সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

সুলতান মামুদের ভারত আক্রমণের চরিত্র

Abdul Mojaffar Mondal
Assistant Professor, Sonarpur Mahavidyalaya

সুলতান মামুদের ভারত আক্রমণের চরিত্র

রবদের সিন্ধু বিজয়ের পর দীর্ঘ 300 বছর ধরে ভারতে কোন মুসলমান আক্রমণ লক্ষ্য করা যায়নি। ভারতে মুসলমান রাজত্ব স্থাপনের কৃতিত্ব মূলত তুর্কিদের এবং এই কাজের সূচনা করেছিলেন গজনীর সুলতানরা। আব্বাসীয় খলিফা তন্ত্রের পতনের পর বিভিন্ন জায়গায় যে আঞ্চলিক শক্তির আবির্ভাব ঘটেছিল তার মধ্যে অন্যতম হল আলপ্তিগীনের নেতৃত্বে  আফগানিস্তানে গজনী রাজ্যের প্রতিষ্ঠা। সবুক্তগীন 977 খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে বসে ভারতের দিকে অভিযান শুরু করেন এবং পাঞ্জাবের শাসক জয়পাল তার হাতে পরাজিত হয়। 997 খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যুর পর, তাঁর পুত্র মামুদ সিংহাসনে বসেন এবং 1000 থেকে 1026 খ্রিস্টাব্দে পর্যন্ত (কেমব্রিজ ঐতিহাসিকদের মতে) মোট 17 বার ভারত আক্রমন করেন।

 মামুদের ভারত আক্রমণের চরিত্র বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিভিন্ন রকম মত পোষণ করেছেন। ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথ বলেছেন, মামুদ ছিলেন একজন ধর্মান্ধ তুর্কি সৈনিক। ধর্মের অনুশাসন কঠোরভাবে পালন করতে গিয়ে  বিধর্মীর রাজ্যগুলিতে একের পর এক আক্রমণ ও লুণ্ঠন করেন এবং বিধর্মীর ধর্মস্থান গুলিকে অপবিত্র করেন। বস্তুত এই ধর্মনৈতিক ব্যাখ্যা মামুদের দরবারী ইতিহাসিক উৎবির রচনা দ্বারা প্রভাবিত। আধুনিক এদেশীয় ঐতিহাসিকদের অনেকেই, যেমন ড: ঈশ্বরী প্রসাদ, এ এল শ্রীবাস্তব প্রমূখ মামুদকে ধর্মান্ধ আক্রমণকারী হিসেবেই দেখেছেন।

আলিগড় ঐতিহাসিক মহম্মদ হাবিব উপরিউক্ত ধারনাকে খন্ডন করেছেন। তাঁর মতে, মামুদ এদেশে ধর্মপ্রচারের কোন চেষ্টাই করেননি। কোনো পরাজিত রাজাকে বলপূর্বক ধর্মান্তরিত করেননি। কেবল ধনরত্ন লুণ্ঠন করেই সন্তুষ্ট হয়েছেন। তাছাড়া তার পথে বাধাদানকারী কেউ মুসলমান হলে তাকে ছেড়ে কথা বলেননি। তিনি একাধিক মন্দির লুন্ঠন করেছেন। কিন্তু সেই লুন্ঠনের পশ্চাতে ধর্মের যোগ ছিল না। কারণ, শুধু কোরআন কেন, পৃথিবীর কোন ধর্মগ্রন্থই অন্যের ধর্মস্থানকে লুণ্ঠন করা ব অপবিত্র করাকে মেনে নেয় না।

মামুদ ভারতীয়দের চোখে একজন লুণ্ঠনকারী। কিন্তু অন্য দিক থেকে তিনি পারসিক নবজাগরণের অন্যতম পথিকৃত  । কারণ তিনি গজনী তে একটি বিশ্ববিদ্যালয়, একটি বিদ্যালয় একটি যাদুঘর স্থাপন করেন। তিনি গজনীকে একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে পরিণত করেন। যদিও তাঁর এইসব কৃতিত্ব সত্ত্বেও তার কুকীর্তিগুলো অবশ্যই নিন্দনীয়।

গজনী আক্রমণের আরেকটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হল, সামরিক ক্ষেত্রে সাংঘাতিক সাফল্য সত্ত্বেও স্থায়ী রাজ্য স্থাপনে চূড়ান্ত অনীহা। মামুদ কোনো ভারতীয় রাজার কাছে পরাজিত হন নি। কিন্তু একমাত্র পাঞ্জাব ছাড়া ভারতের কোন এলাকায় নিজের শাসন প্রতিষ্ঠা করেননি। সুতরাং মাহমুদকে একজন সমর কুশলী লুটেরা ছাড়া কিছুই বলা যায় না।


          

                            সুলতান মামুদের ভারত আক্রমণের ঘটনাক্রম             



      ৬২  খ্রিষ্টাব্দে আলপ্তগীন (আফগানিস্তানে) গজনী রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।


·         ৯৭৭  খ্রিষ্টাব্দে সবুক্তিগীন গজনী রাজ্যের চতুর্থ শাসক হিসাবে সিংহাসনে বসেন।

·         ৯৮৭  খ্রিষ্টাব্দে ভারতের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের শাহী রাজ্যের রাজা জয়পালকে পরাজিত করে সবুক্তিগীন প্রচুর সম্পদ হস্তগত করেন।

·         ৯৯৭  খ্রিঃ সবুক্তিগীনের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র মামুদ ২৭ বছর বয়সে সিংহাসনে বসেন।

·         ১০০০ খ্রিঃ মামুদ ভারতের সীমান্তবর্তী কয়েকটি দুর্গ দখল করেন।

·         ১০০১ খ্রিঃ মামুদ জয়পালকে পরাজিত করেন। মুক্তিপণ হিসাবে ২,৫০,০০০ দীনার, ৫০ টি হাতি এবং রাজ্যের কিয়ংশ আদায় করেন।

·         ১০০৪ খ্রিঃ বালুচিস্তান এর মধ্য দিয়ে সিন্ধু নদ অতিক্রম করে ভাতিয়ার শাসক বাজী রায়কে পরাজিত করেন।

·         ১০০৫-৬ খ্রিঃ মুলতানের শাসক আবুল ফতে দাউদ এর বিরুদ্ধে অভিযানের সময় আনন্দপাল তার রাজ্যের ভিতর দিয়ে সেনা নিয়ে যেতে বাধা দেয়। আনন্দপালকে পারাজিত করে তার পুত্র সুখপালের (নওশা শাহ) হাতে শাসন ভার দেন।  তিনি ফতে দাউদকেও পরাজিত করেন। বার্ষিক ২০,০০০ স্বর্ণ দিরহাম করের বিনিময়ে তাঁর রাজ্য ফেরত দেন।

·         ১০০৮ খ্রীঃ মামুদ সুখপালকে (নওশা শাহ) পরাজিত ও বন্দী করে তার রাজ্য মুলতান দখল করেন।

·         ঐ বছরই আনন্দপালের বিরুদ্ধে অভিযান করেন। আনন্দপালের সঙ্গে উজ্জয়িনী, গোয়ালিয়র, কালিঞ্জর, কনৌজ, দিল্লী ও আজমীরের শাসকদের মিলিত বাহিনীকে মামুদ পরাজিত করেন।

·         ১০০৯ খ্রিঃ অনন্দপালের বিরুদ্ধে অভিযান করেন। আনন্দপাল মামুদের বশ্যতা স্বীকার করেন।
·         ইতিমধ্যে আবুল ফতে দাউদ স্বাধীনতা ঘোষণা করলে মামুদ তাকে আবার পরাজিত ও বন্দী করেন। গজনীতে নিয়ে যান।

·         ১০১৩ খ্রিঃ শাহী রাজ্যের রাজধানী নন্দনহ দখল করেন। একই সাথে শাহী রাজা ত্রিলোচন পাল শাসিত কাশ্মীর অভিযান করে লুণ্ঠন করেন।

·         ১০১৫ খ্রিঃ তিনি আবার কাশ্মীর আসেন। কিন্তু লাখোট দুর্গ জয় করতে অসমর্থ হয়ে দেশে ফেরেন।
·         ১০১৮ খ্রিঃ কনৌজ, মহাবন ও মথুরা লুণ্ঠন করেন।

·         ১০২০-২১ খ্রিঃ তিনি মামুদ চান্দেল্ল রাজা বিদ্যাধর কে শাস্তি দিতে অগ্রসর হলে ত্রিলোচন পাল বাধা দেন। মামুদ ত্রিলোচনপালকে পরাজিত করেন।

·         ১০২১ খ্রিঃ মামুদ পাঞ্জাব দখল করে শাহী বংশের অবসান ঘটান।

·         ১০২১-২২ খ্রিঃ মামুদ পরপর দুবার চান্দেল্ল রাজা বিদ্যাধরের বিরুদ্ধে অভিযান করেন এবং প্রচুর উপঢৌকন আদায় করেন।

·         ১০২৪খ্রিঃ তিনি গুজরাটের সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন করেন প্রায় দুই কোটি টাকার সম্পত্তি এবং শিবলিঙ্গটি নিজের নিজের সাথে নিয়ে যান 

·         ১০২৭খ্রিঃ তিনি জাঠ দের বিরুদ্ধে শাস্তি মূলক অভিযান করেন।

·         ১০৩০খ্রিঃ তাঁর মৃত্যু হয়।


মন্তব্যসমূহ

  1. সুলতান মামুদ 1025 খ্রিস্টাব্দে গুজরাটের আনহিলওয়াড়া অবস্থিত সোমনাথ মন্দির লুঠ করেন। সুলতান মাহমুদকে 'নিছকই আক্রমণকারী দস্যু' বলে অভিহিত করেছেন ভিন্সেন্ট স্মিথ।
    ইরফান হাবিব বলেছেন Mahmood was not a fanatic and his expeditions against India were not motivated by religion but by love of plunder.
    ঈশ্বরী প্রসাদ বলেছেন wealth and territory,the extirpation of Idolatry and not conquest,were the objects of his raids.
    আল বেরুনী বলেছেন Mahmud utterly ruined the property of the country and performed those wonderful exploits by which the Hindus because like the atoms of dust,scattered in all directions.

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য Please visit our Homepage and subscribe us. Suggested Topics || Ghajnavid Invasion || গজনী আক্রমণ || || মামুদের সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন || Somnath Temple Plunder || || তরাইনের যুদ্ধ ও তার গুরুত্ত্ব || মহম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমন ও তার চরিত্র || সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আ

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগার:-   কোনো ব্যাক্তিগত বা অলাভজনক

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল তা জনজীবনে তীব্রভ