ক্লুনির সংস্কার আন্দোলন
খ্রিষ্টীয় দশম শতক খ্রিস্টধর্মের ইতিহাসের এক গভীর তাৎপর্যপূর্ণ মুহূর্ত হিসেবে চিহ্নিত। বিশুদ্ধ ও সংযত জীবনের আদর্শ বেনেডিক্ট সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছিল তা ক্রমেই ম্লান হয়ে আসছিল। এই পরিস্থিতিতে নতুন কোনো আদর্শের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল খ্রিস্টান সমাজে। আশ্রমিক দের জীবনেও শুদ্ধিকরণের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। আর এই শুদ্ধিকরণের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিল বর্গান্ডির ক্লুনির মঠ।
সেন্ট পিটারের স্মৃতির উদ্দেশ্যে উৎসর্গকৃত ক্লুনির প্রভাব ছিল দূরবিস্তৃত। ক্লুনি অ্যাবির সৃষ্টি হয়েছিল ৯১০ খ্রিস্টাব্দে অ্যাঁকুতার ডিউক উইলিয়ামের বদান্যতায়। বেনেডিক্ট এর আদর্শে বিশ্বাসী সেন্ড বার্ণো এই মঠের প্রথম অ্যাবট ছিলেন।
প্রতিষ্ঠার সময় থেকে মঠটিকে সমস্ত রকমের লৌকিক নিয়ন্ত্রণ মুক্ত হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। দেশের শাসকদের ক্লুনির জীবনে প্রভাব-প্রতিপত্তি বিস্তারের সামান্যতম সুযোগও ছিল না। ক্লুনি বিকশিত হয়েছিল আপন সাবলীল ছন্দে। ক্লুনির এই অসামান্য খ্যাতির মূলে ছিল তার কয়েকজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় অ্যাবটের ভূমিকা, যাদের মধ্যে অন্যতম অডো,মায়োলাস,ওডিলো প্রমুখ।
প্রারম্ভিক পর্বে মঠ বাসীরা হয়তো বেনেডিক্ট সম্প্রদায়ের আদি অকৃত্তিম বৈশিষ্ট্যগুলির পুনরুজ্জীবনে ব্রতী হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তারা এর থেকে কিছুটা সরে গিয়েছিল, বেনেডিক্ট আদর্শ অনুযায়ী মঠের খেত খামার গুলিতে আশ্রমিকদের দৈহিক শ্রম দানের অবশ্যপালনীয় কর্তব্য ছিল, ক্লুনির আবাসিকদের জীবনে তার পুনরাবির্ভাব ঘটেনি। আশ্রমিকদের জীবনের প্রধান কাজই ছিল প্রার্থনা ঈশ্বরের আরাধনায় সময় কাটানো। মঠ বাসীরা প্রত্যহ 6 থেকে 7 ঘণ্টা প্রার্থনায় মুখরিত থাকতেন। খ্যাতি ও প্রতিপত্তির শীর্ষদেশে পৌঁছেও ইনভেস্টিচার সংক্রান্ত দ্বন্দ্বে অংশগ্রহণ ছিল ক্লুনির প্রতিটি আশ্রমিকের আদর্শ বিরোধী। কিন্তু লৌকিক জগতের প্রতি বিমুখ হলেও ক্লুনির প্রাতিষ্ঠানিক বিশালত্ব এমনই ছিল যে, সমসাময়িক জগৎ বারবার তার শরণাগত হয়েছে, প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত না হলেও সমাজের বহু স্তরে তার প্রভাব পড়েছে। দ্বাদশ শতাব্দীর ক্লুনি 460 জন আশ্রমিক নিয়ে মধ্যযুগের বৃহত্তম মঠে পরিণত হয়েছিল। আর পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সংশয়াকুল, সমস্যা পীড়িত বহু মানুষ লোকবিশ্রুত এই আশ্রম এ এসে উপস্থিত হতেন শান্তির সন্ধানে। তাই একাদশ ও দ্বাদশ শতকে খ্রিস্টান সমাজে ক্লুনির প্রগাঢ় ও গভীর প্রভাব সম্পর্কে কোন অবকাশ নেই। তার স্পর্শে পশ্চিম ইউরোপের অসংখ্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান আলোকিত হয়ে উঠেছিল এবং পোপের প্রচন্ড অস্তিত্ব সত্ত্বেও খ্রিস্টান জগতের আধ্যাত্মিক জীবনের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল বার্গাণ্ডির এই আশ্রম।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন