Abdul Mojaffar Mondal
Assistant Professor, Sonarpur Mahavidyalaya
মুঘল ভারতে বিভিন্ন প্রকার কৃষক | Mughal Cultivator
ষোলো সতেরো শতকীয় ভারতবর্ষে মোট জনসংখ্যার ৮৫ শতাংশ গ্রামে বাস করত। গ্রামীণ সম্প্রদায়ের বড় অংশই ছিল কৃষক। মুঘল যুগে কৃষকদেরকে বুঝাতে সমসাময়িক নথিপত্রে 'মাজারা', 'আসামি' বা 'রাইয়া' শব্দের প্রয়োগ হয়েছে। মোরল্যান্ড মনে করেন গ্রামীণ কৃষক সমাজ বা গ্রামীণ জমিদার এবং গ্রামে যেসব চাষি বাস করে অথবা যারা গ্রামে বাস করে না অথচ চাষের জন্য গ্রামের বাইরে থেকে আসত এই তিন শ্রেণীর চাষীকে নিয়েই মুঘল যুগে কৃষক সমাজ গঠিত হতো। যদিও মোরল্যান্ড এর উক্ত জমিদার শ্রেণী কে কৃষক শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারটি মেনে নেওয়া যায় না। এন এ সিদ্দিকি দেখিয়েছেন, কৃষক বলতে সেই চাষিকে বোঝায় যার দখলি স্বত্ব থাক বা না থাক জমি বিক্রি অথবা বন্দক দেওয়ার অধিকার কৃষকের থাকেনা। জমিদারের সেই অধিকার থাকত।
গ্রাম সমাজের প্রধান বিশেষত্ব হলো বহুমাত্রিক বিভাজন। এই বিভাজন কিন্তু বৈষয়িক অবস্থার তারতম্যের ভিত্তিতে হত না, হত অবস্থানিক মর্যাদা, জাতি এবং সামাজিক মর্যাদার ভিত্তিতে। মুঘল যুগে দলিলপত্রে তিন ধরনের গ্রামীণ স্তরের উল্লেখ আছে। সেগুলি হল খুদকস্ত, পাহিকস্ত এবং মুজারিয়ান।
গ্রামে পুরাতন কৃষিজীবীদের বংশধরদের সংস্কৃতে 'স্থানিক' বলা হতো মহারাষ্ট্রে এদের 'থানি', 'স্থলবাহক', 'মিরাশি' বলা হত। রাজস্থানে এদের 'গাওভেতি' বা 'গভেতি' বলা হত। এই স্থানীয় কৃষকদের কে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে প্রথমত: 'রিয়ায়তি' অর্থাৎ সুবিধাভোগী সম্প্রদায় এবং 'রায়তি' অর্থাৎ সাধারণ কৃষক। মুঘল ফার্সি দলিলপত্রে এই সুবিধাভোগী গ্রামীণ সম্প্রদায় 'খুদকস্ত' নামে পরিচিত। 'খুদকস্ত' বলতে সেই সম্প্রদায়কে বোঝায় যাদের নিজস্ব জমি আছে এবং যারা পারিবারিক অথবা ভাড়াটিয়া শ্রমিকের সহযোগিতায় কৃষিকার্য সম্পাদন করে। এরা সরকারকে ভূমি রাজস্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে ছাড় পাওয়ার পাশাপাশি অন্যান্য করে, যেমন বিবাহ কর, আংশিক বা সম্পূর্ণ ছাড় পেয়ে থাকে। যদি গ্রামে তাদের একটি মাত্র বাড়ি থাকে তাহলে তাদের কোন গৃহকর দিতে হত না। ব্রিটিশ রাজপুরুষ ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার দেখিয়েছেন, এই সুবিধাভোগী সম্প্রদায় ছিল গ্রামীণ সমাজের পরিচালক এবং সম্মানীয় 'ভদ্রলোক'। এদের গ্রামের চারণভূমি, অরণ্যভূমি, জলাশয়, এবং মৎস্য সম্পদ ব্যবহারে কোনো বাধা ছিলনা।
'পাহি' বা 'পাহিকস্ত' বলতে বহিরাগত কৃষকদেরকে বোঝানো হয়। এরা নিকটবর্তী গ্রাম বা পরগনা থেকে আসতো গ্রামের উদ্বৃত্ত জমি চাষ করার জন্য। কোন বিধ্বস্ত গ্রাম নতুন করে চাষের আওতায় আনতে অথবা নতুন করে কোন গ্রামীণ বসতি স্থাপনে এদের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। এদের অনেক ক্ষেত্রে দলিত সম্প্রদায় থেকে আনা হত। বহু ক্ষেত্রে এদের সুবিধাজনক ছাড়সহ পাট্টা দেওয়া হত এবং তৃতীয় অথবা পঞ্চম বর্ষ অথবা তারও পরে থেকে পুরো দরে রাজস্ব নেওয়া হত। পূর্ব রাজস্থানের মালারন পরগনার মেহরাজ পুর গ্রামে এইরকম সেটেলমেন্টের নজির লক্ষ্য করা গেছে। পাহিকস্ত কৃষকরা সরকারের তরফ থেকে সুযোগ সুবিধা পেত। এদের নিজস্ব সম্বল না থাকলে সরাসরি রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে অথবা গ্রামীণ ঋণদাতার পক্ষ থেকে হাল, বীজ, টাকা পয়সা ব্যবস্থা করা হত। তারা যতদিন পর্যন্ত নির্ধারিত হারে ভূমি রাজস্ব জমা দিতে পারতো ততদিন তারা ওই জমি চাষ করত। অর্থাৎ পাহি কৃষকরা অস্থায়ী বা পরিযায়ী কৃষক নয়। কারণ তাদের বেশিরভাগই কোননা কোন একটি গ্রামে স্থায়ী হয়ে যেত।
সাধারণ কৃষকদের ফারসি রচনাবলীতে 'মুজারিয়ান' বলা হয়েছে। রাজস্থানে এদেরকে 'রায়তি' অথবা 'পাল্টি' বলা হত। মুজারিয়ান কৃষকদের দুটি ভাগ। কিছু মুজারিয়ান কৃষকের নিজস্ব জমি ছিল। রায়তি দস্তুর অনুসারে এদের জমির উপর রাজস্ব নির্ধারিত হতো, যা নির্ভর করতে ফসলের ধরণ ও সেচের সুবিধার উপর। আবার কেউ ছিলেন ভাড়াটে কৃষক। ভাড়াটে কৃষকরা আবার দুই প্রকার। কিছু ভাড়াটে কৃষকদের নিজস্ব সরঞ্জাম ছিল, যারা রাষ্ট্রের পতিত জমি এবং খুদকস্তের পরিত্যক্ত জমিতে চাষ করত। এরা যে পাট্টা পেত তার পুনর্নবীকরণ করা যেত। দ্বিতীয়তঃ কিছু ভাড়াটে কৃষকদের নিজস্ব সরঞ্জাম ছিল না এবং এরা জমিদার, বুমি বা প্যাটেলের জমি বা ইনাম জমিতে চাষ করত এবং সরঞ্জামের জন্য জমির মালিকের উপর নির্ভর করত। এরা ছিল অস্থায়ী কৃষক। এরা সমাজে সম্মান পেত না এবং এই 'পালটি' শব্দটি তাদের প্রতি নিন্দাসূচক অর্থে ব্যবহৃত হত।
পরিশেষে, গ্রামে অধিকাংশ কৃষকই ছিল মধ্য-পর্যায় ভুক্ত। বেশিরভাগ বড় গ্রামে ছিল চার থেকে পাঁচজন(অথবা ৫-১০%) সমৃদ্ধশালী কৃষক। অন্যদিকে 15 থেকে 30 শতাংশ কৃষকের কোন জমি ছিল না এবং এদেরকে দরিদ্র কৃষক হিসেবে চিহ্নিত করাই সমীচীন। গ্রামগুলিতে ধনী ব্যক্তির ক্রমশ আরও ধনী হয়েছিল এবং দরিদ্র যে দরিদ্রতর হচ্ছিল তার অবশ্য কোনো নথিগত প্রমাণ নেই। তবে রাষ্ট্রকাঠামো দুর্বল হয়ে পড়লে এই আশঙ্কা সত্য হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি ছিল।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন