃষক সম্প্রদায় বিদ্রোহ। ডালহৌসির স্বত্ববিলোপ নীতির শিকার হয়েছিল সাতারা, নাগপুর, সম্বলপুর, উদয়পুর, ঝাঁসি প্রভৃতি রাজ্য। এইসব রাজ্যের কোন উত্তরাধিকারী না থাকায় রাজ্যগুলির অপুত্রক রাজারা কোন দত্তক নেওয়ার অনুমতি পায়নি। ওগুলি কোম্পানির সাম্রাজ্যভুক্ত হয়, রাজ্যচ্যুত রাজারা, তাদের পরিবার এবং ওদের সাথে সম্পর্কযুক্ত অভিজাতরা ক্ষতিগ্রস্থ হয়। সিংহাসনচ্যুত রাজারা নিজ নিজ এলাকায় বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন। যেমন-ঝাসি তে নেতৃত্ব দেন লক্ষ্মীবাঈ।


গ্রামীণ সমাজে বড় জমিদার বা তালুকদারের নেতৃত্বে কৃষক সম্প্রদায় একজোট হয়ে বিদ্রোহ চালিয়ে যায়। নতুন ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থায় তালুকদারা সম্পত্তি হারায়। কৃষক সমাজের জনপ্রিয়তা অর্জন এবং রাষ্ট্র ও কৃষকদের মধ্যে মধ্যস্থতা দূর করতে অযোধ্যা ও উত্তর-পশ্চিম প্রদেশে তালুকদার দের অধিকারগুলি কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। তাদের নিরস্ত্র করা হয়েছিল, দুর্গ গুলি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। ফলে এইসব তালুকদারা সাধারণ কৃষকের সমান হয়ে পড়েছিল। আবার কৃষকরাও এই ব্যবস্থায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ছিল। কারণ রাজস্বের পরিমাণ ছিল আরো বেশি।

বিদ্রোহের শুরুতেই তালুকদাররা তাদের হাতছাড়া গ্রামগুলিতে ঢুকে পড়ে। প্রজারাও তাদের সমর্থন করে। টামাস মেটকাফ দেখিয়েছেন, আত্মীয় ও সামন্ততান্ত্রিক বন্ধনে আবদ্ধ গ্রামবাসীরা তাদের দাবি খুশি মনে মেনে নিয়েছিল এবং তাদের সাথে সাধারন শত্রু দের বিরুদ্ধে একে অপরের হাত মিলিয়েছিল।

এরিক স্টোকস অবশ্য দেখিয়েছেন, সব কৃষকরা ও সব তালুকদারা নতুন ব্যবস্থায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। যেসব তালুকদার নতুন ব্যাবস্থায় খাপ খাওয়াতে পেরেছিল তারা নিজেদের এলাকাকে শান্ত রেখে ছিল। আবার যেসব কৃষক জলসেচের সুবিধাযুক্ত জমি পেয়েছিল তারা উচ্চহারে রাজস্ব দিতে সক্ষম ছিল। যারা অনুন্নত জমি পেয়েছিল তারাই অসন্তুষ্ট ছিল। এরিক স্টোকস আবার মহাজনী ঋণের সঙ্গে বিদ্রোহের সম্পর্ক ছিল কি না সে বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। কারণ উচ্চ রাজস্বের বোঝা যুক্ত শুষ্ক জমিতে মহাজনদেরআকর্ষণ ছিল কিনা তা বলা কঠিন। আবার সেচব্যবস্থার সুবিধাযুক্ত জমিতে মহাজনের কাছে জমি হারাবার সম্ভাবনা কমই ছিল। যাইহোক শুষ্ক এলাকাগুলিতে বিদ্রোহের প্রকোপ বেশি।

ব্রিটিশ সরকারের অনুসৃত বাণিজ্যনীতি দেশীয় ব্যবসায়ী ও শিল্পী-কারিগরদের ধ্বংস করেছিল। দেশীয় শিল্প পণ্যের রপ্তানি কমিয়ে এবং বৃটেনের শিল্পজাত পণ্যের আমদানি বাড়িয়ে ভারতকে ব্রিটিশ পণ্যে ছেয়ে ফেলা হয়েছিল। তাছাড়া ভারত থেকে রপ্তানি শিল্প পণ্যের উপর ব্রিটেন সরকার চড়া হারে আমদানি শুল্ক বসিয়েছিল। আর ভারতে ব্রিটেন থেকে আসা পণ্যের জন্য আমদানি শুল্ক প্রচুর ছাড় দেওয়া হয়েছিল। ফলে অসম প্রতিযোগিতায় ভারতীয় বণিক ও কারিগর হেরে যায়। এই কর্মচুতরা ১৮৫৭ বিদ্রোহে অংশ নেয়।

ভারতীয়রা ব্রিটিশদের সামাজিক কার্যকলাপ কে সন্দেহের চোখে দেখত। খ্রিস্টান মিশনারী কার্যকলাপ এবং সামাজিক সংস্কারমূলক আইন গুলিকে ভারতীয়রা মনে করত তাদেরকে জাতিচ্যুত করার পরিকল্পনা। তাছাড়া ভারতীয়দের ইংরেজরা অবজ্ঞার চোখেই দেখতো।


সুতরাং অর্থনৈতিক শোষণ ও রাজনৈতিক বিদ্রোহের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছিল‌।এই অগ্নিময় মুহূর্তে এনফিল্ড রাইফেলের প্রবর্তন বিদ্রোহের সূত্রপাত ঘটায়। ভারতীয় সেনারা প্রথমে শুরু করে এবং তারপর সমাজের সর্বস্তরের মানুষ যোগদান করে।
-------------*---*----*------*-----*-
Thanks for reading

Sourav Gayen,

PG Student, CU.

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য Please visit our Homepage and subscribe us. Suggested Topics || Ghajnavid Invasion || গজনী আক্রমণ || || মামুদের সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন || Somnath Temple Plunder || || তরাইনের যুদ্ধ ও তার গুরুত্ত্ব || মহম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমন ও তার চরিত্র || সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আ...

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগ...

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হ...