সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

চৌরিচৌরা ঘটনা ও বারদৌলি সিদ্ধান্ত

Abdul Mojaffar Mondal
Assistant Professor, Sonarpur Mahavidyalaya

চৌরিচৌরা ঘটনা ও  বারদৌলি সিদ্ধান্ত

ভা
রতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে মহাত্মা গান্ধীর অবদান বিশেষ উল্লেখযোগ্য। গান্ধীজীর নেতৃত্বে যে তিনটি সর্বভারতীয় রাজনৈতিক আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল তার মধ্যে প্রথম আন্দোলন ছিল অহিংস অসহযোগ আন্দোলন। এই আন্দোলন প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত 1922 সালের 12 ই ফেব্রুয়ারি বারদৌলি তে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের কার্যকরী সভায় গৃহীত হয়েছিল বলে এই সিদ্ধান্ত বারদৌলি সিদ্ধান্ত নামেও পরিচিত।
1921 সালের অন্তিম লগ্নে দেখা গেল যে অসহযোগ আন্দোলন আর গান্ধীপন্থী অহিংস পথের মধ্যে সীমাবদ্ধ রইল না। ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হিংসাশ্রয়ী ঘটনার খবর আসতে থাকে। গান্ধীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে গুন্টুর জেলা কংগ্রেস কমিটি আইন অমান্য করার সিদ্ধান্ত নেয়। একের পর এক আদর্শ চ্যুতির ঘটনায় গান্ধীজী ব্যথিত হন। ইতিমধ্যে যুক্তপ্রদেশ গোরক্ষপুর জেলার চৌরিচৌরা গ্রামে একটি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে যায়। স্থানীয় একটি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী ছিল যারা মদ বিক্রি ও খাদ্যশস্যের মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে স্থানীয় বাজারে ধরনা শুরু করেছিল। স্বেচ্ছাসেবকদের নেতা ভগবান অহী পুলিশের হাতে ধরা পড়েন এবং প্রচন্ড মার খান। প্রতিবাদী জনতার ওপর পুলিশ গুলি চালায়। উন্মত্ত জনতা তখন 1922 সালের 5 ফেব্রুয়ারি থানা ঘেরাও করে 22 জন পুলিশ কর্মীকে পুড়িয়ে মারে। এই ঘটনায় দায়রা আদালত প্রাথমিকভাবে 172 জনকে মৃত্যুদণ্ড নির্দেশ দেয়। শেষ পর্যন্ত 19 জনের ফাঁসি হয় এবং অন্যান্যদের দ্বীপান্তর হয়। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে গান্ধীজী -- আন্দোলন হিংসাত্মক হয়ে উঠেছে -- এই অভিযোগ তুলে অসহযোগ-খিলাফত আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেন।
প্রায় সমস্ত কংগ্রেস ও খিলাফত নেতা গান্ধীজীর বারদৌলি সিদ্ধান্তে স্তম্ভিত হয়েছিলেন এবং আন্দোলন প্রত্যাহারের বিষয়টিকে তীক্ষ্ণ ভাষায় নিন্দা করেছিলেন। মোহাম্মদ আলী বলেছিলেন- বারদৌলি সিদ্ধান্ত আত্মসমর্পণের সমার্থক। মতিলাল নেহেরু ও চিত্তরঞ্জন দাশ এবং সুভাষ বসুর মত নেতারাও গান্ধীর সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেননি। এই সিদ্ধান্ত জহরলাল নেহরু কেও প্রাথমিকভাবে হতাশ করেছিল। যে মুহুর্তে তার প্রদেশ আন্দোলনের শক্তি সঞ্চয় করছিল সেই মুহুর্তে প্রত্যাহারের বিষয়টি তিনি মেনে নিতে পারেননি। পরবর্তীকালে অবশ্য তিনি গান্ধীর সিদ্ধান্তের প্রতি সমর্থন করেছিলেন।
মাক্সবাদী পন্ডিত ও ঐতিহাসিকগণ গান্ধীজীর আন্দোলন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তকে কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেছিলেন। রজনীপাম দত্ত তাঁর 'ইন্ডিয়া টুডে' গ্রন্থে বলেছেন গান্ধী সমেত কংগ্রেস নেতৃত্ব জঙ্গী গণঅভ্যূত্থান কে ভয় পেতেন; কারণ তা দেশের বিত্তশালী মানুষের স্বার্থের পরিপন্থী এবং কংগ্রেসের সঙ্গে এই বিত্তশালী শ্রেণীর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। তাঁর মতে হিংসা অহিংসা নয় বিত্তশালী শ্রেণীর স্বার্থের বিরুদ্ধে এই আন্দোলন চলে যাচ্ছিল বলে গান্ধী আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেন। মার্কসবাদী লেখকদের বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা করেছেন বিপান চন্দ্র, আদিত্য মুখার্জি, অমলেশ ত্রিপাঠী প্রমূখ জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিক। তাদের বক্তব্য, আন্দোলন প্রত্যাহার কোন বিশ্বাসঘাতকতা নয়, রাজনৈতিক সংগ্রামের রণনীতিরই একটি অংশ। তাছাড়া গান্ধী যে সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তা শ্রেণী সংগ্রাম নয়, জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম। যে মুহূর্তে সংগ্রাম শ্রেণীসংগ্রামের রূপ নিচ্ছিলো সেই মুহূর্তে জাতীয়তাবাদী ঐক্য ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। তাই গান্ধীর আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘটনাকে তার দূরদৃষ্টির পরিচয় বলেই জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকদের অভিমত।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য Please visit our Homepage and subscribe us. Suggested Topics || Ghajnavid Invasion || গজনী আক্রমণ || || মামুদের সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন || Somnath Temple Plunder || || তরাইনের যুদ্ধ ও তার গুরুত্ত্ব || মহম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমন ও তার চরিত্র || সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আ...

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগ...

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হ...