সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

সামন্ততন্ত্রের প্রকৃতি

সামন্ততন্ত্রের প্রকৃতি

নবম ও দশম শতকে ইউরোপে কেন্দ্রীয় শাসন ভেঙে পড়লে ভূমিনির্ভর অভিজাত ও সরকারি কর্মচারীরা রাজতন্ত্রের বদলে এক ধরনের বিকল্প রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিকল্প ব্যবস্থা গড়ে তোলে যার নাম সামন্ত প্রথা। এই ব্যবস্থা ইউরোপে প্রায় ৫০০ বছরের স্থায়ী ছিল।

সামন্ত প্রথা হলো এমনই এক বদ্ধ উৎপাদন ব্যবস্থা যার প্রধান ভিত্তি হল কৃষিজ উৎপাদন। পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর গথ, ভ্যান্ডল, ফ্র্যাঙ্ক প্রভৃতি বর্বর জাতিগুলি পশ্চিম ইউরোপের অঞ্চলগুলি অধিকার করে বসে এবং রাজার মতো তারা জমির অধিকার দাবি করে। এরা এদের জাত ভাইদেরও জমি বন্টন করে। এই জমি বন্টন প্রথম দিকে ব্যক্তিগত হলেও পরে বংশানুক্রমিক হয়ে পড়ে। এইভাবে যারা জমি লাভ করল তারা রাজাকে বা তাদের প্রধানকে সামরিক শক্তি এবং কর দিতে বাধ্য থাকত। এই জমি খণ্ডগুলিকে ফিউড, এবং ফিউডের অধিকারীকে ফিউডাল বা সামন্ত বলা হত। তাই এই উৎপাদন ব্যবস্থা ফিউডালিজম বা সামন্ত প্রথা নামে পরিচিত। সুতরাং সামন্তপ্রথায় তিনটি সামাজিক শ্রেণী লক্ষ্য করা যায়: পিরামিডের শীর্ষে রাজা, দ্বিতীয় স্তরে বহু সংখ্যক সামন্ত প্রভু এবং তৃতীয় স্তরে কৃষক, সার্ফ, ব্যারন আর নাইট। 

সামন্ততন্ত্র রাজতন্ত্রকে ধ্বংস করলেও সামন্ত ব্যবস্থার শীর্ষে ছিলেন রাজাই। রাজা ছিলেন জমি, শাসন ও বিচার ব্যবস্থার প্রধান। তিনি এই সমস্ত অধিকার তুলে দেন ভূস্বামীদের হাতে, ভূস্বামীরা ভ্যাসালদের হাতে। এই ব্যবস্থায় আসলে রাজা ছাড়া আর সকলেই ছিলেন ভ্যাসাল। ভ্যাসল তার লর্ড-এর কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে আনুগত্য বা বিশ্বস্ততার শপথ নিতেন। কোনো পক্ষ শপথ বা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলে নৈতিক অপরাধে অপরাধী গণ্য হতেন। শপথ গ্রহণের অনুষ্ঠানে ধর্মগ্রন্থ ও চার্চকে সাক্ষী রাখা হতো। বিশ্বাস ভঙ্গের ঘটনা ঘটলে লর্ড ভ্যাসালের বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা নিতে পারতেন। একজন ভ্যাসাল একাধিক লর্ড রাখতে পারতেন তবে সে একজনকে প্রধান লর্ড হিসাবে বেছে নিতেন।

লর্ড এবং ভ্যাসালের সম্পর্ক ছিল চুক্তি নির্ভর। লর্ড ভ্যাসালের ফিফ বা ভূমিখন্ড রক্ষা করবেন। যুদ্ধ, শাসন ও বিচারের ক্ষেত্রে সাহায্য দেবেন। বিনিময়ে ভ্যাসাল দেবেন কর, সেবা ও সামরিক সাহায্য। একজন শর্ত ভাঙলে অপরের আর দায়িত্ব থাকবে না। লর্ড ভ্যাসালের ফিফ পরিদর্শনে গেলে ভ্যাসাল তার জন্য খাদ্য ও বাসস্থানের দায়িত্ব নেবে। ভ্যাসাল লর্ডের আদেশ অমান্য করলে লর্ড অন্যান্য ভ্যাসালদের নিয়ে বিদ্রোহী ভ্যাসালকে আক্রমণ করবে। ভ্যাসাল লর্ড কে যা অর্থ দিতেন তা কর হিসেবে দিতেন না, দিতেন অনুদান হিসাবে। তবে বিশেষ পরিস্থিতিতে রাজা অর্থ দাবি করতে পারতেন। এছাড়া ভ্যাসালকে উত্তরাধিকার কর বা রিলিফ দিতে হতো। উভয়ের মধ্যে এই চুক্তি ভ্যাসালেজ নামে পরিচিত। ঐতিহাসিক Mark Bloch বলেছেন ভ্যাসালেজ এবং ফিফ এই দুইয়ের যৌথ প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট রাজনৈতিক-সামরিক ব্যবস্থাই ছিল সামন্ত প্রথা।

সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল ম্যানর ব্যবস্থা। ম্যানর ব্যবস্থা এমনই এক আর্থসামাজিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা যেখানে ভুমিধিকারী সামন্তপ্রভু তার ম্যানর বা মৌজার অন্তর্গত সমস্ত ভূমিদাস বা কৃষকদের উপর বিভিন্ন রকম অধিকার ভোগ করে। অর্থ সংক্রান্ত, বিচার সংক্রান্ত এবং শাসন সংক্রান্ত সমস্ত অধিকারই তার হাতে থাকে। বিনিময়ে ভূমি দাস পায় বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা এবং ম্যানরের অন্তর্গত জমিতে বসবাস করা ও জীবন ধারণ করার অধিকার। মার্ক ব্লক মনে করেন ম্যানর ব্যবস্থা সামন্ত প্রথার অঙ্গ নয়, তবে এটিই ছিল সামন্ততান্ত্রিক অর্থনীতির মূল ভিত্তি।

ইউরোপে সামন্ততন্ত্রের কোন প্রকৃতিগত সাযুজ্য ছিল না। এমনকি ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে তার বৈসাদৃশ্য ঐতিহাসিক মহলে বিতর্কে সৃষ্টি করেছে। মার্ক ব্লক মনে করেন প্রকৃত সামন্ততন্ত্র কেবল প্রাক্তন ক্যারোলিঞ্জিয় সাম্রাজ্যেই অর্থাৎ বর্তমানে ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানি, ইতালি ও মধ্য-পশ্চিম ইউরোপে দেখা যায়। অন্যত্র ছিল সামন্ততান্ত্রিক সমাজ। কেবল ইংল্যান্ডে নর্ম্যান বিজয়ের পর সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব হয়েছিল। অন্যান্য জায়গার ঐতিহাসিক গবেষণায় সামন্ততান্ত্রিক সমাজ বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। কারণ সেখানে ফিফ ও ভ্যাসালেজ, যা সামন্ততন্ত্রের মূল ভিত্তি, তা কখনোই ততটা গুরুত্ব পাইনি, যতটা ফ্রান্সে পেয়েছিল।

সামন্ততন্ত্রে আঞ্চলিক বৈচিত্র্যের কারণ ছিল বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে সামন্ততান্ত্রিক কাঠামোর উত্থান। ব্লকের মতে পশ্চিম ইউরোপে নবম বা দশম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে সামন্ততন্ত্রের  উত্থান ঘটেছিল, অন্যদিকে মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের ঘটে দ্বিতীয় সামন্ত যুগে অর্থাৎ দ্বাদশ শতকের পরে, যার মূল ভিত্তি ম্যানরব্যবস্থা।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য Please visit our Homepage and subscribe us. Suggested Topics || Ghajnavid Invasion || গজনী আক্রমণ || || মামুদের সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন || Somnath Temple Plunder || || তরাইনের যুদ্ধ ও তার গুরুত্ত্ব || মহম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমন ও তার চরিত্র || সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আ...

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগ...

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হ...